ঢাকা শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪
তদন্তে কোন অগ্রগতি নেই

ফায়ারের সাবেক ডিজির বিরুদ্ধে লুটপাটের অভিযোগ

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৭, ২০২৪, ০২:০৯ এএম

ফায়ারের সাবেক ডিজির বিরুদ্ধে লুটপাটের অভিযোগ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ঢাকা: ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সদ্য সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিনের বিরুদ্ধে নিয়োগ ও বদলিবাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, মানি লন্ডারিং ও অন্যান্য খাতে ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ এবং বিভিন্ন দেশে টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। তবে এসব অভিযোগের পর গত সেপ্টেম্বরে বঙ্গবাজারে আগুনের ঘটনা এবং দুর্নীতি নিয়ে মাইন উদ্দিনের বিরুদ্ধে দুদকের চিঠির পর তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত আগস্টে দুদক থেকে চিঠিটি আসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এর পরপরই তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তদন্ত শেষে রিপোর্ট দেবে বলা হলেও গত দেড় মাসে তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই। এর আগে ১২ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক ডিজির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা। দুদকের চিঠির পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে দায়সারাভাবে। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। তার দুই বছর চার মাস সময়টা ছিল দুর্নীতির আখড়া।

তদন্ত কমিটি গঠনের এক মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই গত ৩ অক্টোবর মাইন উদ্দিনকে ফায়ারের ডিজি পদ থেকে সরিয়ে সেনাবাহিনীতে ফেরত পাঠানো এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামালকে নিয়োগ দেয় সরকার।

অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সরকারের শীর্ষপর্যায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পেতেন না। অভিযোগ তদন্ত করে অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মাইন উদ্দিনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন সরকারের সেবামূলক এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। মাইন উদ্দিন মহাপরিচালক হিসেবে অধিদপ্তরে যোগদানের পর দুই বছর চার মাসে (৩ অক্টোবর পর্যন্ত) তার ছোট ভাইদের মাধ্যমে দুর্নীতি ও অনিয়ম করে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অবৈধ অর্থ দেশের বাইরে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ।

অভিযোগ রয়েছে, মাইন উদ্দিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শপথ ভঙ্গসহ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মতো সেবাদান প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেন। তার ভাই নূর উদ্দিন আনিসকে দিয়ে নিয়োগ ও বদলিবাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, মানি লন্ডারিং ও অন্যান্য খাতে ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ এবং সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করে সেনাবাহিনী ও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন। তার ছোট ভাই নূর উদ্দিন আনিস, সালাউদ্দিন ও তাদের সিন্ডিকেট কর্তৃক অধিদপ্তরকে তাদের একটি ব্যক্তিগত বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। 

ফায়ার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও দুদক সূত্রে জানা গেছে, দুই বছর চার মাস ডিজি থাকাকালীন সাবেক দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী, মুখ্য সচিব, সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন ভিআইপির নাম ভাঙিয়ে নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি করেছেন। ভাই নূর উদ্দিন আনিছের অভিনব পদ্ধতিতে সেফটি প্ল্যানে কোটি কোটি টাকা লুট করেছেন বলে অভিযোগ। দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করে ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ করেছেন। বেআইনি বদলিবাণিজ্য, কোটেশনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। বহুতল ভবনের ছাড়পত্র ও সেফটি প্ল্যান অনুমোদনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণ, ফায়ার লাইসেন্সের নামে চাঁদাবাজি, কেন্দ্রীয় স্টোর, প্যাকেজ ট্রেনিং সেল ও পূর্বাচলে ক্যান্টিনের মাধ্যমে দুর্নীতিসহ ডিজিএফআইকে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।

কক্সবাজারের ইনানী বিচের মেরিন ড্রাইভসংলগ্ন জমি ক্রয়ে দুর্নীতি, মহাপরিচালক ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ, স্বাধীনতা পুরস্কারের নামে নিজের ছবিসহ স্মৃতিফলক নির্মাণ, মহাপরিচালক হিসেবে যোগদানের পর তার ভাই আনিসের সম্পত্তি কেনার পরিমাণ বেড়েছে বহুগুণ। কল্যাণ ট্রাস্ট ও কল্যাণ তহবিলের টাকা নয়ছয়, স্বেচ্ছাচারিতা, নিয়মবহির্ভূতভাবে কর্মকর্তাকে বরখাস্ত, ডিজির বদলির আদেশ পেয়েই গণহারে বদলিবাণিজ্য, মামলার আসামিকে টাকার বিনিময়ে ফায়ার সার্ভিসে পদোন্নতিসহ ডিজির দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় ফায়ার ফাইটার গ্রেপ্তারের ঘটনাও ঘটান তিনি। ঢাকায় বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে নোটিশ দিয়েই টাকা হাতিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের সাবেক এই ডিজি। তার পরিবারের অত্যাচারে গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলার সদর উপজেলার নোয়ারন্নাই শিবপুর এলাকার মানুষও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

এদিকে, অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সময় অদক্ষতার অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করেছে গত মাসের শুরুতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (নিরাপত্তা ও বহিরাগমন) সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি সম্প্রতি গঠন করা হয়। মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগের অগ্নি উপবিভাগের উপসচিব জাহিদুল ইসলামের সই করা এক চিঠিতে বিষয়টি জানানো হয়েছে।

তদন্তের ওই সুপারিশে বলা হয়েছে, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিনের চরম অদক্ষতার কারণে বঙ্গবাজার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়াসহ তার ছোট ভাই নূর উদ্দিন আনিস, সালাউদ্দিন ও তাদের সিন্ডিকেট কর্তৃক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ছবির অবমাননাসহ নিয়োগবাণিজ্য, বদলিবাণিজ্য, টেন্ডারবাজি ও অন্যান্য খাতে ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে অনুরোধ করা হয়েছে। উল্লিখিত বিষয়ে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নিরাপত্তা ও বহিরাগমন) মো. সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে যুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা অধিশাখা) ফয়সল আহমেদ ও সিনিয়র সহকারী সচিব (নিরাপত্তা-৩ শাখা) আফরোজা আক্তার রিবার সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত জুন-জুলাইয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ে একটি তদন্ত কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মাইন উদ্দিন এবং তার ছোট ভাই নূর উদ্দিন আনিস, সালাউদ্দিন ও তাদের সিন্ডিকেট নিয়োগবাণিজ্য, বদলিবাণিজ্য, টেন্ডারবাজি ও অন্যান্য খাতে ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে অনুরোধ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে রাজধানীর অন্যতম বড় কাপড়ের মার্কেট বঙ্গবাজারে আগুন লেগে পাঁচটি মার্কেটের ৫ হাজার দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

মাইন উদ্দিন ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান করে ফায়ারফাইটার ও ড্রাইভারসহ মোট ৮০০ জনকে নিয়োগ প্রদান করেন। ওই নিয়োগে তার আপন ছোট ভাই নূর উদ্দিন আনিস, সালাউদ্দিন ও তাদের সিন্ডিকেট সদস্য ডিএডি শাহ ইমরান, ওয়ারহাউজ ইন্সপেক্টর মতিউর রহমান পাটোয়ারী, সহকারী পরিচালক (সাবেক ওয়ারহাউজ) মানিকুজ্জামান, সিনিয়র স্টেশন অফিসার শাহীন আলম (পোস্তগোলা) ওয়ারহাউজ ইন্সপেক্টর জাকির গং কর্তৃক জনপ্রতি ১৫ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিয়ে প্রায় ৩৫০ জনকে চাকরি দেন। ওই নিয়োগের মাধ্যমে প্রায় ৬ কোটি টাকা আয় করেন। এ ছাড়া এর কয়েক মাস পরে ৫৫০ জন ফায়ারফাইটার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রদান করে অতিরিক্ত ১০০ জনসহ মোট ৬৫০ জনকে নিয়োগ প্রদান করেন। এই নিয়োগে বর্তমান ডিজি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন ভিআইপির নাম ভাঙিয়ে ৬৫০ জনের মধ্যে প্রায় তার ভাইকে দিয়ে ৩০০ প্রার্থী থেকে জনপ্রতি ১৫ লাখ টাকা নিয়ে চাকরি দিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি করেন। মন্ত্রী, সচিব, মুখ্য সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন ভিআইপির নামে ভুয়া তালিকা প্রণয়ন করে নিয়োগ কমিটি সদস্যদের চাকরি দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে নিয়োগ প্রদান করেন। দুই নিয়োগে মহাপরিচালক ও তার ভাইদের সিন্ডিকেট দ্বারা প্রায় ৭০ কোটি টাকার নিয়োগে দুর্নীতি করেন।

কক্সবাজারে দুর্নীতি : অধিদপ্তরের কল্যাণ তহবিলের ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে জমি কেনা হয়, যা প্রকৃতপক্ষে ৫ কোটি টাকা দিয়ে কিনে ১৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন ডিজি মাইন উদ্দিন। এই টাকা ভাগাভাগি নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় তৎকালীন ফায়ার সার্ভিস ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের এমডিকে পদ থেকে অপসারণ করে বাবুল চক্রবর্তী নামে ডিজির আস্থাভাজন এক দুর্নীতিগ্রস্ত ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তাকে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে বসিয়ে লুটপাট চালান। বিষয়টি জমি বিক্রর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় জনগণ মিডিয়ার মাধ্যমে জানালে সাংবাদিকেরা এবং স্থানীয় জনতা কক্সবাজার স্টেশনে এ বিষয়ে জবাবদিহি করতে গেলে সেখানের তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক অতিশ চাকমা ডিজির নির্দেশে ঢাকায় পালিয়ে যান এবং পরে তাকে পুরস্কারস্বরূপ ঢাকায় পোস্টিং দেয়া হয় ।

আরবি/জেডআর

Link copied!