ঢাকা শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
রাঘববোয়াল মন্ত্রী-নেতাদের দেশত্যাগ

সীমান্ত পাড়িতে প্রশ্ন

শাহীন করিম ও মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৪, ০৫:৩৫ পিএম

সীমান্ত পাড়িতে প্রশ্ন

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

# ঢাকা থেকে সীমান্তে যাচ্ছে কীভাবে
# লক্ষ-কোটি টাকায় দেশত্যাগ!
# আ’লীগের নেতাকর্মীরা পালাতে মরিয়া
# সীমান্ত সিলগালা না করা নিয়ে প্রশ্ন
# দালাল-মানবপাচারকারী যোগসাজশ

 

ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পাড়ি জমান। এরপরই আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানসহ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি ও দলের প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যা মামলা দায়ের হয়।

গ্রেপ্তার এড়াতে ও জনরোষের ভয়ে বহু হত্যা মামলার এসব ভিআইপি আসামির দেশ থেকে পালানোর হিড়িক শুরু হয়। পাশর্বর্তী দেশ ভারত সীমান্ত যেন অরক্ষিত। সীমান্তের দালাল, মানবপাচারকারী ও চোরাকারবারিরা স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার দোসরদের অবৈধভাবে দেশ ছাড়তে কিছুটা ভূমিকা রাখছে।

হাতেগোনা কয়েকজন আটকও হয়েছেন। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে সীমান্ত দিয়ে পালানো নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা নিয়ে। বহু মামলার আসামি হয়েও কীভাবে তারা ঢাকা থেকে সীমান্তে পৌঁছান, নেপথ্যে থেকে কারা এসব হত্যা মামলা আসামি ও লুটেরাদের নিরাপদে সামীন্ত পাড়ির ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন, বিনিময়ে বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়েছে কি না, সীমান্ত কেন সিলগালা করা হয়নি, এ ক্ষেত্রে বিজিবির ভূমিকা কী, দালাল সিন্ডিকেট কীভাবে সক্রিয় থাকে, সীমান্ত পাড়ির রেট কত এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে। 

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র গোয়েন্দা কর্মকর্তারা মনে করেন, নিরাপত্তায় ঘাটতি কিংবা কঠোর মনোভাব না থাকার কারণে হয়তো হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামিরা সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। অতি পরিচিত এসব ভিআইপি আসামির পলায়ন সহজ বিষয় নয়। সাবেক পুলিশপ্রধান (আইজিপি) ও এমপি নূর মোহাম্মদও প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেন। সাবেক ডিএমপি কমিশনার নাইম আহমেদ বলেন, যারা ভারতে পালাচ্ছেন, তারা কীভাবে দেশের ভেতর দিয়েই সীমান্তে যাচ্ছেন। এই প্রশ্নের উত্তর জানাটা জরুরি। পাশাপাশি তল্লাশিচৌকি বসিয়ে নজরদারি জোরদার করতে হবে।

আর সীমান্তে মানব পাচারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি কিংবা দালাল চক্রকে আগেই আটক করা জরুরি।

বিভিন্ন সূত্রে খবর মিলছে, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমসহ অনেক মোস্ট ওয়ান্টেড ও রাঘববোয়াল আসামি ইতোমধ্যে সীমান্ত পথে অবৈধভাবে দেশ ছেড়েছেন। এর আগে সরকার পতনের পর তারা দীর্ঘদিন ঢাকাতেই ছিলেন। প্রশ্ন উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার হত্যা মামলা থাকার পরও কেন গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থ হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কীভাবে তারা ঢাকা থেকে সীমান্তে পৌঁছাল। এ ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো মহলের গ্রিন সিগন্যাল ছিল কি না। গোপনে কোনো সমঝোতা কিংবা বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়েছে কি না।

অন্যদিকে স্থানীয় সূত্রে দাবি, ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকার বিনিময়ে একেকজন নেতা অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশ ছাড়ছেন। ছোট নেতারা ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকা এবং বড় নেতা কোটি টাকা খরচ করছেন দেশ ছাড়তে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ-ভারতের দুই পাশের দালাল সিন্ডিকেট মোটা অংকের অর্থ লেনদেনের বিনিময়ে জড়িত।

অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যারা পালিয়ে গেছেন বা পালানোর চেষ্টায় আছেন, তাদের প্রায় সবাই হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার আসামি। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সীমান্তে নজরদারি বাড়িয়েছে বলে দাবি করা হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন কথা বলছে। তারা বলছে, সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে বলেই সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিসহ অনেকেই বিভিন্ন সীমান্তে ধরা পড়ছেন। সীমান্তে নজরদারির তৎপরতা অব্যাহত থাকবেও বলছেন তারা।

দেশের একাধিক সীমান্ত দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাকর্মীদের দেশ ছেড়ে পালানোর তথ্য পাওয়া গেছে। সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউরা, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, যশোর, সাতক্ষীরা ও লালমনিরহাটসহ সীমান্ত জেলাগুলোকে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। এসব সীমান্ত জেলাগুলোয় আগে থেকেই চোরাকারবারিরা সক্রিয় রয়েছে। সাধারণত তারা চোরাচালানের পাশাপাশি মানবপাচারেও জড়িত। অর্থের বিনিময়ে দুই পাশের দালালরা মানবপাচার করে থাকে।

যশোর-সাতক্ষীরা সীমান্তের একাধিক সীমান্ত দালাল জানায়, একটি চ্যানেল কাজ করছে সীমান্তের চোরাকারবারি বা মানবপাচারীদের মধ্যে। চ্যানেলের মাধ্যমে কেউ এলে তাকে সীমান্ত পার করে দেওয়া হয়। চ্যানেলের বাইরে থেকে এলে তার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়ে থাকে। কারণ এতে গ্রেপ্তারের ভয় থাকে। এতে দুই পাশের সিন্ডিকেট মিলে কাজ করে। আর্থিক বিষয়ে চুক্তি বা সমঝোতা হলেই চুক্তি মোতাবেক ব্যক্তিকে পৌঁছে দেওয়ার কাজ সম্পন্ন হয়। বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যেভাবে দেশ ছেড়ে পালানোর হিড়িক পড়েছে তাতে জনপ্রতি সীমান্ত পারাপার রেট কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর সারা দেশের মানুষের নজর। যে কারণে চেহারা-নাম অনুযায়ী লাখ টাকা থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত রেট নির্ধারিত হচ্ছে।

সাতক্ষীরা-যশোর সীমান্ত দিয়ে দেড় ডজন নেতাকর্মীর সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার তথ্য দিয়েছে তারা।
সিলেট সীমান্ত সূত্র বলছে, অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেওয়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহায়তা পাচ্ছেন। একবার সীমান্ত পাড়ি দিতে পারলে বাংলাদেশে হত্যা মামলায় পলাতক আসামি ভারতের সংশ্লিষ্টদের সহায়তায় আমেরিকা-ব্রিটেনসহ অন্য দেশে পাড়ি দিচ্ছেন।
গত ২৩ আগস্ট সিলেটের কানাইঘাটে অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পালানোর সময় স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়েন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক)। ১৫ হাজার টাকা চুক্তিতে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় দালালরা তাঁর কাছে থাকা ৬০-৭০ লাখ টাকা, পাসপোর্ট নিয়ে যায় এবং সীমান্তের ওপারে নিয়ে মারধর করে। পরের দিন ২৪ আগস্ট রাতে একই সীমান্ত দিয়ে পালানোর সময় মারা যান ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান (পান্না)। লাশ উদ্ধারের পর মেঘালয় পুলিশ সূত্র গণমাধ্যমকে বলেছে, গলা টিপে শ্বাসরোধের কারণে ইসহাকের মৃত্যু হয়েছে।

গত ১২ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্তে আটক হন চট্টগ্রামের রাউজানের সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী। এ ছাড়া বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বিপ্লব কুমার সরকারও গত ১০ সেপ্টেম্বর লালমনিরহাটের পাটগ্রামের দহগ্রাম সীমান্ত দিয়ে দেশত্যাগ করেছেন বলে খবর বের হয়েছে। এমন আরও অনেকে এভাবে দেশ ছাড়ার চেষ্টায় আছেন বলে জানা গেছে।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেক গতকাল বুধবার পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অন্তত ২০ জনের অধিক কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এর বাইরে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং অন্যান্য সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান ৩০ জনের অধিক নেতা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা শতাধিক হবে বলে গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ধারণা।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ, সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী (নওফেল), সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ (নাসিম) ও নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানসহ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের আরও বেশ কয়েকজন নেতা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। তাদের অধিকাংশ মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশ ছেড়েছেন।

বিভিন্ন সূত্রমতে, সীমান্ত দিয়ে দেশ ছেড়েছেন এমন তালিকায় রয়েছে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন (রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র), সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ (জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ) ও শফিউল আলম চৌধুরী (নাদেল), দলের দপ্তর সম্পাদক ও শেখ হাসিনার সাবেক বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, কার্যনির্বাহী সদস্য নির্মল কুমার চ্যাটার্জি, সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, কুমিল্লা সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও তাঁর মেয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র তাহসিন বাহার এবং ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী।

ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম সারোয়ার কবির (ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক), যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য মাইনুল হোসেন (নিখিল), ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ (ইনান), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির (শয়ন), ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজ মাহমুদ, যুবলীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জয়দেব নন্দী প্রমুখ।

বৃহস্পতি (১৯ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত মোট ৩২ জন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। সরকার পতনের পর শুরুতেই গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। বিদেশ যাওয়ার চেষ্টাকালে গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
সীমান্ত নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ বর্ডারগার্ডের (বিজিবি) জনসংযোগকর্মকর্তা মো.শরীফুল ইসলাম মন্তব্য করতে রাজি হননি। পরে বিজিবির মুখপাত্র (চলতি দায়িত্ব) মেজর শরিফুল ইসলামের মোবাইল ফোনে গতকাল সন্ধ্যার পর একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

আরবি/জেডআর

Link copied!