ঢাকা শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

টিপু-সালমান সিন্ডিকেটে হাজার কোটি লোপাট

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১, ২০২৪, ০৩:৩০ এএম

টিপু-সালমান সিন্ডিকেটে হাজার কোটি লোপাট

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

*টিসিবির পণ্য লুট ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে চাঁদাবাজি
*প্রশ্নে ফিরোজ চুপ থাকছেন, ফের তিন দিনের রিমান্ডে

রিমান্ডে থাকা ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগে প্রভাবশালী নেতা টিপু মুনশি এবং স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা বেক্সিমকোর মালিক সালমান এফ রহমান মিলে সিন্ডিকেট গড়ে তুলে হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থ লোপাট করার তথ্য দিয়েছেন। পাশাপাশি বাণিজ্যমন্ত্রী থাকাবস্থায় টিসিবি পণ্য লুটসহ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়েও তথ্য দিয়েছেন। অন্যদিকে, সাবেক চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজের ফের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। প্রথম দফার রিমান্ডে ফিরোজ নিজের দোষ প্রথামত অপর নেতাদের ন্যায় অন্যদের ঘাড়ে চাপাচ্ছেন।

রাজধানীর বাড্ডা থানার সুমন সিকদার হত্যা মামলায় সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বর্তমানে চার দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার পুলিশের পক্ষ থেকে আট দিনের রিমান্ড আবেদন করা হলে আদালত চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে গত বুধবার রাতে রাজধানীর গুলশান-১ থেকে টিপু মুনশিকে আটক করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। পরে এ মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, তিস্তা নদীর তীরে দেশের বৃহত্তম সোলার প্যানেল তিস্তা সোলার লিমিটেড গড়ে তুলেছেন বেক্সিমকোর সালমান এফ রহমান। তিস্তা পাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। সে সময় ৬৫০ একর জমি সরকারি মূল্যে ক্রয়ের কথা থাকলেও স্থানীয়দের ভয়ভীতি দেখিয়ে রংপুর-৪ আসনের এমপি ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সহযোগিতায় সিন্ডিকেট করে অসহায় চরবাসীর কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে হাতিয়ে নেওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদে টিপু মুনশি এসব বিষয়ে অনেক তথ্য দিয়েছেন। প্রাপ্ততথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

জানা গেছে, তিস্তাচরের বাসিন্দাদের ৬৫০ একর জমি ছাড়াও নদীর অববাহিকায় গতিপথ পরিবর্তন করে আরও কয়েকশ’ একর জমি লিজ নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে তিস্তা সোলার লিমিটেড। কাগজে-কলমে প্রকল্পের আয়তন ১০০০ একর বলা হলেও প্রকৃত অর্থে এখানে জমির পরিমাণ ১৬০০ একরেরও বেশি। এ সকল জমি স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং তাদের ওই কোম্পানিতে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে স্বল্প মূল্যে ও জোরপূর্বক দখল করা হয়েছে।

তিস্তা সোলার লিমিটেড বেক্সিমকোর মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠান, যার চেয়ারম্যান দেশের ব্যাংক লুটের মূল হোতা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর  উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। টিপু ও সালমান রহমানের যৌথ সিন্ডিকেট করে প্রতিষ্ঠা করে এ প্রতিষ্ঠান। সাব ঠিকাদার হিসেবে অনেকেই প্রতিষ্ঠানটির জন্য মালামাল ও জনবল সংগ্রহ করলেও পরবর্তীতে তাদের ঠিকভাবে টাকা দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ।

৫ আগস্ট হাসিনা দেশ ত্যাগের পর একে একে আত্মগোপনে চলে যায় তার দলের শীর্ষ স্থানীয় সব নেতা-এমপি-মন্ত্রীরা। একের পর এক মামলা হলে ছদ্মবেশে দেশ ত্যাগ করার সময় আটক হন আলোচিত সালমান এফ রহমান। এর পর থেকেই বেরিয়ে আসতে থাকে চাঞ্চল্যকর সকল তথ্য। অন্যদিকে ২৮ আগস্ট রাজধানীতে র‌্যাবের অভিযানে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসতে শুরু করে তাদের সিন্ডিকেটের সব রহস্য। বর্তমানে তিস্তা সোলার পাওয়ার প্লান্টিতে কাজ করা অনেক কর্মী চলে গেছেন।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আপাতত কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মী দ্বারা এ পাওয়ার প্লান্ট পরিচালনা করা হচ্ছে।
টিপু মুনশি যেভাবে হাজার কোটি মালিক ক্ষমতার দাপটে শুধু বিরোধী দল নয়, নিজ দলের নেতা-কর্মীদেরও কোণঠাসা করে রেখেছিলেন ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। দখল, চাঁদাবাজি আর টিসিবির পণ্য লুট করে কামিয়েছেন হাজার কোটি টাকা। এমন মুনশিয়ানা দেখিয়েই স্থানীয়দের জায়গা দখল করেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতা টিপু মুনশি।

গোপালগঞ্জের বাসিন্দা টিপু মুনশি এক সময় পরিবার নিয়ে চলে যান রংপুরে। সদরের পীরগাছায় টিনের চালা ঘরে শুরু করেন বসবাস। একপর্যায়ে জড়িয়ে পড়েন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ম্যাজিকের মতোই পাল্টে যায় তার জীবন।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে প্রথমবারের মতো হন সংসদ সদস্য। এরপর থেকেই রংপুরে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন টিপু মুনশি। ২০১৪, ১৮ ও ২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে হন সংসদ সদস্য।

দু’দফায় বসেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চেয়ারে। পীরগাছায় ক্যাডার বাহিনী তৈরি করে চাঁদাবাজি আর জমি দখলে মুর্তিমান আতঙ্ক হয়ে ওঠেন টিপু মুনশি। টিসিবিরি পণ্য কেনার নামেও চালাতেন কমিশন বাণিজ্য।

প্রভাব খাটিয়ে নগরীর নবদীগঞ্জ ও মধুপুরে তৈরি করেছেন দুটি বিশাল কোল্ড স্টোরেজ। স্থানীয়দের জমি দখল নিয়ে ছেলে অপু মুন্সির নামে গড়েছেন ক্যানসার হাসপাতাল। নগরজুড়ে নামে-বেনামে কিনেছেন বেশ কয়েকটি ফ্লাট। ঢাকায় প্লট-ফ্লাট ছাড়াও বিদেশে আছে বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

স্থানীয়রা জানান, টিপু মুনশি রংপুরের বিভিন্ন এলাকায় জমি দখল করেছেন। রংপুর-৪ আসনের জনগণ কখনওই তাকে ভোট দেয়নি, সে নিজেই নিজেই নির্বাচিত হয়েছেন।বিরোধী মতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়াতেও টিপু মুনশি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।

এলাকাবাসীরা জানান, দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। টিপু মুনশি গ্রেপ্তার হওয়ায় উল্লসিত এলাকার মানুষ। তার অবৈধ সম্পদ জব্দ করাসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তাদের।

এদিকে, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, তার স্ত্রী আইরিন মালবিকা মুনশি, মেয়ে তানিয়া অনন্যা মুনশি ও তৃষা মুনশির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। একই সঙ্গে তাদের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করা হয়েছে। টিপু মুনশি ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-৪ আসন থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে পরাজিত হয়েছিলেন। ২০২৪ এ নতুন মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন তিনি।

সাবেক হুইপ আ স ম ফিরোজ ফের তিনদিনের রিমান্ডে রাজধানী ভাটারা থানা এলাকায় সোহাগ মিয়া নামে এক কিশোরকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে করা মামলায় সাবেক চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজের ফের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল শনিবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলামের আদালত শুনানি শেষে এ আদেশ দেন। এদিন সাত দিনের রিমান্ড শেষে তাকে আদালতে হাজির করা হয়। এরপর মামলার রহস্য উদঘাটনে তাকে ফের ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিদর্শক মাসুদুর রহমান।

এ সময় আসামিপক্ষ তার রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে আবেদন করেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত তার ফের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ মামলার রিমান্ড শুনানিতে ফিরোজ বলেছেন, আমি জনতার ভোটে নির্বাচিত হয়েছি। আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলকে সমান সম্মান করেছি। ৪৬ বছরের সংসদ সদস্য হয়ে কখনো কারোর বিরুদ্ধে মামলা করিনি। এ মামলার ঘটনা সম্পর্কে জানিনা, আমি অসুস্থ।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, প্রথম দফার রিমান্ডে ফিরোজ জিজ্ঞাবাসাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। গোয়েন্দাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে অন্যান্য নেতা প্রভাবশালীদের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন। তবে, আয়ের অনুকূলে অস্বাভাবিক সম্পদের বিষয়ে জানতে চাইলে চুপ থাকছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল শত শত কোটির মালিক আ স ম ফিরোজকে দুদক ইতোমধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে দমন পীড়নসহ গত সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈশাসনের ফিরোজের সংশ্লিষ্টতার আরো তথ্য পেতে গোয়েন্দারা দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে নিয়েছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই বিকেলে ভাটারা থানাধীন ফরাজী হাসপাতালের সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সোহাগ মিয়া। এ ঘটনায় ২০ আগস্ট তার বাবা শাফায়েত হোসেন ভাটারা থানায় হত্যা মামলা করেন। এ মামলায় গত ২৩ আগস্ট রাতে ঢাকার বনানী এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন ২৪ আগস্ট আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে আদালত সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

আরবি/জেডআর

Link copied!