ঢাকা রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
উদ্বেগ বাড়াচ্ছে ‘মব জাস্টিস’

‘উন্মত্ত জনতার বিচার’ এখনই থামানোর তাগিদ

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৪, ০৩:২৯ পিএম

‘উন্মত্ত জনতার বিচার’ এখনই থামানোর তাগিদ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত ‘মব জাস্টিস’ বা ‘উন্মত্ত জনতার বিচার’ নিয়ে আতঙ্ক ও উদ্বেগ বাড়ছে দেশবাসীর মনে। দেশজুড়ে ‘মব জাস্টিস’ বা ‘মব লিঞ্চিং’ শব্দ দুটির ব্যবহার বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। এক শ্রেণির জনতা কোনো ঘটনার বিষয়ে প্রকৃত সত্য না জেনে না ভেবে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অপেক্ষায় না থেকে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কী করতে হবে কিংবা না বুঝেই ছুটছে ঘটনার পেছনে। এমন নিষ্ঠুর বিচার এখনই থামানোর তাগিদ দিচ্ছেন সমাজ বিজ্ঞানীসহ সচেতন মহল। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ঘটনায় সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি, আইনের শাসনের প্রতি অনীহা এবং ভবিষ্যতে প্রতিশোধ স্পৃহা তৈরি করতে পারে। যেকোনো মূল্যে এসব ঘটনা ঠেকানো না গেলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।

মব জাস্টিসের সবশেষ ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে একজনকে চোর সন্দেহে এবং অন্যজনকে ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে প্রশাসনের নাগের ডগায় এমন হত্যাকাণ্ড নাড়া দিয়েছে সব শ্রেণির মানুষকে। মনে করিয়ে দিয়েছে বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে। তবে এমন ‘মব জাস্টিস বা ‘উন্মত্ত জনতার বিচার’ নতুন নয়। এটাকে ‘বিচার’ বলতে চান না কেউ কেউ। বিচার একটি পজিটিভ শব্দ। কিন্তু মব জাস্টিসের নামে যেটা ঘটছে, সেটা ভয়াবহ। যে বিচারের অর্থ হয়ে উঠেছে গণপিটুনি, অপমান, হত্যা কিংবা আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা।

২০১৯ সালে ছেলেধরা সন্দেহে রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় তসলিমা বেগম রেণু নামের এক নারী হত্যার ঘটনা নিশ্চয় মানুষ এখনো ভোলেনি। ২০১১ সালে ডাকাত সন্দেহে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। ২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবে বরাতের রাতে ঢাকার অদূরে সাভারের আমিনবাজারে ওই ছয়জন ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

অথবা ২০১১ সালের ২৭ জুলাই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চর কাঁকড়া এলাকায় ডাকাত সাজিয়ে কিশোর শামছুদ্দিন মিলনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও মানুষকে এখনো নাড়া দেয়। পুলিশ গাড়িতে করে এনে জনতার হাতে এই কিশোরকে ছেড়ে দেয়। সেখানে পুলিশের উপস্থিতিতেই মিলনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

এসব ঘটনা আগের হলেও বর্তমানে তা আবারও বেড়েছে। কিন্তু সম্প্রতি ‘মব জাস্টিস’র নামে যা শুরু হয়েছে তা এরই মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে সারাদেশে। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও মব জাস্টিসের নামে মারামারি, অত্যাচার কিংবা হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলছেন, মব জাস্টিস কিংবা গণপিটুনিতে মানুষকে হত্যা করা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। যেহেতু দেশে একটি বিদ্যমান সরকার আছে, সচেতন সমাজ আছে। যেকোনো কিছুতে আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে আইনের সহায়তায় সমস্যা সমাধান করা উচিত।

গণআন্দোলনে হাসিনা সরকার পতনের পর পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় একদল মানুষের একজোট হয়ে বিচার করে ফেলার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা নিয়ে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে, যা ‘মব জাস্টিস’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। বাংলায় যাকে বলা হচ্ছে ‘উন্মত্ত জনতার বিচার’। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরদিন ৬ আগস্ট গভীর রাতে কুমিল্লার তিতাস থানা-পুলিশের দুই সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। স্থানীয় উৎসুক জনতা তিতাস থানা ঘেরাও করতে গেলে থানা-পুলিশ আত্মরক্ষার্থে এলোপাতাড়ি গুলি করে। এতে কমপক্ষে ৩০ জন গুলিবিদ্ধ হন। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা থানায় পৌঁছে পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করেন। পুলিশ সদস্যদের উদ্ধারের পর কিছু মানুষ তিতাস থানা এবং থানার পাশের মার্কেটে অগ্নিসংযোগ করে। থানা পাহারায় থাকা দুই পুলিশ সদস্য জীবন রক্ষার্থে থানার পেছনের ফটক খুলে পালানোর চেষ্টা করেন। লোকজন তাদের পিটুনি দিলে ঘটনাস্থলেই তারা নিহত হন।

গত ৩১ আগস্ট চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে গণপিটুনিতে মো. রফিক নামে এক বিএনপি নেতার মৃত্যু হয়। জানা যায়, ডাকাত সন্দেহে স্থানীয় লোকজন বিএনপি নেতা ও তার সহযোগীদের আটক করে গণপিটুনি দেন। কিছুদিন আগে রাজধানীর শ্যামলীতে ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মী সন্দেহে কয়েকজন নারীকে মারধর করে এইচ এম রাসেল সুলতান নামে এক ব্যক্তি নিজের ফেসবুক আইডিতে ভিডিও প্রকাশ করে। তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার পর সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সংবাদ মেলেনি। কক্সবাজার সৈকতে এক নারীকে হেনস্তার ভিডিও ভাইরাল হয়। পরে যদিও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে সেই ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে সহযোগিতা করেন আরেক নারী, তাকে এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৬ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। ঢাবির ৬ শিক্ষার্থী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ওই ছয় শিক্ষার্থী হলেন ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক উপ-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক এবং পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. জালাল মিয়া (২৫), মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী সুমন মিয়া (২১), পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের মো. মোত্তাকিন সাকিন, ভূগোল বিভাগের আল হোসেন সাজ্জাদ, ওই হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আহসান উল্লাহ ও ওয়াজিবুল আলম। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মো. মাইনুল হাসান জানিয়েছেন, জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনতে ডিবিসহ ডিএমপির একাধিক টিম কাজ করছে।

ইউটিউবার হিরো আলম ২০২৩ সালের ১৭ জুলাই ঢাকা-১৭ আসনের উপ-নির্বাচনের সময় হামলার শিকার হন। তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাতের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছিলেন। গত ৮ সেপ্টেম্বর বগুড়ায় আদালত চত্বরে কয়েকজন যুবক হিরো আলমের ওপর ফের হামলা চালায়। সরকার পতন হলেও হিরো আলমের ওপর হামলা থামেনি। গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাত ৪টার দিকে বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় গরু চুরির অভিযোগে আছির প্রামাণিক (৪০) নামের এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

সবশেষ ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের গেস্ট রুমে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবককে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন শামীম মোল্লা নামের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক নেতা। কিছুদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক সাবেক নেতাকেও পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের জেরে দেশজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের হেনস্তা করে পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনা নিয়েও হচ্ছে সমালোচনা। আক্রোশের জেরে আদালতে পুলিশের সামনেই আসামিদের ওপর হামলার অনেক ঘটনা ঘটেছে।
গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে আমরা অবশ্যই তাকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসব।
১৯ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্টে বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ লেখেন, যেকোনো মূল্যে আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা থামাতে হবে। একটা সুস্থ ও স্থিতিশীল সমাজের জন্য এটা জরুরি।

শায়খ আহমাদুল্লাহ লেখেন, চুরি করলেও যেখানে হত্যা করা যায় না, সেখানে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হলো মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীকে। আমরা দেশের নানা জায়গার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরদ্ধে কথা বলি। সেই জঘন্য ঘটনা এবার দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের কথিত শিক্ষার্থীরা ঘটালো। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

ঢাকা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, যারা ঘটনা ঘটাচ্ছে তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোটা খুবই জরুরি। জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তার করে আইনের মুখোমুখি করা দরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, মব জাস্টিসের নামে যে ঘটনাগুলো হচ্ছে তা সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। কারও ব্যক্তিগত ক্ষোভ চরিতার্থ করার জন্য পিটিয়ে হত্যা কিংবা মব জাস্টিসের নামে হত্যার কোনো সুযোগ নেই। বরং অতীতের অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য ও প্রতিহিংসার চিত্রগুলো কোনোভাবেই পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেই জায়গায় সোচ্চার থাকা জরুরি।
তৌহিদুল হক বলেন, বর্তমান সরকারের তরফ থেকেও বলা হচ্ছে মব জাস্টিসকে সমর্থন করার সুযোগ নেই এবং সরকার সমর্থনও করছে না। তবে প্রশ্নটা দাঁড়িয়েছে, মব জাস্টিসের মাধ্যমে যে ঘটনাগুলো দেখলাম পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়তো সময় লেগে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সবকিছুর সমাধান করা জরুরি। এই আইনি প্রক্রিয়া যেন দীর্ঘসূত্রতা না হয়। সেদিকে সংশ্লিষ্টদের নজর দেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর সোচ্চার ভূমিকা থাকতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের অনুসারী কিংবা নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মব জাস্টিসের অভিযোগ উঠলে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মব জাস্টিস কিংবা গণপিটুনিতে মানুষকে হত্যা করা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। যেহেতু দেশে একটি বিদ্যমান সরকার আছে, সচেতন সমাজ আছে। যে কোনো কিছুতে আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে আইনের সহায়তায় সমস্যা সমাধান করা উচিত।

আরবি/জেআই

Link copied!