আমি আদাবর থানা বিএনপির মা-বাপ, আমি যা বলব তাই হবে। যত টাকা চাইব, তত টাকাই আমাকে দিতে হবে। থানা-পুলিশে অভিযোগ দিলে টাকার পরিমাণ দ্বিগুণ হবে। পুলিশ আমার কথায় ওঠে আর বসে। আমার কথা না শুনলে পরিমাণ হবে ভয়ংকর।
এমন টেলিফোন সংলাপ রাজধানীর আদাবর থানা বিএনপির আহ্বায়ক পরিচয় দেওয়া মনোয়ার হোসেন জীবন ওরফে লেদু হাসানের। এর বাইরে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজও রয়েছে। পুলিশের খাতায় লেদু হাসান একজন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী এবং তালিকাভুক্ত চাঁদাবাজ।
বৃহত্তর মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকার একাধিক ব্যবসায়ীর কাছে ঈদ সালামির নামে লেদু হাসানের মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবির একাধিক অডিও রেকর্ড এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
চারদিকে ঈদ ঘিরে সাজসাজ রব ও ঈদের আনন্দ সবার মধ্যে। কেউ ঈদের বাজারসদাই করতে ব্যস্ত, আবার কেউ কেউ গ্রামে থাকা পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ পালনে যেতে প্রস্তুত। এরই মধ্যে নীরবে চলছে ঈদ সালামির নামে চাঁদাবাজি।
নীরবে চললেও অন্যান্যবারের চেয়ে এবার চাঁদাবাজির পরিমাণ বেড়েছে। ৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে শীর্ষ সন্ত্রাসী, এলাকার পাতি মাস্তান এবং রাজনৈতিক লেবাসধারী সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েছেন।
একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশের কাছে গিয়ে কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না। এজন্যই রাজনৈতিক শেল্টার নিশ্চিত করতে নেতাদের কথামতো নির্ধারিত রেটের চেয়ে বেশি চাঁদা দিতে বাধ্য হতে হচ্ছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবিপ্রধান রেজাউল করিম মল্লিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা চাঁদাবাজদের একটি তালিকা করে তাদের মনিটরিং করছি। অপরাধের সঙ্গে থাকার প্রমাণ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। থানায় কোনো অভিযোগ জমা পড়লেই ডিবি পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে।’
রাজনৈতিক নেতাদের পরিচয়ের পাশাপাশি শীর্ষ সন্ত্রাসীরা তাদের অনুসারীদের দিয়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে নির্মাণাধীন ভবনে গিয়ে ঈদ সালামি দাবি করছে। না দিলে গুলি, কোপানো ও হামলার ঘটনাও ঘটাচ্ছে।
বৃহত্তর মোহাম্মদপুর এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী নবী গ্রুপের সদস্যরা একাধিক নির্মাণাধীন ভবনে গিয়ে গুলি ও কুপিয়েছে। পিচ্চি হেলাল, কিলার আব্বাস, সুব্রত বাইন, শাহাদাত ও ইমন গ্রুপের সদস্যদের ঈদ সালামির চাঁদা দাবির অত্যাচারে অতিষ্ঠ মিরপুর, ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দারা।
ঢাকাসহ সারা দেশে চলছে ঈদ সালামির নামে চাঁদাবাজি। সম্প্রতি একাধিক ব্যবসায়ী ও ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় বিএনপির ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর উত্তরে আহ্বায়ক আমিনুল হক রূপালী বাংলাদেশকে জানান, বিএনপির নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের নেতা তারেক রহমানের নির্দেশে বিএনপির কোনো নেতাকর্মী চাঁদাবাজিতে জড়িত এমন প্রমাণ পেলেই তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট-পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা এবং রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে চাঁদাবাজরা বেপরোয়া।
দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক লেবাসধারী সন্ত্রাসী এবং বছরের পর বছর যেসব শীর্ষ সন্ত্রাসী কারাগারে বন্দি ছিল, তারা বর্তমানে জামিনে মুক্ত হয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছে, কে কীভাবে টাকা কামাবে। প্রভাব ও আদিপত্য বিস্তার নিয়ে খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়েছে।
তাদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কারণে ঢাকাসহ পুরো দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়ছে। নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার।
গতকাল বুধবার রাজধানীর মগবাজারে কথা হয় দেশবাংলা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের এমডির সঙ্গে। ওই এমডির নাম মো. আরিফ। আরিফ বলেন, এই রমজানের মধ্যে ইফতার ও ঈদ সালামি দিয়েছি অনেক টাকা, যার কোনো হিসাব নেই।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, দীর্ঘ ১৬ বছর পর এই সালামি নিয়ে একদল রাজনৈতিক চক্র ব্যবসা করছে। নম্র-ভদ্রভাবে তারা বারবার মোবাইল ফোনে এবং অফিসে গিয়ে ঈদের সালামি চায়। যথাযথ দিতে না পারলেও মানবতার খাতিরে তাদের ঈদের সালামি দিতে হয়েছে বাধ্য হয়ে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ঈদ সালামির নামে কেউ চাঁদাবাজিতে জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চাঁদাবাজিতে শীর্ষ সন্ত্রাসী বা রাজনৈতিক নেতা যেই হোক না কেন, পুলিশ অভিযোগ পেলে তদন্ত-পূর্বক ব্যবস্থা নেবে।
মিরপুরে কথা হয় একটি ট্রাভেলসের মালিক মো. রাজুর সঙ্গে। রাজু বলেন, ‘সমন্বয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরাসহ নানান সংগঠন রমজানের মধ্যে ইফতার করার জন্য অফিসে দাওয়াত দিতে আসে এবং তারা নম্র-ভদ্রভাবে ইফতারের ব্যবস্থা ও ঈদ সালামি নিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে এদের কিছু বলতে পারি না।’
উত্তরায় কথা হয় তাওহিদ নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি এ পর্যন্ত ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা দিয়েছি বিভিন্ন ইফতার পার্টিতে।
প্রতিদিন রমজানে কোনো না কোনো ব্যক্তি এসে রোজা, ইফতার অথবা ঈদ সালামি দাবি করে, বাধ্য হয়ে আমাদের দিতে হয়। তিনি অভিযোগ করে বলেন, তাছাড়া অনেকেই এমনভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করে এবং কথাবার্তা বলে, তাদের ঈদ সালামি না দিলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ভয় থাকে, এজন্য বাধ্য হয়ে দিচ্ছি।’
শুধু আরিফ, রাজু, তাওহিদ নন, এমন অসংখ্য মানুষ ও ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ীরা ঈদ সালামির নামে আতঙ্কে রয়েছেন। রাজনৈতিক নেতাদের ভয়ে তারা পুলিশ বা অন্য কাউকে এসব বিষয়ে কিছু বলতে পারছেন না।
তাছাড়া একটি সংঘবদ্ধ দল প্রতিনিয়ত রোজার মধ্যে ইফতার ও ঈদের সালাম দিয়ে খুশি হয়ে যা দিবেন বলে দাবি করেন। বাধ্য হয়ে সেটি দিতে হবে।
অবশ্য এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ঈদ সালামি নামের চাঁদাবাজিে বিষয়ে এ পর্যন্ত কেউ থানায় অভিযোগ করেছে কি না, আমার জানা নেই।
তবে কিছু কিছু কৌশলে চাঁদাবাজি যারা করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে আমরা কাজ করছি এবং করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, তাছাড়া যদি কোনো রাজনৈতিক দল কারোর অফিসে গিয়ে চাঁদা দাবি করে, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানাবেন। এ বিষয়ে পুলিশ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
ডিএমপি ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার হাসান মোহাম্মদ নাছের (ডিসি) বলেন, মোবাইল ফোনে বা সরাসরি কেউ ঈদ সালামির নামে চাঁদা দাবি করলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
ডিএমপির ২৪ ঘণ্টা মনিটরিং করছে ভার্চুয়াল জগতের চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে। সিআইডি সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, ইদানীং মোবাইল ফোন দিয়ে ঈদ সালামির নামে চাঁদাবাজির অভিযোগের পরিমাণ বেশি আসছে। চাঁদাবাজদের বিষয়ে সাধারণ মানুষ অভিযোগ করলেই আমরা দ্রুত অ্যাকশনে যাচ্ছি।
আপনার মতামত লিখুন :