ঢাকা শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

মনিরুলের আইজিপি হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২, ২০২৪, ০৪:৪১ এএম

মনিরুলের আইজিপি হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার

মো. মনিরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

*জঙ্গি নাটক সাজানোর অভিযোগ
*শ্যালক শাহীনের নামে সম্পত্তি
*বাজারের ব্যাগে করে ঘুষের টাকা যেত
*ভায়রা এসপি শফিকুলের যত অপকর্ম
*ছিল স্থায়ী দুই রক্ষিতা
*গ্রেপ্তার আতংকে আত্মগোপনে

সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত আস্থাভাজন ও ঘনিষ্ঠ ছিলেন শীর্ষস্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম। ছিলেন একই জেলার বাসিন্দা। সেই সুবাধে বিগত ১৫ বছরে তৎকালীন সরকারপ্রধানের গুডবুকে ছিলেন এই প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা। সরকারের চাওয়া অনুযায়ী সব ধরনের কাজ করে আসছিলেন তিনি। ফলে একের পর এক পদোন্নতি পেয়ে সবশেষ পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি হয়েছিলেন মনিরুল। এর আগে ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের সিটিটিসি ও ডিবিপ্রধান। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার সময় পুলিশপ্রধান (আইজিপি) হওয়ার খসড়া তালিকায় নাম ছিল গোপালগঞ্জের বাসিন্দা মনিরুলের।

ওই সময় হতে না পারলে আগামী বছর পুলিশপ্রধান হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন তিনি। কিন্তু ছাত্র-জনতার তুমুল গণআন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দোসর হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এর মাধ্যমে তার আইজিপি হওয়ার স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়Ñ এমনটাই জানিয়েছেন খোদ পুলিশ কর্মকর্তারা। এদিকে মনিরুলের বিরুদ্ধে কিছু ক্ষেত্রে জঙ্গি নাটক সাজানোর অভিযোগও পুরোনো।

বিষয়টি নিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারসহ বিএনপি ও জামায়াতের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে।

অন্যদিকে প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী হয়ে মো. মনিরুল ইসলাম ঘুষ, নিয়োগ, টেন্ডার ও গ্রেপ্তার বাণিজ্য, কেনাকাটা, নারী কেলেঙ্কারির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা মালিক বনে গেছেন।

ক্ষমতার শিখরে থেকে কীভাবে দুর্নীতি এবং অপরাধকে শিল্পে রূপ দিতে তার বড় উদাহরণ পুলিশের সাবেক এই প্রভাবশালী কর্মকর্তা। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ট সহচর হিসেবে চাকরিচ্যুত পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান কর্মকর্তা অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. মনিরুল ইসলামের পরিবার এবং ঘনিষ্টদের দিয়ে সিন্ডিকেট করে দীর্ঘদিন ধরে সরকারি চাকরির ফায়দা নিয়ে এসব অপকর্ম করে গেছেন তিনি। শ্যালক শাহীনের মাধ্যমে ঘুষ অবৈধ্য সম্পদ অর্জন করে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ব্যবসা খুলে বসেছেন। ভায়রা পুলিশের এসপি শফিকুলের অপকর্মের মূলহোতা ছিলেন মনিরুল ইসলাম।

বাজারের ব্যাগে ভরে ঘুষের টাকা মনিরুলের বাসায় যেত এমন তথ্য পাওয়া গেছে একাধিক সূত্রের কাছ থেকে। এমনকি ঢাকায় তার স্থায়ী দুই রক্ষিতা ছিল। তাদেরও গাড়ি-বাড়ি-টাকা এবং অবৈধ সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন। রক্ষিতাদের বাসায় নিয়মিত পার্টির আয়োজন করতেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনের পাশাপাশি গত ১৬ বছর বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দমন-পীড়নের নামে বেপরোয়া ছিলেন মনিরুল।

সরকারের আস্থাভাজন হয়ে ওঠতে এসব অপরাধে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এতে কপাল খুলে যায় তার। হয়ে উঠেন মহাপরাক্রমশালী পুলিশকর্তা। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন। আত্মীয়-স্বজনদের নামে গড়ে তোলেন হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। দেশে-বিদেশে মনিরুলের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের খোঁজ মিলেছে। ইতিমধ্যে সরকারের একাধিক সংস্থা মনিরুল ইসলামের অবৈধ সম্পদ এবং অন্যান্য অপরাধের বিষয়ে তদন্ত চালাচ্ছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট গঠনে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন মনিরুল। এ ইউনিটের প্রধান হিসেবে তিনি পরবর্তীতে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান ছিলেন অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মনিরুল ইসলাম। সেখান থেকেই তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শেষের দিকে পুরোটা সময় মনিরুল পুলিশ সদর দপ্তর ও ডিএমপির কন্ট্রোলরুমে কাটিয়েছেন।

৫ আগস্ট পুলিশ সদর দপ্তরে অবস্থানকালে জনতার হামলার সময় অন্যান্য ঊর্র্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নিলেও বর্তমানে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন।

সূত্র জানায়, মনিরের নিজস্ব একটি সিন্ডিকেট ছিল। যেই সিন্ডিকেটে সাবেক মহানগর গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশীদ, মনির, সারোয়ার নজরুলসহ একাধিক কর্মকর্তা ছিলেন। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পুলিশের পোস্টিং, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঘুষ, চাঁদাবাজি, টেন্ডার ও গ্রেপ্তার বাণিজ্য চালিয়েছেন।

মনিরুলের ছিল স্থায়ী দুই রক্ষিতা। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় এক চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। সম্প্রতি তিনি এক নির্মাতাকে ঘটা করে বিয়ে করেন। এই অভিনেত্রীকে মনিরুল বেইলি রোডে একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছেন। যেখানে মনিরুল নিয়মিত অবকাশ যাপন করতেন। আরেকজন বতর্মান সময়ের খ্যাতিমান বিজ্ঞাপন নির্মাতা এবং টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র পরিচালকের সাবেক স্ত্রী এবং অভিনেত্রী। কয়েক কোটি টাকা খরচ করে এসবিপ্রধান মনিরুলের নিজস্ব অফিস ও মিটিংরুম সাজিয়েছিলেন।

সূত্র জানায়, ঢাকায় একজন বিদেশি হত্যার ঘটনায় এক বিএনপি নেতা এবং তার পরিবারের কাছ থেকে কয়েক কোটি হাতিয়ে নেন দাপুটে পুলিশ কমর্কর্তা মনিরুল ইসলমা। এই টাকা বিদেশে বসে ডলারে করে নেওয়ার মুহূর্তের ভিডিও ফুটেজ দেশের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে রয়েছে। জঙ্গিসহ বিভিন্ন মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার নামে ব্যবসায়ী এবং বিরোধীদলের নেতাদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতেন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। মনিরুল সিন্ডিকেট টাকা লেনদেন করতেন ডলার, গ্রহণ করতেন বিদেশে।

আরেকটি সূত্র জানায়, বৈষম্যবিরোধীদের আন্দোলন দমন-পীড়নের কাজে খরচের জন্য গণভবন থেকে সর্বশেষ গত ৪ আগস্ট সকালে প্রায় ২৫ কোটি টাকা আনেন এই মনিরুল। পুরো টাকাটাই তার এসবি অফিসের নিজ কক্ষে রাখা ছিল। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালানোর পর মনিরুল আর অফিস করেননি। এসবি সূত্র জানায়, এ সময় এসবিতে কর্মরত তার হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে পরিচিত দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পুরো টাকাটাই গায়েব করে দেন। গত ৪ আগস্ট গণভবন থেকে ২৫ কোটি টাকা ছাত্র আন্দোলন দমাতে প্রণোদনা হিসেবে এসবির ডিউটিরত সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করতে এ টাকা আনেন মনিরুল। এসবির এসএস (অর্থ) এবং এসবিপ্রধানের স্টাফ অফিসার পুরো বিষয়টি জানতেন। এসবির অতিরিক্ত ডিআইজিকে (প্রশাসন ও অর্থ) তারা বিষয়টি জানালে তিনজন মিলে সব অর্থ আত্মসাৎ করার সিদ্ধান্ত নেন।

গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট আছে অজুহাতে এই টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এসবিপ্রধানের অফিস কক্ষ, তার বেইলি রোডের বাসা এবং সিটি এসবির ডিআইজি অফিসে তারা তিনজন তালা লাগান। ৬ আগস্ট এসবি কার্যালয়ের সব সিসিটিভি ও ডিশ লাইন কেটে দেন। ৬ আগস্ট থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত এই সময়ের ভেতর এসবিপ্রধান মনিরুলের দপ্তরে রাখা ২৫ কোটি টাকা তিনজন মিলে আত্মসাৎ করেছেন।

জঙ্গি অভিযান নাটকের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীতে নাম ছড়িয়ে পড়ে মনিরুলের। এ সময় তার প্রধান ও বিশেষ সহযোগী হিসেবে ছিলেন সাবেক কাউন্টার টেরোরিজম (সিটিটিসি) প্রধান এবং অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান ও পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অ্যাডমিন) পদে দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা। মনিরুলের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থানার বাহাড়া গ্রামে। মনিরুলের বড় ছেলে ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করছেন এবং ছোট মেয়ে কানাডায়। তার স্ত্রী সংশ্লিষ্ট এক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব পদে কর্মরত।

মনিরুলের শ্যালক শাহীনের আঙুল ফুলে কলাগাছ: সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলামের শ্যালক এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সায়লা ফারজানা শিউলির ভাই রেজাউল আলম শাহীন বোন-দুলা ভাইয়ের ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়েই তিনি বিপুল সম্পদ ও সম্পত্তি গড়েছেন। সূত্রমতে, এসব সম্পদ মনিরুল এবং তার স্ত্রীর। শাহীন নিজের নামে ঢাকায় অন্তত ৭টি ফ্ল্যাট কিনেছেন। স্ত্রীর নামে কিনেছেন বাড়ি।

১৫ বছর আগেও গ্রামে যে টিনের ঘর ছিল সেটিকে এখন বানিয়েছেন বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি।

ভায়রা এসপি শফিকুলের যত অপকর্ম: গাজীপুরের সদ্য সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) কাজী শফিকুল আলমের বিরুদ্ধে অর্থের বিনিময়ে জমি দখল করে দেওয়া, বালু ব্যবসা, পোস্টিং বাণিজ্য, মাদক ব্যবসায়ীদের আশকারা দেওয়া, ওসির কাছ থেকে ঘুষ নেওয়া এবং ঝুট ব্যবসাসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ। তিনি এসপি থাকাকালীন পাড়া-মহল্লার অলিতে-গলিতে মাদকের বিস্তার ঘটে। দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহার করাই ছিল যার নেশা। একদিকে বাড়ি গোপালগঞ্জ এবং অন্যদিকে এসবির সাবেক প্রধান (অতিরিক্তি আইজিপি) মনিরুল ইসলামের ভায়রা ভাই। তাকে আর ঘাঁটায় কে। যে কারণে অসীম ক্ষমতার দম্ভে তিনি কাউকে পরোয়া করতেন না। সম্প্রতি তাকে ময়মনসিংহের ডিআইজি অফিসে সংযুক্ত করা হয়েছে।

আরবি/জেডআর

Link copied!