সংস্কার, বিচার নাকি নির্বাচন? কোন পথে দেশের রাজনীতি? কেউ বলছে সংস্কারের আগে নির্বাচন নয়, আবার কেউ বলছে ফ্যাসিবাদের বিচার না হওয়া অবদি নির্বাচন নয়। আবার কেউ বলছে বিএনপি চায় না সংস্কার।
যদিও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, রাজনৈতিক দৈন্যের কারণে একটি পক্ষ বিএনপির ওপর দোষ চাপিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টায় ব্যস্ত।
এসব করে বিএনপিকে ঠেকানো যাবে না। সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন এক সাথে চলতে বাধা নেই। তাই সংস্কারের দোহাই দিয়ে নির্বাচন পেছানোর দুরভিসন্ধি দেখতে পাচ্ছেন বিএনপির নেতারা।
এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির এনসিপি নেতারা বলছেন, সংস্কার ও বিচার ছাড়া কোনো দলকে ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা করা হলে জনগণ মেনে নেবে না।
সংস্কার ও বিচার ছাড়া নির্বাচন করতে চাইলে তাদের প্রতিহত করবে বলেও আল্টিমেটাম দিয়েছেন এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। গত ২৬ মার্চ সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে এমন হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
সংস্কার ও বিচারবিহীন নির্বাচন দেওয়া হলে তা মেনে নেওয়া হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, পুরোনো সংবিধান চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। অন্যদিকে ফ্যাসিবাদকে আবার পুনর্বাসনের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে।
নাহিদ আরও বলেন, ’৭১ এর স্বাধীনতা ও ’২৪ এর স্বাধীনতা পরস্পরবিরোধী নয়। সংস্কার ও বিচার ছাড়া কোনো দলকে ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা করলে জনগণ মেনে নেবে না।
একই সুরে কথা বলছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তারাও বলছে, আগে সংস্কার পরে নির্বাচন। ঈদ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সভা-সমাবেশে দলটির আমির, সেক্রেটারি জেনারেল বলছে নির্বাচন নিয়ে এত তাড়াহুড়ো নেই তাদের। নির্বাচনের আগে সংস্কার না হলে নির্বাচনের পর আর সংস্কার হবে না বলেও আশঙ্কা তাদের।
তবে ফ্যাসিবাদ আর যাতে ফিরে আসতে না পরে, তার জন্য ঐক্য আছে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ অন্যা দলগুলোর মধ্যেও। তবে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য রয়েছে সবদলের মধ্যেই। নিজেদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে বিরোধ তৈরি হওয়ায় পতিত স্বৈরাচার আবার ফিরে আসতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। এজন্য একে দোষ চাপাচ্ছে অন্যের ওপর।
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে দেখা দিয়েছে শীতলতা।
ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি, এমনকি বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টির রাজনীতিকরাও বাংলাদেশ নিয়ে একের পর এক কটূক্তি ও ক্ষোভ প্রকাশ করে অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে তিক্ততা বাড়িয়ে চলেছেন। সব মিলিয়ে যেন এক অচলাবস্থার দিকে যাচ্ছিল দুই দেশের সম্পর্ক।
অবশেষে সেই শীতলতার বরফ গলার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ‘তিক্ততা’ ডিঙিয়ে প্রথমবারের মতো বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
গত ৪ মার্চ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনে হওয়া ওই বৈঠক গঠনমূলক ও ফলপ্রসূ হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে এক ধরনের ক্ষোভের জন্ম হয়েছে বাংলাদেশে। গণঅভ্যুত্থানে বিপুল প্রাণহানির সাথে সংশ্লিষ্টতা ও অন্যান্য অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করতে চায় বাংলাদেশ।
এ প্রেক্ষাপটে ইউনূস-মোদি বৈঠকে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ হাসিনাকে ফেরত চেয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব। একই সাথে ভারতে বসে হাসিনা যেসব উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন সে বিষয়েও মোদির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
আর তাতে শেখ হাসিনার বিচারের বিষয়টি আবারও আসছে সামনে। এনসিপি নেতারা শেখ হাসিনার বিচারের আগে নির্বাচন চায় না আগে থেকেই। এরই মধ্যে ইউনূস সরকারের মেয়াদ ৫ বছর চেয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম।
সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে দেশের রাজনীতির মাঠ যখন দ্বিধাবিভক্ত তখন সংস্কার প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান তুলে ধরছে দলটি। বিচার বিভাগ সংস্কারের ২৩টি সুপারিশের ২০টিতে একমত বিএনপি। দুদক সংস্কারের ২০ সুপারিশের ১৯টিতে একমত এবং আংশিক একমত দলটি।
এ ছাড়া জনপ্রশাসন সংস্কারের ২৬ প্রস্তাবের অর্ধেকে একমতে পৌঁছেছে বিএনপি, বাকি বিষয়ে রয়েছে মন্তব্য। বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, সংস্কারের দোহাই দিয়ে নির্বাচন পেছানো দুরভিসন্ধি।
তিনি বলেন, তিনটি বিষয় সমান্তরালভাবে চলতে বাধা নেই। সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে প্রতিপক্ষ ফায়টা লোটার চেষ্টা করছে বলেও মনে করেন বিএনপির এই নেতা।
জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বলেন, রাজনৈতিক দৈন্যের কারণে তারা বলছে বিএনপি সংস্কার চায় না। বিএনপি সংস্কার না চাইলে ঐকমত্য কমিশনের রিপোর্ট জমা দিয়েছে নাকি? বেশির ভাগের সাথেই একমত বিএনপি। কিছু বিষয়ে দ্বিমত থাকবেই, তার জন্য আলোচনা হবে।
কিন্তু যারা বলছে বিএনপি সংস্কার চায় না, সেটি মোটেও ঠিক না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ঘায়েল করতে অমূলক অভিযোগে বিএনপিকে দোষারোপ করা হলে দেড় দশক ধরে রাজনৈতিকভাবে নির্যাতনের শিকার দলটির ওপর জুলুম করা হবে বলে মনে করেন বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের এই নেতা।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, আমরাও চাই গণহত্যার দায়ে সর্বোচ্চ সাজা হোক শেখ হাসিনার।
বিচার হতে কত সময় লাগে আমি আইনজীবী হিসেবে বেশ ভালোই জানি। আপনারাও নিশ্চই জানেন। স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য বিচারে তাড়াহুড়া করা যায় না। দ্রুত বিচারের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যায় তা সরকার করুক তাতে তো কোনো আপত্তি নেই। সংস্কার হোক সেটা আমরাও চাই। একটি পক্ষ প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে বিএনপি সংস্কার চায় না।
তিনি বলেন, আমরা সংস্কার না চাইলে ঐকমত্য কমিশনে যে রিপোর্ট জমা দিলাম সেগুলো কিসের? যারা এসব বলে তারা হয় রাজনীতি বুঝে না, না হয় মিথ্যের ওপর ভর করে এগিয়ে যেতে চায়। সেটা তো সম্ভব নয়।
ভোটে আপত্তি কোথায়? বেশি সময় নিলে কি সব ভোট তাদের হয়ে যাবে? সময় যত বেশি যাবে তাতে করে দেশে তত অস্থিরতা বাড়বে। গণতন্ত্র ঝুঁকিতে পরবে। দেশের মানুষ ভোট চায়। শুধু বিএনপির চাওয়া নয় নির্বাচন।
আপনার মতামত লিখুন :