রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্প চৌদ্দ বছর পার হলেও কাগজে কলমেই রয়ে গেছে। দফায় দফায় বাজেট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। মেয়াদ বেড়ে হয়েছে ছাব্বিশ সাল পর্যন্ত। কিন্তু প্রকল্পটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
তাই নয়, শুধু নকশা প্রণয়ন ছাড়া প্রাথমিক কাজটুকুও শুরু করতে পারেনি রাজউক। ফলে যানজট নিরসন এবং নাগরিক সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি পরিবেশগত উন্নয়নের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যায়। তবে রাজউক সূত্রের দাবি, বাড্ডা অংশের ভূমি অধিগ্রহণের কাজ এরইমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
২০১০ সালের জুলাই মাসে প্রকল্পটি হাতে নেয় রাজউক। ২ কোটি টাকা ব্যয়ে নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। ব্যয়-বরাদ্দ ধরা হয় ৪১০ কোটি ২৫ লাখ টাকা। তাতে সরকারের অর্থায়ন ৩১৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। রাজউকের নিজস্ব অর্থায়ন ৯৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। মেয়াদকাল ধরা হয় ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত।
এরপর প্রথম দফায় সংশোধন করার পর প্রকল্পের ব্যয়-বরাদ্দ দাঁড়ায় ৫৫৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এতে রাজউকের অর্থায়ন বরাদ্দ হয় ২৩৯ কোটি ২৩ লাখ টাকা, মেয়াদকাল ধরা হয় ২০২২ সাল পর্যন্ত। এ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিইসি) সর্বশেষ সভা হয় ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর।
সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। সভায় ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের প্রস্তাব ওঠে। মাঝখানে ২০১৭ সালের পিইসি সভায় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাস্তবায়ন কাল ধরা হয়েছিল।
২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বৈঠকে প্রকল্প সংশোধনের কারণ হিসেবে রাজউকের পক্ষ থেকে বলা হয়, ৪১০ কোটি ২৫ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরে ২০১০ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পটি একনেকে পাশ হয়। পরে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটির আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেয়।
এরপর প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষে এটি ২০১৮ সালে একনেকে উঠার কথা ছিল। কিন্তু রাজউক এ বিষয়ে নীরবতা পালন করায় কিছুই জানা যায়নি। এ সময়ে গণমাধ্যমে টুকিটাকি লেখালেখি হলে প্রকল্পটির বিষয় ফের সামনে চলে আসে।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ড. ছাবের আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ২০১৮ সালে প্রকল্পটি একনেকের অনুমোদন পায়নি। একনেক পূর্ব কিছু কাজ করার পর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
মন্ত্রণালয় থেকে যাবে পরিকল্পনা কমিশনে। কমিশন ছেড়ে দিলে উঠবে একনেকে। একনেকে পাশ হলে আমরা প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নে হাত দেব। তিনি জানান, এটি করা গেলে বহুমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি নৌ-যোগাযোগ বাড়বে। লেক বাঁচবে দখলের হাত থেকে।
প্রকল্পের বিবরণ : রাজউকের বিভিন্ন সূত্রমতে, প্রকল্পের জন্য মূল ডিডিপিতে ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণ ছিল ৮০ দশমিক ১০ একর।
তবে ২০১৭ সালে পিইসি সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিচালিত বুয়েটের সমীক্ষায় সংশোধিত ডিডিপিতে প্রস্তাবিত জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৮২দশমিক ৫৬ একর। এর মধ্যে কড়াইল বস্তির টিঅ্যান্ডটির রয়েছে ৪৩ একর এবং অন্যান্য মালিকানাধীন ২৫ একরসহ মোট জমির পরিমাণ ৬৮ একর।
কড়াইল বস্তি থেকে উচ্ছেদের পর ৪ হাজার ৭৭৬ কোটি ১১ লাখ টাকা পুনর্বাসন ব্যয় ধরা হয় প্রকল্পের প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবে। এরপর তা পরিকল্পনা কমিশনের ডিডিপিতে পাঠানো হয়।
এদিকে গুলশান-বনানী এলাকার এমআরটি এবং এলিভিটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ফলে বুয়েট সমীক্ষা প্রতিবেদনে প্রকল্পে প্রস্তাবিত ট্রাফিক সিস্টেমও পরিবর্তিত হয়েছে। এ কারণে সমীক্ষা অনুযায়ী সড়ক নেটওয়ার্ক উন্নয়ন করা বাস্তবসম্মত হবে না বলে মত প্রকাশ করা হয়।
এ পরিপ্রেক্ষিতে লেক উন্নয়ন ও পার্শ্ববর্তী সড়ক এবং ফুটপাত উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভূমি অধিগ্রহণ অংশটুকু রেখে কড়াইল বস্তির টিঅ্যান্ডটির জমি এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন অবশিষ্ট জমি বাদ দিয়ে সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্পে যা থাকছে : বুয়েট প্রণীত নকশায় রয়েছে, তিন লেকের দু’পাশে থাকবে সুপ্রশস্ত রাস্তা। পাড় ঘেঁষে থাকবে ওয়াকওয়ে। দু’পাশের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে লেকের ওপর থাকবে ৯টি ব্রিজ ও চারটি ওভারপাস।
যানবাহন যেন সিগন্যালে না পড়ে, সেদিকে লক্ষ্য রেখে ক্রসিংয়ে রাখা হয়েছে ওভারপাস। নকশাটি এমনভাবে প্রণীত হয়েছে যে, যানবাহনগুলো যেদিকে খুশি চলে যেতে পারবে। ফলে একপ্রাপ্ত থেকে অন্যপ্রান্তে দ্রুত পৌঁছানো সহজ হবে।
পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে গুলশান-বনানী-বারিধারা ও বাড্ডা এলাকার যানজট বলতে গেলে থাকবেই না। নকশায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা এমনভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে যে, সব বর্জ্য দাশেরকান্দি সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে গিয়ে পড়বে। এতে করে এসব এলাকার সুয়ারেজ সমস্যার স্থায়ী সমাধান মিলবে।
সর্বশেষ তথ্য : খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, কাটছাঁটের পর প্রস্তাবিত লেক উন্নয়ন প্রকল্পটির ব্যয় বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। পুরো প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।
প্রকল্প পাশ না হওয়ায় জমি অধিগ্রহণের কাজ ঝুলে আছে। তবে রাজউক সূত্র দাবি করেছে, বাড্ডা অংশের জমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পের জন্য অত্যাবশ্যকীয় কড়াইল বস্তিতে দুষ্টচক্র সক্রিয় থাকায় তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে প্রকল্প বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আপনার মতামত লিখুন :