►সাবেক এই শিল্পমন্ত্রী কারাগারে
►শিল্প খাতকে ধ্বংসের অভিযোগ
►নরসিংদী আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন
►ইফতারে খেজুরের পরিবর্তে বরই খাওয়ার পরামর্শে সমালোচিত
►ব্যালট ছিনিয়ে জালভোট দেন ছেলে সাদি
আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা, সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমুর আত্মীয় ও বিতর্কিত ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদ সালমান এফ রহমানের সঙ্গে সখ্য থাকায় মন্ত্রিত্ব বাগিয়ে নেন নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন। শিল্প মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়ে শিল্প খাতকে ধ্বংসের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ইফতারের সময় খেজুরের পরিবর্তে বরই খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে সমালোচিত এই মন্ত্রীর ছেলের বিরুদ্ধেও ব্যালট ছিনিয়ে জালভোট দেওয়ায় গ্রেপ্তার আদেশ জারি করেছিল নির্বাচন কমিশন। নরসিংদীর আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন তারই পরিবারের সদস্য এবং সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
গত দেড় দশকে পুরো নরসিংদী জেলাজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন এবং তার পরিবারের সদস্যরা। নূরুল মজিদের অনুসারীদের দ্বারা ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলাটির আন্ডারওয়ার্ল্ড ছিল উত্তপ্ত। সারা বছরই হত্যাকাণ্ড এবং লুটপাট ডাকাতি চাঁদাবাজির ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। বিরোধীদলসহ দলীয় যেসব নেতাকর্মী নূরুল মজিদের পরিবার বা সিন্ডিকেটের বাইরে যেত তাদের গ্রেপ্তার, মামলা-হামলা এমনকি হত্যার শিকার হতে হয়েছে।
বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) নরসিংদীতে একটি হত্যা মামলায় সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও নরসিংদী-৪ (মনোহরদী-বেলাব) সাবেক সংসদ সদস্য নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনকে (৭৮) কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। গতকাল দুপুরে রিমান্ড আবেদন করে তাকে আদালতে তোলা হলে বিচারক না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এর আগে এদিন ভোরে ঢাকার গুলশান থেকে সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে তাকে নরসিংদী থানায় হস্তান্তর করা হয়।
আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার হালিম বলেন, একটি হত্যা মামলায় সাবেক শিল্পমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক শিল্পমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। বিচারক আসামি ৭৮ বয়সী ও ওপেন হার্ট সার্জারির রোগী হওয়া রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো নির্দেশ দেন।
আদালত সূত্রে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ৪ আগস্ট মহিষাশুরা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড শ্রমিক দলেরসহ সভাপতি নিহত জাহাঙ্গীরসহ নেতাকর্মীরা মাধবদী এলাকায় আন্দোলনে অংশ নেয়। ওই সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ মহলের ইশারায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার হোসেনের নির্দেশে আন্দোলনকারীদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। ওই সময় নিহত জাহাঙ্গীর গুলিবিদ্ধ হয়। একই সময় সুমন নামে আরও একজনের বুকে ও পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে একাধিক নেতাকর্মী আহত হয়। জাহাঙ্গীরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৯টার দিয়ে জাহাঙ্গীর মৃত্যুবরণ করে।
বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনিম ফেরদৌস জানান, তার বিরুদ্ধে ৪ আগস্ট নরসিংদীর মাধবদী এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে দায়ের করা মামলা হয়। সে মামলা তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নরসিংদী সদর উপজেলার মহিষাশুড়া ইউপির ৭ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক দলের সহ-সভাপতি জাহাঙ্গীর আলমকে হত্যার ঘটনায় গত ৯ সেপ্টেম্বর নরসিংদীর জেলা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। ওই মামলার আসামি হিসেবে তাকে আদালতে তোলা হলে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
গত ৪ মার্চ রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক সম্মেলন শেষে আঙুর, খেজুরের পরিবর্তে বরই, পেয়ারা দিয়ে ইফতার করার পরামর্শ দিয়েছিলেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। সেদিন সাবেক শিল্পমন্ত্রী বলেন, আপেল লাগে কেন? আঙুর লাগে কেন? আর কিছু নেই আমাদের। ইফতারে বরই খান, পেয়ারা খান, আমাদের যা আছে সেগুলো ব্যবহার করুন। ইফতারের প্লেট সেভাবে সাজান। নূরুল মজিদের এমন পরামর্শে দেশ-বিদেশে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়।
নির্বাচনী হলফনামা মোতাবেক শুধু গত ৫ বছরে নূরুল মজিদের সম্পদ বেড়েছে ৯৮২ শতাংশ। এর বাইরে অবৈধ্য সম্পদ রয়েছে শত শত কোটি টাকার। স্ত্রী-সন্তানসহ আত্মীয়-স্বজনদের নামে গড়ে তুলেছেন বিপুল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে অন্যর জমি-ব্যবসা দখল করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক বনে যান তার পরিবার। এছাড়া রাজধানী ঢাকাতেও রয়েছে তার সম্পদ। বিদেশে টাকা পাচার করে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ করেছেন তার ঘনিষ্টজনেরা।
এর আগে, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী এই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে গত ১৯ আগস্ট দুর্নীতি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এদিন কমিশনের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গত ১৮ আগস্ট দুদক চেয়ারম্যানের কাছে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনসহ একটি তালিকা করে তাদের অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়টি উল্লেখ করে একটি আবেদন করেন। ঐ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুদক অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়।
জানা গেছে, প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু আত্বীয় এবং দেশের ব্যাংকিং এবং শেয়ারবাজার থেকে অর্থলোপাটকারী সালমান এফ রহমানের ঘনিষ্টতার সুযোগে নরসিংদী থেকে এমপি হন নূরুল মজিদ। পরে শিল্পমন্ত্রীও হন। আমু এবং সালমানের আনুকূল্য পেয়ে প্রভাবশালী হয়ে উঠা নূরুল মজিদ শিল্প খাত এক প্রকার ধ্বংস করে দেন বলে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অর্থলোপাট করতে বিবর্তিক সিন্ধান্ত নিতে গিয়ে শিল্প খাতকে নষ্ট করেন গত ৫ বছরে।
অন্যদিকে, সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদের ছেলে মঞ্জুরুল মজিদ মাহমুদ সাদী গত ৭ জানুয়ারি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনে নরসিংদী-৪ (বেলাব-মনোহরদী) আসনের একটি কেন্দ্রে ব্যালট বই ছিনিয়ে নিয়ে নৌকা প্রতীকে জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। সেদিন সকাল আটটার দিকে ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার পর পরই বেলাব উপজেলার সল্লাবাদ ইউনিয়নের ইব্রাহিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কেন্দ্রটিতে একদল কর্মী নিয়ে বেআইনিভাবে প্রবেশ করেন মঞ্জুরুল মজিদ মাহমুদ সাদী। এ সময় তারা নির্বাচন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ১২টি ব্যালট বই ছিনিয়ে নিয়ে জোর করে নৌকা মার্কায় সিল মারেন। এই আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী শিল্পমন্ত্রী অ্যাডভোকেট নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। তার বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন পাঁচবারের উপজেলা চেয়ারম্যান ও নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য সাইফুল ইসলাম খাঁন বীরু।
১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন নরসিংদী-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নরসিংদী-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। এরপর জাতীয় সংসদে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৪ সালে দশম জাতীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বানানো হয় তাকে।
২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও টানা চারবার তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নরসিংদী-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং দ্বিতীয়বারের মত শিল্পমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণসহ তৎকালীন সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। যুবলীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন তিনি কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর তিনি যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে পালিয়ে যান ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। এরপর থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও জোট শরিক দলের নেতাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, শেখ হাসিনার উপদেষ্টা, শীর্ষ পর্যায়ের নেতা মিলিয়ে অন্তত ৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :