ঢাকা শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে মোস্ট ওয়ান্টেডরা

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৪, ১২:২৭ এএম

এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে মোস্ট ওয়ান্টেডরা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

*হত্যাযজ্ঞে মূল অভিযুক্ত তারা

*দেশ ছাড়তে পারেন যেকোনো সময়

 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের পর ভারতে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসে। ৮ আগস্ট দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ। গত এক মাসে হওয়া হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় হাসিনা সরকারের প্রভাবশালী রাজনীতিক-কর্মকর্তারা এখনো অধরা। গ্রেপ্তার এবং অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলমান থাকলে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের দোসররা এখনো মুক্ত। এসব পলাতক আসামির কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে, আবার অনেকে প্রশাসনের অসাধু সদস্যদের সহায়তায় দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মাদ এ আরাফাত, পুলিশ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান হারুনুর রশীদ ও বিপ্লব কুমার সরকার বিএনপি ছাড়াও আওয়ামী লীগবিরোধী যেকোনো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করাই ছিল তাদের অন্যতম প্রধান কাজ। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলির নির্দেশ দেওয়া এবং বাস্তবায়নে তাদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার এক মাস পূর্ণ হচ্ছে আজ। ইতিমধ্যে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসর প্রভাবশালী রাজনীতিক ও কর্মকর্তাদের এখনো গ্রেপ্তার এবং আইনের আওতায় আসেননি। যদিও আওয়ামী লীগ সরকারের  একাধিক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, দলটির কেন্দ্রীয় নেতা, সরকারের প্রভাবশালী কর্মকতারা গ্রেপ্তার হয়েছেন। গ্রেপ্তার হওয়া এসব রাজনীতিক-কর্মকর্তারা পুলিশের রিমান্ডে রয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।

হাবিবুর রহমানকে সরকার বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠালেও তার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলা হয়েছে, তবু তিনি এখনো গ্রেপ্তার হননি।

আন্দোলনে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে হাসিনা সরকার। আর এই হত্যাযজ্ঞে নেতৃত্ব দেন হাবিব। তাকে সহায়তা করেন হারুন এবং বিপ্লব। হারুন-বিপ্লব এখনো চাকরিতে যোগ দেননি। তারা ৫ আগস্ট থেকেই পলাতক রয়েছেন।এই তিনজনসহ পুলিশের শতাধিক কর্মকর্তা রয়েছেন যারা চাকরিতে যোগ না দিয়ে আত্মগোপনে গেছেন। তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি শহীদ পরিবার এবং আহত ব্যক্তিদের। গুঞ্জন রয়েছে দেশব্যাপী হত্যাযজ্ঞে প্রধান অভিযুক্ত হাসিনার দোসর এই ৬ জন যেকোনো সময় দেশ ছেড়ে পালাতে পারেন।

সারাদেশে শেখ হাসিনা-রেহানা পরিবার এবং সরকারের প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে প্রায় দেড় শতাধিক মামলা হয়েছে। যার অধিকাংশ হত্যা মামলা।

মামলাগুলোয় ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, মোহাম্মাদ এ আরাফাত, পুলিশ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান হারুনুর রশীদ ও বিপ্লব কুমার সরকারসহ হাসিনার দোসরদের নাম রয়েছে। তবু হত্যা মামলার এসব আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সরকারের প্রতিটি গোয়েন্দা সংস্থা এখন কঠোর নজরদারি করছে। যৌথ বাহিনী পলাতক আসামি, সন্ত্রাসী ধরতে এবং খোয়া যাওয়া ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অপারেশন শুরু করেছে। সারাদেশে ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু হওয়া যৌথ অভিযানে গত চার দিনে সাড়ে মেলেনি। গ্রেপ্তার বা অস্ত্র উদ্ধারে তেমন অগ্রগতি নেই বললেই চলে।

এদিকে, রাজনৈতিক মহলের প্রশ্ন উঠেছে, দলের সাধারণ সম্পাদক সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মাদ এ আরাফাতসহ হাসিনা সরকার এবং দলটির শীর্ষ রাজনীতিকরা আত্মগোপনে রয়েছেন। অনেকে গোপনে দেশ ছেড়েছেন। কেউ গ্রেপ্তার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। হাসিনার পর ওবায়দুল কাদের কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই, এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি কঠোর অবস্থান নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দিতে দেখা গেছে তাকে।

এমনকি গণভবনে সবশেষ বৈঠক থেকে বেরিয়ে কারফিউ জারি ও দেখা মাত্র গুলির সিদ্ধান্তের কথাও জানান তিনি।

কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে দলীয় নেতাকর্মী, বিশেষ করে ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে ওবায়দুল কাদের বিরুদ্ধে। দলের নির্দেশনা পেয়ে ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাণ্ডব চালালেও পরে শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে ক্যাম্পাস ছেড়ে পালাতে হয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের। হাসিনার নির্দেশে ওবায়দুল কাদের নেতৃত্বে হত্যাযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। দেশের সবকটি বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে দপন-পীড়ন চালান ছাত্র-জনতার ওপর। প্রায় এক হাজার মানুষকে হত্যা করেন। আহত হয় কয়েক হাজার। কামালের মতো নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেন সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মাদ এ আরাফাত। ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রযুক্তি ও গণমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে দেশ-দেশের মানুষকে অন্ধকারে ধাবিত করেন। কাদের, কামাল, আরাফাতসহ আওয়ামী লীগ সরকার দলে প্রত্যেকেই স্বৈরাচারী হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে দেশজুড়ে হত্যাযজ্ঞ চালান। জনগণের রাজস্ব্যের টাকা চলা সরকার জনগণের ওপর বন্দুকের নলে জীবন কেড়ে নেয়। আর এতে সহায়তা করেন সরকারের অসাধু কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী, যারা হাসিনা সরকারের দ্বারা নানাভাবে লাভবান ছিল।

অন্যদিকে, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার (বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া) গোপালগঞ্জের হাবিবুর রহমান, ডিএমিপর সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবিপ্রধান) আলোচিত-সমালোচিত কিশোরগঞ্জের হারুনুর রশীদ ও যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারসহ পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। ইতিমধ্যে সাবেক আইজিপি একেএম শহিদুল হক এবং চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন গত মঙ্গলবার গ্রেপ্তার হন। বর্তমানে তারা পুলিশি রিমান্ডে রয়েছেন।

গুঞ্জন রয়েছে শেখ হাসিনার এক দিন আগেই দেশ ছেড়েছেন ওবায়দুল কাদের। সূত্রমতে, ৪ আগস্ট বিকেল থেকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক গা ঢাকা দিয়েছেন। ৫ আগস্ট তাকে কোথাও দেখা যায়নি।

সূত্র বলছে, ওবায়দুল কাদের রোববার রাতে দেশত্যাগ করেছেন। তিনি বর্তমানে সিঙ্গাপুর রয়েছেন। তবে অন্য একটি সূত্র বলছে, কাদের বর্তমানে নয়াদিল্লিতে অবস্থান করছেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে লম্বা সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে থাকা আসাদুজ্জামান খান কামাল গত ১০টি বছর যেকোনো বিষয় কিংবা ঘটনা নিয়ে ঠিক এমনভাবেই নির্বাকার ছিলেন। তাকে চ্যালেঞ্জ করা বা প্রশ্ন করার মতো সাহস কারও ছিল না। প্রবল প্রতাপে স্বরাষ্ট্রের মতো সংবেদনশীল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করলেও, তার আমলেই খুন-গুম থেকে শুরু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে নষ্ট হয়েছে দেশের ভাবমূর্তি।

ছাত্র-জনতার দাবির মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগের পর থেকেই গা ঢাকা দেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে আন্দোলনকারীদের প্রতি নির্বিচারে গুলি চালানোর ঘটনায় আসাদুজ্জামনের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি হত্যা মামলা হয়েছে।

শুধু তাই নয়, তাকে হন্য হয়ে খুঁজতে শুরু করে জনতা। গত ১৩ আগস্ট রাতে রাজধানীর গেন্ডারিয়ার এক বাড়িতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উপস্থিতি ‘সন্দেহে’ বাড়ি ঘেরাও করে স্থানীয়রা। দুই কোটি দামের একটি গাড়ি রাস্তায় ফেলে দেন তিনি।

কিন্তু সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোথায় আছেন, সে সম্পর্কে এখনো কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। উত্তেজিত জনতা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর খোঁজে তার ধানমন্ডির বাসভবন ভাঙচুর করে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, আসাদুজ্জামান খান কামাল বর্তমানে দেশেই আছেন। শেষ মুহূর্তে শত চেষ্টা করেও দেশ ছাড়তে পারেননি। শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর জানতে পেরে অজ্ঞাত স্থানে চলে যান তিনি। তবে, তিনি ঠিক কোথায় আছেন জানা যায়নি। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ। একদা প্রবল প্রতাপশালী ব্যক্তিটি এখন পলাতক আসামি।

অন্যদিকে, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত গত ২৭ আগস্ট আটক হয়েছেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়লেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল কেউ এর সত্যতা নিশ্চিত করেননি। তিনি নাকি আটক নন, তা নিয়ে সৃষ্টি হয় ধূম্রজাল। এ ছাড়া গত ১৪ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, আরাফাত ঢাকায় ফরাসি দূতাবাসে লুকিয়ে রয়েছেন।

পরে অবশ্য দূতাবাস জানায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব প্রচার করা হচ্ছে। এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। বর্তমানে আরাফাত দেশের ভেতরে লুকিয়ে রয়েছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন।

এ ছাড়া আলোচিত তিন কর্মকর্তা সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিবিপ্রধান হারুনুর রশীদ যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার দেশ ছেড়ে পালাতে পারেননি। তারা দেশের ভেতরে লুকিয়ে রয়েছেন। তবে গুঞ্জন রয়েছে তারা তিনজনই গোয়েন্দা সংস্থার হেফাজতে রয়েছেন। তাদের পুলিশে দিয়ে যেকোনো সময় গ্রেপ্তার দেখানো হবে। সূত্রমতে গত ৫ আগস্ট পুলিশ সদর দপ্তরে ছিলেন এই তিন পুলিশ কর্মকর্তা সেখান থেকেই তারা পালিয়ে যান হেলিকপ্টারে করে, আবার কেউ বলছেন তারা দেয়াল টপকিয়ে সিটি করপোরেশন ভবনের পেছন দিয়ে গাড়িতে করে সাদা পোশাকে পালান।

আরবি/জেডআর

Link copied!