বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মঞ্জুরুল ইসলাম, ময়মনসিংহ

প্রকাশিত: এপ্রিল ৫, ২০২৫, ০১:০৪ এএম

ভাড়াটে সৈনিক হয়ে রুশ বাহিনীতে, যুদ্ধের ময়দানে স্বপ্নের মৃত্যু

মঞ্জুরুল ইসলাম, ময়মনসিংহ

প্রকাশিত: এপ্রিল ৫, ২০২৫, ০১:০৪ এএম

ভাড়াটে সৈনিক হয়ে রুশ বাহিনীতে, যুদ্ধের ময়দানে স্বপ্নের মৃত্যু

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

স্বপ্ন ছিল সেনাবাহিনীতে চাকরি করার। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন ইয়াসিন শেখ (২২)। পরে ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে রাশিয়ার একটি কোম্পানিতে চাকরি নেন তিনি। সেখান থেকে অফার আসে রুশ সেনাবাহিনীতে চুক্তিভিত্তিক যোগ দিতে। 

সেই চুক্তিতে রাজি হয়ে নামমাত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে যুদ্ধে যোগ দেন ইয়াসিন শেখ। সেনাবাহিনীতে চাকরি করার ইচ্ছা পূরণ হলেও পরিবারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার আগে মৃত্যুর খবর আসে ইয়াসিন শেখের। এরপর থেকে বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। 

ছেলের ছবি বুকে জড়িয়ে আহাজারি করছেন মা। এলাকাজুড়ে বইছে শোকের ছায়া। ভাড়াটে যোদ্ধা নিতে গোপনে কোনো সিন্ডিকেট কাজ করছে বলে দাবি নাগরিক সমাজের।

ইয়াসিন শেখের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলার ডৌয়াখলা ইউনিয়নের মরিচালি গ্রামে। ওই গ্রামের মৃত আবদুস সাত্তার শেখের ছেলে তিনি। গত ২৭ মার্চ ইয়াসিন নিহত হলেও স্বজনেরা জানতে পারেন ঈদের পরদিন মঙ্গলবার। 

রাশিয়ায় থাকা ইয়াসিনের বন্ধু মেহেদী হাসান ইয়াসিনের বড় ভাই রুহুল আমিনকে মৃত্যুর খবর দেন। যুদ্ধ চলাকালে মিসাইল হামলায় ইয়াসিন শেখ প্রাণ হারান বলে জানিয়েছেন তিনি।

স্বজনরা জানান, ইয়াসিনের বাবা মারা গেছেন ২০১৬ সালে। বড় ভাই তার পড়াশোনা ও বিদেশ যাত্রার খরচ দিয়েছেন। ৪০ শতক জমি বিক্রি করে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে গত বছরের ২২ আগস্ট রাশিয়ায় যান ইয়াসিন। সেখানে রাশিয়ার একটি কোম্পানিতে চাকরি করতে যান। 

পরে অনলাইনে আবেদন করে গত ২২ ডিসেম্বর চুক্তিভিত্তিক যোদ্ধা হিসেবে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রশিক্ষণের পর ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নেন শেখ।

রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নেওয়ার ছবি ও ভিডিও নিয়মিত নিজের ফেসবুকে প্রকাশ করতেন ইয়াসিন শেখ। গত ১ মার্চ ফেসবুকে বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে ভিডিও আপলোড করেন ইয়াসিন। ভিডিওতে রাশিয়ায় যাওয়া, সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া ও তার স্বপ্নপূরণ নিয়ে কথা বলেন তিনি।

ভিডিওতে ইয়াসিন উল্লেখ করেন, গত বছরের জানুয়ারিতে রাশিয়ার একটি কোম্পানিতে চাকরির জন্য আবেদন করেন। মস্কো থেকে প্রায় ১১ হাজার কিলোমিটার দূরের ওই কোম্পানিতে তিন মাস চাকরির পর অনলাইনে আবেদন করে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে চুক্তিভিত্তিক সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। দেশে না হলেও বিদেশে সৈনিক হয়ে বাবার স্বপ্নপূরণ হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি নেপালে পালিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ঢাকার বিমানবন্দর এলাকা থেকে রাশিয়ায় মানবপাচার সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ফাবিহা জেরিন তামান্না নামে এক নারীকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। 

এর পরেই খবর আসে দালালের খপ্পরে পড়ে রাশিয়ায় গিয়ে ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে ইউক্রেন যুদ্ধে প্রাণ হারান নাটোরের সিংড়া উপজেলার হুলহুলিয়া গ্রামের যুবক মো. হুমায়ুন কবির (৩৩)। একই রণাঙ্গনে আটক রয়েছেন তার ভগ্নিপতি মো. রহমত আলী। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য বারবার পরিবারের কাছে আকুতি জানিয়েছেন।

এদিকে, যশোর জেলার সদর উপজেলার চাঁচড়ার সরদারপাড়ার জাফর আলী নামে একজনের অভিযোগ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করতে দালালরা তাকে সেখানে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনি এখন ইউক্রেন যুদ্ধের ময়দানে রয়েছেন। 

তিনিও দেশে ফিরে আসতে চান। সারা দেশে এ রকম আরও কতজন রয়েছে রাশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান এখনো জানা যায়নি। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের ফেরানোর দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।

সূত্র জানায়, চাকরির জন্য দালালের খপ্পরে পড়ে রাশিয়া গিয়ে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে নিহত হয়েছেন নাটোরের সিংড়ার যুবক হুমায়ুন কবির। গত ২৬ জানুয়ারি ড্রোন হামলায় মৃত্যু হয় তার। নিহত হুমায়ুনের ভগ্নিপতি রহমত আলীকেও (৪৬) বাধ্য করা হয়েছে, ওই যুদ্ধে অংশ নিতে। 

নামমাত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদের যুদ্ধে যেতে হয়েছে। রহমত আলী এখন বন্দি আছেন রাশিয়ান সেনাক্যাম্পে। স্বজনদের কাছে প্রাণে বাঁচার আকুতি তারও।

সিংড়ার হুলহুলিয়া গ্রামের হুমায়ুন কবির ও রহমত আলী সংসারে সচ্ছলতা আর সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিদেশ পাড়ি জমান। দালাল চক্রের মাধ্যমে প্রথমে ওমরাহ ভিসায় তাদের সৌদি আরব, এরপর ট্যুরিস্ট ভিসায় রাশিয়ায় নেওয়া হয়। সেখানে পৌঁছানোর পর তাদের বাধ্য করা হয় যুদ্ধে অংশ নিতে। গত মাসের ২০ তারিখ হুমায়ুন ও রহমত ফোনে স্বজনদের এসব তথ্য জানান। পরে ২৬ জানুয়ারি রহমত ফোনে হুমায়ুনের মৃত্যুর কথা জানান।

স্বজনদের দাবি, ২০২৪ সালের ২৮ অক্টোবর ড্রিম হোম ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরস লিমিটেড নামের ঢাকার একটি কোম্পানির মাধ্যমে হুমায়ুন ও রহমত পাড়ি জমিয়েছিলেন রাশিয়ায়। 

প্রতি মাসে আড়াই লাখ টাকা বেতন পাবেন; দালালদের এমন প্রলোভনে সংসারে সচ্ছলতা ফেরানোর আশায় জমিজমা, স্ত্রীর গহনা বিক্রি এবং উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে তারা দেশ ছাড়েন। সেখানে পৌঁছানোর পর বেশ কিছুদিন তাদের কোনো খোঁজ ছিল না। কিছুদিন আগে পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন তাদের বর্তমান দুর্গতির খবর। এর মাঝে খবর আসে রণাঙ্গনে মারা গেছেন হুমায়ুন।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে গৌরীপুরের নিহত ইয়াসিনের চাচাতো ভাই রফিকুল ইসলাম বলেন, ইয়াছিন সাবেক ছাত্রদল কর্মী ছিলেন। বিভিন্ন সময় তিনি আওয়ামী সরকারবিরোধী আন্দোলনের ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করতেন এবং তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের জন্য দোয়া চাইতেন। 

রাশিয়ায় যাওয়ার জন্য ঢাকায় একটি প্রতিষ্ঠানে রাশিয়ার ভাষা শেখেন ইয়াসিন। পরে বন্ধুর সহায়তায় রাশিয়ায় একটি কোম্পানিতে ভালো চাকরি পান। সবই ঠিকঠাক চলছিল। পরে রাশিয়ার সেনাবাহিনী যোগ দিয়ে সব উলটপালট হয়ে যায়। রাশিয়ান বাহিনীতে যোগ দেওয়ার সময় ইয়াসিনের মা ও বড় ভাইকে ঢাকায় নিয়ে অনাপত্তিপত্রে স্বাক্ষর নেয় রাশিয়া পাঠানো এজেন্সির লোকজন।

গত ২৬ মার্চ মা ফিরোজা খাতুনের সঙ্গে শেষবারের মতো কথা হয় ইয়াসিনের। এখন ছেলের ছবি বুকে নিয়ে আহাজারি করছেন তিনি। 

ফিরোজা খাতুন বলেন, বিদেশে যাওয়ার পর কোনো টাকা পাঠায়নি। আমরা খুব কষ্টে দিন পার করছিলাম। কয়েক দিনের মধ্যে টাকা পাঠাবে বলেছিল। কিন্তু আমার সব শেষ হয়ে গেল। ইয়াসিন সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধে যাবে জানলে তাকে বিদেশে পাঠাইতাম না। সরকারের কাছে একটাই দাবি, আমার ছেলের লাশ যেন আমার কাছে আইনা দেয়।

সাবেক ছাত্রদলকর্মী ইয়াসিনের মৃত্যুর খবর পেয়ে তার বাড়িতে যান গৌরীপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা আহাম্মদ তায়েবুর রহমান। তিনি বলেন, শ্রম চুক্তিতে ইয়াসিন রাশিয়ায় যাওয়ার পর কাজ বাদ দিয়ে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। 

কিন্তু যুদ্ধে মারা গেছেন। সেখানে থাকা তার সহযোদ্ধারা মুঠোফোনে জানিয়েছেন, তার দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। মরদেহ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। পরিবারটি যাতে ক্ষতিপূরণ পায়, সে জন্য সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।

এ বিষয়ে জেলা জনউদ্যোগের আহ্বায়ক অ্যাড. নজরুল ইসলাম চুন্নু বলেন, দেশের একজন নাগরিক দেশের বাইরে গিয়ে কী করছে বা অনৈতিক কোনো কাজে লিপ্ত হচ্ছে কিনা তার খোঁজখবর অবশ্যই সরকারের রাখা উচিৎ। 

সম্প্রতি রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে দুই বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। শুনেছি বেশকিছু লোক যুদ্ধের ফাঁদে আটকে আছে। তারা দেশে ফিরতে চাইলে অবশ্যই তাদের ফিরিয়ে আনা দরকার এবং সেই অনুযায়ী সরকারের পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বাংলাদেশি নাগরিকদের নিতে কোন সিন্ডিকেট কাজ করছে কিনা, তা ক্ষতিয়ে দেখে তাদের আইনের আওতায় আনা উচিৎ।

বিষয়টি জানার পর গৌরীপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুনন্দা সরকার প্রমা মরিচালি গ্রামে ইয়াসিন শেখের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের খোঁজ-খবর নেন।

গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাজ্জাদুল হাসান বলেন, বিষয়টি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। এ ব্যাপারে সব ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!