*‘নখদন্তহীন’ দুদকের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা
*প্রাথমিক তালিকায় পুলিশ কর্মকর্তা ও আমলাসহ ১৫০ প্রভাবশালীর নাম
*সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের অর্থপাচারের অভিযোগে অনুসন্ধানে কোন কোন দেশে কার কী পরিমাণ সম্পদ ও টাকা পাচার হয়েছে সেগুলোর খোঁজ নেওয়া হচ্ছে------দুদক সচিব
টানা সাড়ে ১৫ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। দীর্ঘ ওই বছরগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা, মন্ত্রী, এমপি, আমলা, পুলিশ কর্মকর্তাসহ শত শত মহাদুর্নীতিবাজ ব্যক্তির হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ও পাচারের ফাইল বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকলেও অনুসন্ধানের সাহস পায়নি দুর্নীত দমন কমিশন (দুদক)। আবার অনেককে ‘ক্লিনচিট’ দেওয়া হয়। ফলে বিগত সরকারের ‘আজ্ঞাবহ বা নখদন্তহীন বাঘ’ কমিশন হিসেবে পরিচিতি পায় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের বিদায়ের পর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে দুদক। তিন বছর আগের তালিকায় নাম থাকা সাবেক ৩২ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এমপির ভয়াবহ দুর্নীতি ও বিদেশে পাচার করা প্রায় লাখ কোটি টাকার খোঁজ নিতে নতুন করে অনুসন্ধান শুরু করেছে।
এর বাইরে আরও প্রায় ৪০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন পর্যন্ত ১৫০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির একটি প্রাথমিক তালিকা করা হয়েছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে দুদকের নতুন রূপ দেখে কেউ কেউ মনে করছে মূলত নিজেদের চেয়ার রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছেন দুদক চেয়ারম্যানসহ কমিশনাররা। কারণ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর আওয়ামী লীগের আজ্ঞাবহ কমিশন ঢেলে সাজানোর দাবি জোরালো হচ্ছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, রাষ্ট্র ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর দুদক যেভাবে সক্রিয়তা দেখাচ্ছে, এতে তারা প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিচ্ছে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগে পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে তাদের মূল বিবেচ্য হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ক্ষমতায় আছেন কি নেই। দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট তথ্য দীর্ঘদিন থাকার পরও যারা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিল, তাদের বিরুদ্ধে এত দিন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি দুদক। ক্ষমতার বলয়ে থাকা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা সব সময় নমনীয়।
দুদক ও গোয়েন্দা সূত্র মতে, বিগত আওয়ামী রীগ সরকারে বিগত ১৫ বছরে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন দুর্নীতি, ব্যাংক লুটসহ অনৈতিক কার্যক্রমসহ নানাকাণ্ডে আঙুল ফুলে বটগাছ বনে গেছেন শেখ হাসিনা সরকারের এক শ্রেণির মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা (এমপি)। টানা দীর্ঘকাল দায়িত্ব থাকাকালীন সময়ে তারা গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। এছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জনের পর প্রায় লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ তালিকায় সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুজ্জামান চৌধুরী, নসরুল হামিদ বিপু, আসাদুজ্জামান খান কামাল, শাজাহান খান, মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, জুনাইদ আহমেদ পলক, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও নজরুল ইসলাম বাবুসহ অন্তত ৩২ জনের নাম রয়েছে। তারা কে কোন কোন দেশে কার কী পরিমাণ সম্পদ পাচার হয়েছে-তা খুঁজে বের করা করা হবে। তবে হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে অভিযুক্ত বেশির ভাগ নেতা-মন্ত্রী ও এমপিরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
হাতেগোনা কয়েকজন আইনশৃঙ্ঘলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন, সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের অর্থপাচারের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। কোন কোন দেশে কার কী পরিমাণ সম্পদ পাচার হয়েছে সেগুলোর খোঁজে আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং হবে।
জানা গেছে, ভয়াবহ দুর্নীতি ও ক্ষমতার অবব্যবহার করে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করা প্রভাবশালীদের মধ্যে রয়েছেন আটজন মন্ত্রী, ছয়জন প্রতিমন্ত্রী, একজন উপমন্ত্রী এবং ১৭ জন সংসদ সদস্য রয়েছেন। তারা হলেন-সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রহমান, সাবেক রেলমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম, সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, সাবেক উপমন্ত্রী ভোলা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব।
দুদক সূত্র জানায়, এ ছাড়া খুলনা-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আকতারুজ্জামান বাবু, সাবেক হুইপ ও নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু, সাবেক হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, সংসদ সদস্য অসীম কুমার উকিল ও তার স্ত্রী অপু উকিল, সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরী, শাহ আলম তালুকদার, ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, ডা. মনসুর রহমান, মো. আবুল কালাম আজাদ, সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার (ছেলুন), সাইফুজ্জামান শিখর, তানভীর ইমাম, শফিকুল ইসলাম শিমুল ও সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী।
দুদক সূত্র জানায়, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর লন্ডনে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। সেখানে তার কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা রয়েছে।
সূত্র জানায়, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের দুবাইতে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। প্লট বরাদ্দে অনিয়ম ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সাবেক নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খানকে ২০১৪ সালে তলব করে দুদক। তিনি বর্তমানে রিমান্ডে রয়েছেন। অসীম কুমার উকিল ও তার স্ত্রী অপু উকিলের বিরুদ্ধেও রয়েছে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ। অবৈধ অর্থে ঢাকার উত্তরা-১০ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর রোডে দুই ইউনিটের সাততলা বাড়ির ১৪টি ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে অর্থ উপার্জন করছেন। ঢাকার ধানমন্ডি-১১ নম্বর রোডের ৪০ নম্বর বাড়িতে তিনটি ফ্ল্যাট, নেত্রকোনার কেন্দুয়া পৌরসভায় সাউদপাড়ায় রাজকীয় বাড়ি করেছেন। এ ছাড়া নেত্রকোনা সদরের কাটলী মৌজায় মূল্যবান জায়গা, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত এলাকায় বাড়িও রয়েছে। দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় এই দম্পতির দুই ছেলে সায়ক ও শুদ্ধের বাড়ি রয়েছে।
দুদক ও গোয়েন্দা সূত্র মতে, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক প্রযুক্তি খাতে ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি, এটুআই প্রকল্প, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, হাইটেক পার্ক, আইটি পার্ক তৈরির নামে লোপাট করেছেন কয়েক হাজার কোটি টাকা। হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তার স্ত্রী আরিফা জেসমিন কণিকাও। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া আমেরিকায় গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। নিজের অবৈধ আয়ের অর্থ বৈধ করতে স্ত্রীকে বানিয়েছেন উদ্যোক্তা। তার স্ত্রীর নামে সিংড়ায় রয়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ বিঘা জমি। ঢাকায় আছে কমপক্ষে ১৫টি ফ্ল্যাট। নামে-বেনামে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে পলক ও তার স্ত্রীর কণিকার নামে।
অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরে সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের তথ্য পেয়েছে দুদক। সংস্থাটি দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি কোম্পানি খুলে ওই কোম্পানির মাধ্যমে নসরুল হামিদ বিপু হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। ওই কোম্পানি প্রতিষ্ঠাকালে বিপু তার নিজের যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অবস্থিত বাসভবনের ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি হিসেবে সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশে নিবন্ধিত এই কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নসরুল হামিদ বিপুর আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনদের হাতে। আরও খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক এমপি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রহমানের পাঁচ দেশে একাধিক বাড়ির খোঁজ পেয়েছে দুদক। দুদক সূত্র বলছে, আবদুর রহমানের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, বেআইনি কার্যকলাপের মাধ্যমে নিজ নামে ফরিদপুরের মধুপুরে ভবন নির্মাণ, রাজউকসহ (পূর্বাচল) বিভিন্ন জায়গায় জমি ক্রয়; নিজ নামে মার্কেন্টাইল ব্যাংক পিএলসি, দি সিটি ব্যাংক পিএলসি এবং সোনালী ব্যাংক পিএলসিতে সঞ্চয়পত্র কেনার অভিযোগ রয়েছে। তার স্ত্রী মির্জা নাহিদা হোসেনের নামে পরীবাগের শান্তা দিগন্ত টাওয়ারসহ বিভিন্ন স্থানে চারটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়াও দেশের বাইরে টাকা পাচার করে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন এবং কানাডায় একাধিক বাড়ি কেনার গোয়েন্দা তথ্য পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজারের স্ত্রীর নামে ২০ একর জমি, দিনাজপুর শহরে একটি বাড়ি, নিজ এলাকায় বহুতল ভবন, খামারবাড়ি, স্ত্রী-কন্যা-ভাইয়ের জন্য আলাদা আলাদা গাড়ি, দিনাজপুর রোডে শিবনগর ইউনিয়নের ফকিরপাড়ায় প্রায় ২৪ একর জমির ওপর একটি খামার বাড়ি থাকারও তথ্য রয়েছে। সাবেক এমপি হেনরীর বিরুদ্ধে শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। শুধু ২০২০-২১ অর্থবছরেই তিনি কালো থেকে সাদা করেছেন প্রায় ৩২ কোটি টাকা। নিজ জেলা সিরাজগঞ্জ ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, পটুয়াখালী ও ঢাকায় তার অঢেল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সিরাজগঞ্জে গড়ে তুলেছেন ‘হেনরী ভুবন’।
দূদক সূত্রের দাবি, সাবেক রেলমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিমের জাপানে অন্তত ১ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দুই দিন আগে তিনি জাপান চলে যান। দুদকের অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সাবেক হুইপ ও নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ায় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা পাচারের তথ্য রয়েছে। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে তার ডুপ্লেক্স বাড়ি, বাণিজ্যিক প্লট ও কোম্পানি আছে। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে বরগুনা-১ আসনের সাবেক এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি, ক্ষমতার অপব্যবহার, মাদক ব্যবসা, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে টিআর, কাবিখা ও কাবিটার সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে ৫০০ কোটি টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বরিশাল-২ আসনের সাবেক এমপি শাহে আলম তালুকদারের বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি, ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে টিআর, কাবিখা ও কাবিটার সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল পরিমাণ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছে।
চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সাবেক এমপি সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার আয় ও সম্পদের পরিমাণ ছিল বেশ কম। সে সময় তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ছিল মাত্র ২২ লাখ ৯০ হাজার ৯৬৬ টাকা। ১৫ বছরে তার সম্পদ বেড়েছে প্রায় ২০ গুণ।
বর্তমানে নগদ টাকাসহ চার কোটি ৬০ লাখ ২৮ হাজার ৯৬৬ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মালিক সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, বেআইনি কার্যকলাপের মাধ্যমে নিজ নামে চুয়াডাঙ্গা সদরে তিনতলা বিশিষ্ট বিলাসবহুল জোয়ার্দ্দার কুটির নামের বাড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় জমি কেনার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া দুর্নীতির অর্থে প্রায় ৮০ থেকে ১০০টি এসি অথবা ননএসি বাসসহ ১৫-২০টি ট্রাক; তার স্ত্রী ও নিজ নামে সঞ্চয়পত্র; একটি প্রাডো গাড়িসহ তার দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক।
ওদিকে মাগুরা-১ আসনের সাবেক এমপি মো. সাইফুজ্জামান শিখরের নামে ক্ষমতার অপব্যবহার, বেআইনি কার্যকলাপের মাধ্যমে নিজ নামে মাগুরা জেলার জাগলা নামক স্থানে প্রায় ৩০ বিঘা জমিতে অটোব্রিকস ফিল্ডের ব্যবসা, মাগুরা জেলার চাওলিয়া ইউনিয়নের অন্তর্গত নগর পদ্মবিলে প্রায় ১৫০ বিঘা জমিতে মৎস্য খামার; তার নিজ নামে ১০টি ট্রাক কেনারও তথ্য পেয়েছে দুদক। আত্মীয়স্বজনের নামে গাড়ি, মাগুরায় একাধিক বাণিজ্যিক ভবন, বিভিন্ন জায়গায় অনেক জমি এবং নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ক্রয়ের অভিযোগ রয়েছে শিখরের বিরুদ্ধে। জানা গেছে, তার শ্যালকের নামে দুটি এবং ছেলের নামে দুটি গাড়ি কিনেছেন। মাগুরা সদরে তার মনোয়ারা কমপ্লেক্স নামে বহুতল মার্কেট রয়েছে।
দুদক কর্মকর্তারা জানান, অপরদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিরোজপুর-১ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন শ ম রেজাউল করিম। ২০১৮ সালেও একই আসন থেকে নির্বাচিত হন তিনি। তিনি প্রথমে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী, পরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনৈতিক কার্যক্রমসহ নানাবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। পিরোজপুরের নাজিরপুর ও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার সময় প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন নামে প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং প্রশিক্ষণের নামে ২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া তিনি দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শ ম রেজাউল করিম দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে নিজ নামে এবং তার পোষ্য এবং আত্মীয়স্বজনের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য-প্রমাণ পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান অনুমোদন করে দুদক।
অন্যদিকে মন্নুজান সুফিয়ান ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে খুলনা-৩ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের টিকিট পাননি। অভিযোগ আছে, মন্নুজান তার এপিএস ছোটভাই মো. সাহাবুদ্দিন, সাহাবুদ্দিনের মেয়ে শামীমা সুলতানা হৃদয়, বোনের ছেলে ইয়াছির আরাফাত পৃথিবী ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনৈতিক কার্যক্রমসহ নানাবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। আর নিজ নামে ঢাকার উত্তরা-১০ নম্বর সেক্টরে রাজউকের পাঁচ কাঠা জমি, সাহেববাড়ি রোড, মহেশ্বর পাশা, দৌলতপুর, খুলনায় তিন তলা বাড়ি, দুটি গাড়ি, কেডিএ, মৌথুরী হাউজিংয়ে ১৬ দশমিক সাত কাঠা জমি কিনেছেন তিনি।
সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য, ভুয়া রোগী সাজিয়ে সরকারি অনুদানের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, করোনাকোলে প্রশিক্ষণ না করিয়ে বিল উত্তোলন, কাজ না করেই টিআর, কাবিখার মতো বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও মায়ের নামে ‘করিমপুর নূরজাহান-সামসুন্নাহার মা ও শিশু বিশেষায়িত হাসপাতাল’ নির্মাণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনৈতিক কার্যক্রমসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। তার নিজ নামে, স্ত্রী ও পরিবারের নামে কোটি কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের তথ্য দুদকের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
এ ছাড়া আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব ভোলা-৪ আসনে থেকে ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর মধ্যে ২০১৪ সালে নির্বাচিত হয়ে প্রথমে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান, এর কিছু দিন পর মন্ত্রণালয় পরিবর্তন করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। দুর্নীতির কারণে পরের মেয়াদে আর মন্ত্রিত্ব পাননি তিনি। এমপি জ্যাকব মধুমতি ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক। ব্যাংটির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান শেখ পরিবারের সদস্য ও সাবেক ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। এছাড়া ঢাকা গাজীপুর নিজ এলাকায় মানুষের জমি দখল করে একদিক রিসোর্টসহ টাকা পাচার করে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, কানাডা, মালেয়েশিয়ায় একাধিক বাড়ি এবং সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় ব্যবসার গোয়েন্দা তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে বিগত বছরগুলোতে দুর্নীতিসহ নানা অপকর্মে হাজার হাজার কোটি কামিয়েছেন পুলিশ বাহিনী ও আমলাদের শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এবং সাবেক একজন সেনাপ্রধান। দুদক সূত্র মতে, এদের মধ্যে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ, বিপ্লব কুমার সরকার, ব্যাংক খেকো হিসেবে পরিচিত ব্যবসায়ী এস আলম, নাফিজ সরাফাত ও শেখ হাসিনার পিয়ন জাহাঙ্গীর আলমসহ আরও কয়েকজনের সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। দুদক সূত্র বলছে, যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম-দুর্নীতি করে নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। পুলিশ কর্মকর্তা হারুন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে স্ত্রীর নামে পাঁচ মিলিয়ন ডলারে একটি বাড়ি কিনেছেন। কিশোরগঞ্জে নিজ এলাকায় বেনামে তার ‘প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট’র মালিকানা রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকায় নামে-বেনামে একাধিক বাড়ি-ফ্ল্যাট ও জমি কিনেছেন তিনি।
নতুন তৎপরতা বা সক্রিয় হয়ে উঠা নিয়ে দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা হয়। অনেকের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ থাকে। সেই অভিযোগগুলো প্রথমে গোয়েন্দা অনুসন্ধান করা হয়। গোয়েন্দা অনুসন্ধানে সত্যতা পেলে দুদক আনুষ্ঠানিকভাবে অনুসন্ধান শুরু করে। সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে সেভাবেই অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। তাদের বিদেশে টাকা পাচারের বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন :