ঢাকা শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান

আইজিপি হওয়ার খায়েশে দমন-পীড়নে মরিয়া ছিলেন

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: আগস্ট ৩১, ২০২৪, ১২:৪২ এএম

আইজিপি হওয়ার খায়েশে দমন-পীড়নে মরিয়া ছিলেন

ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: পুলিশে নিয়োগ, বদলি এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে ঘুষ বাণিজ্য চালিয়ে শত শত কোটি টাকা আয় করেছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান। মহাক্ষমতাধর পুলিশ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান সাভার, গাজীপুর এবং কেরানীগঞ্জে জমি ও মার্কেট দখল, চাঁদাবাজি, বেনামে ব্যবসা এবং মামলার মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিপুল সম্পদ সংগ্রহ করেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এলাকার লোক ও আস্থাভাজন হওয়ার কারণে তিনি সবসময় গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল ছিলেন। এ ছাড়া পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ পদ আইজিপি হওয়ার খায়েশ ছিল হাবিবের। যেকোনো বিরোধীদল দমন-পীড়নে ও সবশেষ ছাত্র-জনতার যৌক্তিক আন্দোলনে গুলি-হামলা চালিয়ে থামাতে চেয়েছিলেন বলে একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এতে বলা হয়, ঢাকা জেলার ধামরাই উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দা সাজিয়ে এক হাজার লোককে পুলিশের কনস্টেবল পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এই নিয়োগ হয়েছে ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের ৩১ অক্টোবরের মধ্যে। নিয়োগপ্রাপ্তদের অধিকাংশের বাড়ি ছিল গোপালগঞ্জ ও তার আশপাশের এলাকায়। বড় ধরনের এসব জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন পতিত শেখ হাসিনা বা গোপালগঞ্জের পুলিশ বলে পরিচিত সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। হাবিবুর রহমান নিজেও গোপালগঞ্জের বাসিন্দা।

জানা যায়, জালিয়াতি করে সে সময় এক হাজার কনস্টেবল নিয়োগ দেওয়ার সময়ে তিন পুলিশ কর্মকর্তা ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তারা হলেন ইকবাল বাহার, মিজানুর রহমান ও হাবিবুর রহমান। এরা পুলিশ বাহিনীতে ‘আওয়ামীপন্থি’ বলে পরিচিত ছিল।

গত সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের পুরোটা সময় ধরে পুলিশ বাহিনীতে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী হাবিবুর রহমান রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাটি একটি জেলার করে ফেলেছিলেন। পুলিশে ছিল ‘ব্র্যান্ড গোপালগঞ্জ’। এই ব্র্যান্ডের মধ্যে কিশোরগঞ্জ, শরীয়তপুর, ফরিদপুর ও মাদারীপুরের বাসিন্দারাও ছিলেন।

গত সাড়ে ১৫ বছরের পুলিশের যত নিয়োগ হয়েছে তার একটি বড় অংশ গোপালগঞ্জের বাসিন্দা। এর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ এবং দলটির অঙ্গ সংগঠনের সদস্য। বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নে বিশেষ একটি সিন্ডিকেট করে গোপালগঞ্জের বাসিন্দাদের জালিয়াতের মাধ্যমে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন জেলার কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব নিয়োগ বিশেষ এজেন্ডার পাশাপাশি হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। আর এটি হয়েছে তৎকালীন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের যোগসাজশে।

সর্বশেষ শেখ হাসিনার পতনের আগ পর্যন্ত পুলিশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার ছিলেন হাবিবুর রহমান। ডিএমপি কমিশনার গোপালগঞ্জের হাবিব, আর এই কারণে ঢাকার ৫০টি থানার মধ্যে ২৫ থানায় গোপালগঞ্জের ওসি ও পরিদর্শক কর্মরত ছিল। ফরিদপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর এলাকার রয়েছেন, ১০ জন ওসি। পাশাপাশি মেহেরপুর, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, ময়মনসিংহ, হবিগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর এলাকার রয়েছেন, ৯ জন।

খুলনা, বাগেরহাট, মাগুরার ৫ জন। বাকি অন্য ওসি ও পরিদর্শকরা বিশেষ অঞ্চলের বাইরের হলেও তাদেরও রয়েছে রাজনৈতিক পরিচয়। তাদের অনেকেই ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা। ছাত্রজীবনে কেউ কেউ সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন।

দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে একটি জেলার বাসিন্দারা যদি ৫০টি মধ্যে ২৫ থানা দখলে রাখে তাহলে বাহিনীটিকে কিভাবে কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন হাবিবের গোপালগঞ্জ সিন্ডিকেট? এমন প্রশ্ন যোগ্য অথচ বঞ্চিত পুলিশ সদস্যরা। ঢাকার থানাগুলোয় গোপালগঞ্জের পুলিশ পোস্টিং দিয়ে প্রতি মাসে বস্তায় কোটি কোটি মাসোহারা নিতেন হাবিব।

গোপালগঞ্জে ওসি হলে কমিশনার হাবিব সরাসরি ঘুষের মাসোহার নিতে স্বস্তিবোধ করতেন এমন বলেছেন একাধিক ওসি।

জানা গেছে, হাবিবুর রহমান ডিএমপি কমিশনার থাকাবস্থায় বিরোধীদল বা ভিন্নমতকে দমনে নিজের সর্বোচ্চটাই দিয়েছেন। আইজিপি হওয়ার খায়েশে শেখ হাসিনাকে তুষ্ট করতে এমনটাই করেছিলেন তিনি। হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জন করলেও সুকৌশলে বিদেশে পাচার করেছেন এবং দেশে বিভিন্ন ব্যক্তির করে রেখেছেন।

পুলিশ সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে এবং তার আগের দফায় পুলিশে নিয়োগের ক্ষেত্রে গোপালগঞ্জসহ কয়েকটি জেলাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক বলয়ের কল্যাণে এবং ছাত্রলীগের ‘সনদ’ থাকলেই চাকরি হয়ে যেত। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), অতিরিক্ত আইজিপি, উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি), অতিরিক্ত ডিআইজি, পুলিশ সুপার (এসপি), অতিরিক্ত এসপি, ইন্সপেক্টর (পরিদর্শক), সাব-ইন্সপেক্টর (উপপরিদর্শক), অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্ট (সহকারী উপপরিদর্শক) থেকে শুরু করে কনস্টেবল পদেও নিয়োগের ক্ষেত্রে গোপালগঞ্জের দাপট ছিল। এই সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা ছিলেন হাবিবুর রহমান।

সূত্র জানায়, নিজেকে ক্লিন ইমেজে ধরে রাখতে অত্যন্ত সতকর্তার সঙ্গে অপরাধ কর্মকাণ্ডে পরিচালনা করতেন হাবিবুর রহমান। সামাজিক কাজে নিজেকে জড়িয়ে রাখতেন। গণমাধ্যমকেও বশে রাখতেন নানা কায়দায়, শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে ওঠাবসা বা নিয়মিত মজমা বসাতেন।

সাংবাদিকদের একটি গ্রুপকে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দিতেন। যদি কোনো সাংবাদিক বা গণমাধ্যম তার বিরুদ্ধে নেগেটিভ সংবাদ প্রকাশ বা প্রচার করতেন তবে তাদের ওপর খড়গ নেমে আসত। নানাভাবে হয়রানি করা হতো। পুলিশে নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে হাবিবের সংশ্লিষ্টতার তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রচার করতে পারেনি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল।

সেসময় হাবিব গংদের নাম বাদ দিয়ে কাটছাঁট করে পুলিশের নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে সংবাদটি প্রচার করেছিলেন সংশ্লিষ্ট সেই সাংবাদিক জানিয়েছেন।

হাবিবের সম্পদের ঝলক: রাজধানীর শান্তিনগরের সান টাওয়ারের আইএসপি প্রতিষ্ঠান অন্তরঙ্গ। এতে বিনিয়োগ রয়েছে- সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের। গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে, ইন্সপেক্টর নাজমা আক্তারের মাধ্যমে যুক্ত হন তিনি। আসাদুজ্জামান-নাজমা দম্পতির চট্টগ্রামের গাড়ি ব্যবসারও আসল মালিক হাবিবুর রহমান। সাভার বাসস্ট্যান্ডের রূপকথা মার্কেট দখলেরও অভিযোগ রয়েছে হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে। পুলিশের মাধ্যমে দখল নিয়ে ভাড়া তুলছিলেন তিনিই। সাভারের বেদেপল্লিতে চাঁদাবাজির অভিযোগ মিলেছে তার বিরুদ্ধে। কবরস্থান করার নামে জোর করে জমি কিনেছেন হাবিব। তিনি পালানোর পর গার্মেন্টেস ওয়াশিং প্লান্টটি বেদখল হয়েছে। 

পুলিশ সদরদপ্তরের অভিযোগ, ডিসি হেডকোয়ার্টার্স থাকাকালে প্রথমবার ১৭৫ কোটি ও দ্বিতীয় দফায় ৭৫ কোটি ঘুষ নিয়ে জনবল নিয়োগ দিয়েছেন। এ ছাড়া, বদলি এবং পদন্নোতি বাণিজ্যও করেছেন। 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রতারণার মাধ্যমে তিনি নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। তিনি কিন্তু এগুলো এককভাবে করেছেন, এমন নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, নামে-বেনামে করেছেন। এর সঙ্গে যোগসাজশ অনেকেই রয়েছেন। হাবিবুর রহমান ডিএমপিতে ডিসি হেডকোয়ার্টার্স, এসপি ঢাকা, ডিআইজি ঢাকা, ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান এবং ডিএমপিতে কমিশনার পদে ছিলেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১৩ আগস্ট পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানকে অবসর দেওয়া হয়। দীর্ঘ তিন বছর ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে তিনি অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে ট্যুরিস্ট পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন হাবিবুর রহমান। এরপর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ৩৬তম কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পেশাগত জীবনে তিন বার বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) এবং দুবার প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদকে (পিপিএম) পেয়েছিলেন।

পুলিশ সূত্র জানায়, বর্তমানে পুলিশের সদস্যসংখ্যা দুই লাখের বেশি। এর মধ্যে ১৬ বছরে নিয়োগ হয়েছে এক লাখের বেশি। এর আগে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসে। তখনো পুলিশে নিয়োগ হয়েছে।

বর্তমানে বাহিনীতে অতিরিক্ত আইজিপি আছেন (সুপার নিউমারারিসহ) ৩২ জন, ডিআইজি আছেন ৮৫ জন, অতিরিক্ত ডিআইজি আছেন ৩৪০ জন, এসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তা আছেন ৭৪৩ জন। বর্তমানে পুলিশে ক্যাডার কর্মকর্তা ৩ হাজার ১২৪ জন। নন-ক্যাডারের সদস্য ১ লাখ ৯৯ হাজার ৫২৮ জন। ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল ও ময়মনসিংহ রেঞ্জ,  ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, রংপুর মহানগর পুলিশ, পুলিশ সদর দপ্তর, বিশেষ শাখা (এসবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি সারদা, পুলিশ স্টাফ কলেজ, রেলওয়ে পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট, পিবিআই, ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌপুলিশ, মেট্রোরেল পুলিশ ইউনিট ও পিটিসি ইউনিটে পুলিশ সদস্যরা কর্মরত আছেন।

পুলিশে এমন অভিযোগ আছে, জেলাভিত্তিক কোটা থাকলেও গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জসহ বিশেষ অঞ্চলকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এসব কর্মকর্তার কারও কারও বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও নারীঘটিত অপকর্মেরও অভিযোগ আছে।

আরবি/জেডআর

Link copied!