ঢাকা শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

সাধন চন্দ্রের পেট যেন দুর্নীতির গোডাউন

নজরুল ইসলাম দয়া, বগুড়া

প্রকাশিত: অক্টোবর ৬, ২০২৪, ১২:৫৫ পিএম

সাধন চন্দ্রের পেট যেন দুর্নীতির গোডাউন

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ঢাকা: ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে পাঁচ বছরের খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন সাধন চন্দ্র মজুমদার। ধান ব্যবসায়ী থেকে পেয়েছিলেন জাদুর কাঠি। দুর্নীতির মাধ্যমে গড়েছেন ‘সাধন সাম্রাজ্য’। মন্ত্রিত্বকালে ঘুষ, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নে হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র। তার পেটটাই যেন গোটা খাদ্য বিভাগ। প্রতিটি পদায়নে অন্তত ৩০ লাখ থেকে সর্বোচ্চ কোটি টাকা পর্যন্ত নিলাম উঠত মন্ত্রীর আস্তানায়। নিজ জেলা নওগাঁর পাশাপাশি বগুড়ার খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে ছিল সাধন মজুমদারের সাম্রাজ্য। খাদ্য বিভাগের সাধনভক্ত একাধিক ক্যাশিয়ার কোটিপতি বনে গেছেন। বগুড়ার ১২টি উপজেলার ধান-চাল সংগ্রহের নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণে রাখতেন সাধনের ছোট ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার মনা ও তার শ্যালক-জামাতা। শেখ হাসিনার ছাতায় ভর করে মন্ত্রিত্ব নিয়ে বনে যান অঘোষিত রাজতন্ত্রের রাজা।

গত ৫ আগস্ট থেকে পলাতক ছিলেন নওগাঁ-১ আসনের সাবেক এমপি ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। রাজধানীর তেজগাঁও থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলায় তাকে সাত দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত।

নওগাঁর নিয়ামতপুর হাজীনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে নসিব তাকে টেনে নিয়ে যায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে। সাধন চন্দ্র টানা চারবার এমপি হয়েছেন। গত সাড়ে ১৫ বছর জনপ্রতিনিধির জমানা ছিল নৈরাজ্য ও অরাজকতায় ভরা। ক্ষমতায় মসনদে তিনি মনে করতেন ‘জাদুর কাঠি হাসিনা’। সেই জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় নানা অপকর্মে জড়িয়ে নিজের ভাতিজা রাজেশ মজুমদার, ছোট ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার মনা, ছোট মেয়ে তৃণা মজুমদার এবং দুই জামাতা আবু নাসের বেগ ও নাসিম আহম্মেদকে নিয়ে গড়ে তোলেন দুর্নীতির এক দুর্ভেদ্য সিন্ডিকেট। টাকার বিনিময়ে সব ‘অসাধ্য সাধন’ হতো মন্ত্রী সাধন চন্দ্রের আস্তানায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, খাদ্য বিভাগের প্রতিটি পদায়নে অন্তত ৩০ লাখ থেকে সর্বোচ্চ কোটি টাকা পর্যন্ত নিলাম উঠত মন্ত্রীর আস্তানায়। লোভনীয় পদের মধ্যে ছিল আরসি ফুড (রিজিওনাল কন্ট্রোলার অব ফুড), ডিসি ফুড (ডিস্ট্রিক্ট কন্ট্রোলার) এবং ওসি এলএসডি (গুদাম কর্মকর্তা)। ধান-চাল বেশি উৎপাদন হয় এমন তালিকাভুক্ত জেলার বাইরেও যেকোনো স্থান ও পদে পদায়নের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিতে হতো সাধন সিন্ডিকেটকে। ঘুষ, দুর্নীতির সব অপকর্ম সমন্বয় করতেন মন্ত্রীর ভাতিজা রাজেশ মজুমদার। তিনি ছিলেন খাদ্যমন্ত্রীর সহকারী, বসতেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ে। সঙ্গী ছিলেন মন্ত্রীর একান্ত সচিব সাধন চন্দ্রের বড় জামাতা আবু নাসের বেগ (মাগুরার সাবেক ডিসি) ও মন্ত্রীর এপিএসের দায়িত্বে থাকা ছোট মেয়ে তৃণা মজুমদার। টাকার বিনিময়ে দপ্তরের যেকোনো পদায়ন, বদলি, বরাদ্দ- সবকিছু মন্ত্রণালয়ে বসে তারাই সামলাতেন। টাকার লেনদেন হতো মন্ত্রীর বেইলি রোডের সরকারি বাসায়। সেই বাসভবন সন্ধ্যা থেকেই খাদ্য বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার পদভারে মুখর থাকত। প্রায় প্রকাশ্য নিলামের মাধ্যমে দরদাম ঠিক করে পছন্দমাফিক বদলি কিংবা পদায়ন নিতেন খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।

সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ: সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার নওগাঁয় গড়েছিলেন ভাই লীগ ও সিন্ডিকেট লীগ। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেই প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতেন। এর সঙ্গে সরকারি সব দপ্তরের নির্মাণ কাজের ২০ শতাংশ কমিশন চালু করেছিলেন ভাই লীগের সদস্যরা। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ও খাদ্য নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। খাদ্যমন্ত্রী হলেও নওগাঁ জেলায় সড়ক, এলজিইডি, কৃষি, খাসপুকুর, সরকারি জমি ও বিভিন্ন নিয়োগ বাণিজ্য ছিল তার দখলে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নওগাঁয় গড়ে তোলেন মজুমদার সাম্রাজ্য।

জামাতা ডা. রাজনের হত্যা ধামাচাপা: সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদারের জামাতা ডা. রাজন কর্মকারের রহস্যজনক মৃত্যু ধামাচাপা পড়ে গেছে। খাদ্যমন্ত্রীর খুঁটির জোরে জামাতা হত্যার মূল রহস্য আর উদ্ঘাটন হয়নি। ২০১৯ সালের ১৭ মার্চ ভোরে সাবেক খাদ্যমন্ত্রীর বড় মেয়ে কৃষ্ণা রানী মজুমদার তার স্বামী ডা. রাজনকে অজ্ঞান অবস্থায় ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ওইদিন রাত ১২টার দিকে ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শেষে বাসায় ফিরেছিলেন ডা. রাজন। স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, তিনি আগেই মারা গেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন ডা. রাজন কর্মকার। কৃষ্ণা রানী বিএসএমএমইউর জেনারেল সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। রাজনের মৃত্যুর পরপরই পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল, তাকে হত্যা করা হয়েছে। বিষয়টি থানা পর্যন্ত গড়িয়েছিল।

সাধনের দাপটে বাঘ-মহিষ এক ঘাটে: প্রভাব খাটিয়ে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা রেখেছিলেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। জেলার সব হাটবাজারের ডাক নিতেন তিনি। সাধন মজুমদারের ভয়ে বাঘে-মহিষে এক ঘাটে পানি খেতে বাধ্য ছিল। কোনো কোনো এলাকায় বিএনপি নেতা-কর্মীরা কথামতো না চললে দেওয়া হতো মামলা। দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত প্রায় ২০ কোটি টাকার সরকারি খাসজমিতে মন্ত্রী প্রভাব খাটিয়ে গড়েছেন ট্রাক টার্মিনাল। নওগাঁয় হাজার কোটি টাকার সিএসডি নির্মাণের তথ্য জনগণ জানে না। সাপাহারে যে স্থানে অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলা হবে সেখানে অধিকাংশ জমি রয়েছে মন্ত্রী ও তার লোকজনের। কম দামে জমি কিনে বেশি দামে সরকারের কাছে বিক্রির নীলনকশা তৈরি করেছিলেন মন্ত্রী।

সরকারি পুকুরগুলো প্রভাব খাটিয়ে দখলে রেখেছিলেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদার। এসব নিয়ন্ত্রণ করত তার সিন্ডিকেট বাহিনী। নওগাঁ-১ আসনের সাপাহার, পোরশা, নিয়ামতপুর- এ তিন উপজেলায় ব্যাপক মাছের চাষ হয়। লাভজনক এ চাষে আয় আসে কোটি কোটি টাকা। এতে নজর পড়ে সাধন চক্রের। যে কারও নামেই পুকুর লিজ থাকুক না কেন, তা সিন্ডিকেটের কাছে ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হতো। সরকারি অনেক জলাশয় গত পাঁচ বছরের মধ্যে লিজ দেওয়া হয়নি। পুকুরগুলো ছিল সাধন সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। দলীয় লোকজন ছাড়াও ব্যবসায়ীর কাছে কমিশনের মাধ্যমে মাছের ব্যবসাও চলত মন্ত্রীর। 
নওগাঁর মাছ ব্যবসায়ী আবদুল হাকিম মণ্ডল বলেন, অনেক বছর নিজের সম্পত্তি ভোগ করতে পারিনি। পুকুর ভরা মাছ তুলে নিয়ে বিক্রি করেছেন সাবেক মন্ত্রীর লোকজন। ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারিনি। আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছিলাম। শেখ হাসিনার পতনের পর মন্ত্রী পালিয়েও রক্ষা পায়নি।  

কোটি টাকার পদায়ন বাণিজ্য: পাঁচজন ছিলেন মূলত সাবেক মন্ত্রী সাধন মজুমদারের সেনাপতি। তারা মিলে পদায়ন, বদলি, বরাদ্দ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন। অর্থের লেনদেন হতো ঢাকায় বেইলি রোডে। দরদাম ঠিক করে পদায়ন নিয়েছেন কয়েকজন খাদ্য কর্মকর্তা। প্রতিটি পদায়নে সর্বনিম্ন ৩০ লাখ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হতো। গত ৫ আগস্টের আগে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে বগুড়ায় যোগদান করেন এক কর্মকর্তা। শোনা যায়, তিনি ১ কোটি টাকা লেনদেন করে বগুড়ার চেয়ারটি বাগিয়ে নেন। এ কর্মকর্তার দায়িত্ব ছিল বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, গাইবান্ধা, রংপুরসহ কয়েকটি জেলার খাদ্য বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঘুষ হিসেবে কমিশন সংগ্রহ করে দেওয়া। এ কমিশন চলে যেত সাবেক মন্ত্রীর কোষাগারে।

চালের বাজারদর নিয়ন্ত্রণ: দেশের চালের অন্যতম মোকাম হিসেবে পরিচিত উত্তরের জেলা নওগাঁ। বিভিন্ন গুদামে হতো অবৈধভাবে ধান-চাল মজুত। মিলারের বেশির ভাগই সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের আত্মীয়। বাজার সিন্ডিকেট তৈরি করতে নওগাঁর গুদামগুলোয় অবৈধভাবে ধান-চাল মজুত করতেন তারা। হঠাৎ ধান-চালের দাম বাড়িয়ে দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতেন সিন্ডিকেটে তাঁর আত্মীয়রা।

সাধনের পেটে ছিল খাদ্য বিভাগ: গম ও চালসহ খাদ্যপণ্য আমদানিতে রামরাজত্ব কায়েম করেছিলেন সাবেক মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। পছন্দের লোক দিয়ে গোপনে টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি ছাপানোসহ নিজস্ব লোককে সেই টেন্ডার পাইয়ে দিতেন। সরকারিভাবে সংগ্রহের চাইতে বিদেশ থেকে আমদানিতেই বেশি আগ্রহ ছিল তার। এসব কর্মকাণ্ডে তাকে সহযোগিতা করত সোহেল নামে এক ঠিকাদার। গম সোহেল নামেই যার পরিচিতি গোটা খাদ্য বিভাগে। এভাবেই হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।

অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, সিরাজগঞ্জের ন্যাশনাল ইলেকট্রিক নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক সোহেল ওরফে গম সোহেল রাশিয়া থেকে গম এনে সরকারি গোদামে সরবরাহ করতেন। এই গম সোহেল মূলত মন্ত্রী মজুমদারের লোক ছিলেন। ওপেন টেন্ডারের কথা বলা হলেও এসব গম আমদানি করতেন শুধু গম সোহেলই। অন্য কোনো ঠিকাদার টেন্ডারে অংশ নিলেও কাজ যেত ন্যাশনাল ইলেকট্রিক নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ঘরে। সেখান থেকে মুনাফা নিতেন গম সিন্ডিকেটের হোতা মন্ত্রীর জামাতা পাইলট শুভন দেব। এই শুভন দেব দিনাজপুর খাদ্যগুদামের এক ম্যানেজারকে কোটি টাকার বিনিময়ে ঢাকার তেজগাঁও সিএসডিতে পদায়ন করান।

খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক সংগ্রহ মো. মনিরুজ্জামান জানান, স্বচ্ছ টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ঠিকাদার নিয়োগের মাধ্যমে বিদেশ থেকে গম আমদানি করা হয়। সেক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি বা দুর্নীতি করার কোনো সুযোগ নেই। ন্যাশনাল ইলেকট্রিক নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক সোহেল তিনি রাশিয়ার সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে গম আমদানিতে সহযোগিতা করেন। 
খাদ্য বিভাগের বাইরে নওগাঁ জেলা সদরের বিভিন্ন অফিস ও কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের দপ্তরের সব কাজেই অনুমোদন লাগত সাধন চন্দ্র মজুমদারের। এটা না করলে তার ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার নানাভাবে হেনস্তা করতেন। 

আরবি/এফআই

Link copied!