ঢাকা শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর, ২০২৪

যে কারণে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সৃষ্টি

মো. সায়েম ফারুকী

প্রকাশিত: অক্টোবর ৩, ২০২৪, ০৭:২২ পিএম

যে কারণে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সৃষ্টি

ছবি সংগৃহীত

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলো। এরপর হেরে যাওয়া দেশগুলোর ঘাড়ের ওপর ছিল বিপুল অংকের দেনা। ইউরোপের অর্থনীতির অবস্থা শোচনীয়; দেশের অবকাঠামো বিধ্বস্ত। বিশ্বজুড়ে বিরাজমান এমন একটা অবস্থায় বিশ্বনেতাদের মনে হলো, বৈশ্বিক অর্থনীতিকে ভবিষ্যতে এভাবে আর হুমকির মুখে ফেলা যায় না। বাকিটা এখন ইতিহাস। প্রতিষ্ঠার পর আইএমএফ বর্তমানের মতো বৈশ্বিক উন্নয়ন নিয়ে কাজ করতো না। তার উদ্দেশ্যও কিন্তু এমনটা ছিল না। বিশ্বনেতারা চেয়েছিলেন, বিভিন্ন দেশের মধ্যকার যেসব সংঘাত থেকে যুদ্ধ ডেকে আনে সেগুলো নিরসনে কাজ করবে আইএমএফ। তাঁরা আরও চেয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক সমস্যা-সমাধানের একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম থাকুক।

আগামী ২২ অক্টোবর থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংকের (ডব্লিউবি) বার্ষিক সভা শুরু হবে। এই সভা বিশ্বব্যাংক ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান– যাদের একযোগে  বলা হয় ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপ (ডব্লিউবিজি)– তাদের বিশ্বময় কার্যকলাপের আলোচনা ও পর্যালোচনা করা হয়। বিশ্বব্যংক এই সম্মেলনে বাসযোগ্য পৃথিবীতে দারিদ্র খতম করার আকাঙ্ক্ষা ব্যাক্ত করেছে। বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠা লগ্ন (১৯৪৬) থেকেই গরিবী দূর করা ও উন্নয়নের কথা বলে আসছে; এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি; কাজেই উন্নয়নের কথা বলার পাশাপাশি বাসযোগ্য পৃথিবীর কথা যুক্ত করা হয়েছে। বলাবাহুল্য, বিশ্বব্যাংক এবং তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বীকার করতে হচ্ছে যে পৃথিবী আর বাসযোগ্য নেই।

১৯১৮ থেকে ১৯৩৯ সাল; অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের সময়কে ওয়ার পিরিয়ড বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। যে সময়ে বিশ্ব অর্থনীতির হালচাল ছিল অস্থিতিশীল। উল্লম্ফন মুদ্রাস্ফীতি, বৈশ্বিক বাণিজ্যে সীমাবদ্ধতা, বিদেশি শেয়ারবাজারে ফটকাবাজি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক রিজার্ভে উত্থান-পতন, স্বর্ণের সংকট, মুদ্রামান কমে যাওয়া- বৈশ্বিক অর্থনীতি ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত ছিল। এ সমস্যা সমাধানে একটি বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান গঠনের পরিকল্পনা করা হয়। আইএমএফ-এর প্রতিষ্ঠাতারা স্বর্ণ বিনিময়কে আদর্শ মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করেন যা গোল্ড এক্সচেঞ্জ স্ট্যান্ডার্ড নামে পরিচিত (মড়ষফ বীপযধহমব ংঃধহফধৎফ)।

১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একতরফা ভাবে রূপান্তরযোগ্যতা ডলারের সোনা থেকে সরিয়ে দেয়, ফলে ব্রেটন উডস চুক্তি শেষ হয়ে যায়। বিশ্বব্যাপী সকল মুদ্রার জন্য ইউএসডি বিশ্ব-মুদ্রায় একমাত্র সমর্থন এবং রিজার্ভ মুদ্রার উৎস।

আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:

বিশ্ব অর্থনীতির উল্লিখিত এই টানাপড়েনের লাগাম ধরতে ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারের ব্রেটন উডস নামক স্থানে জাতিসংঘ মুদ্রা ও অর্থবিষয়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে দুটি প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়: আইএমএফ এবং পুনর্গঠন ও উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক ব্যাংক বা বিশ্বব্যাংক।

সেই ব্রেটন উডস সম্মেলনে জন্ম হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংকসহ আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান যেগুলো সম্মিলিতভাবে ব্রেটন উডস ইনস্টিটিউশনস নামে পরিচিত। অন্যতম লক্ষ্য, একটি বৈশ্বিক, সর্বজনীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করা এবং প্রয়োজনে অর্থনৈতিক সংকটে একে অপরকে সাহায্য করা।

ঐতিহ্যগতভাবে আইএমএফের প্রধান নির্বাচিত হন ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে; আর বিশ্বব্যাংকের প্রধান নির্বাচিত হন যুক্তরাষ্ট্র থেকে।


আইএমএফ কি?

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ (ওহঃবৎহধঃরড়হধষ গড়হবঃধৎু ঋঁহফ) হলো জাতিসংঘ অনুমোদিত একটি স্বায়ত্তশাসিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। প্রধান কাজ হলো, বিভিন্ন দেশের মুদ্রানীতি এবং মুদ্রামানের হ্রাস-বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করে বাজার-স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। আইএমএফ-এর সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি-তে অবস্থিত।

১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে ডিসেম্বর ২৯টি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক লেন-দেন ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল এবং নিয়ন্ত্রণযোগ্য রাখার লক্ষ্য নিয়ে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এর ভিত্তিতেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আনুষ্ঠানিকভাবে স্থাপিত হয়। ২০১৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১৮৯টি রাষ্ট্র এই সংস্থার কার্যক্রমের আওতাভুক্ত। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট আইএমএফ-এর সদস্য-পদ লাভ করে।


বিশ্বব্যাংক কি?
বিশ্বব্যাংক বা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা। যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য ঋণ ও অনুদান প্রদান করে। বিশ্বব্যাংকের আনুষ্ঠানিক লক্ষ্য হলো বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচন। সারা বিশ্বের ১৮৯টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। এর সদর দপ্তরও যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন, ডিসি-তে অবস্থিত। সংস্থাটির আর্টিকেলস্ অব এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী, বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রধান নিয়ামক হলো- বৈদেশিক বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে সহজতর করা এবং পুঁজির বিনিয়োগ নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে বিশ্বব্যাংকের ১৩৬তম সদস্য হিসেবে সদস্য পদ লাভ করে।

আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে পার্থক্য:
আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে যথেষ্ট মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। বিশ্বব্যাংক মূলত একটি উন্নয়ন সংস্থা। আর আইএমএফ একটি সমবায়মূলক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান। বিশ্বব্যাংকের সদস্য হতে হলে কোনো দেশকে আগে আইএমএফ-এর সদস্য হতে হয়। তবে দুটি সংস্থার উদ্দেশ্য ভিন্ন, গঠন আলাদা, আর পুঁজির উৎসও আলাদা। দুটো সংস্থাই নিজ নিজ স্বকীয় পন্থায় কাজ করে থাকে।

আকৃতিতে আইএমএফ বিশ্বব্যাংক এর চেয়ে ক্ষুদ্র। তবে বিশ্বব্যাংকের মতো এর কোনো অধীনস্থ শাখা বা অন্তর্ভুক্ত সংগঠন নেই। আইএমএফ এর কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর অধীনে প্রায় ৭০০০-এর মতো কর্মী কাজ করে। এসব কর্মীদের কাজের ধরন, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদি ক্ষেত্রেও দুটি সংস্থার মাঝে ব্যাপক পার্থক্য।

সর্বোপরি জানিয়ে রাখি, উভয় সংস্থার দেওয়া শর্তসমূহ মেনেই কোনো রাষ্ট্রকে ঋণ নিতে হয়।

আরবি/এস

Link copied!