ঢাকা সোমবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৪

গুম-খুনের মাস্টারমাইন্ড তারিক আহমেদ সিদ্দিক

শাহীন করিম

প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০২৪, ০১:১৫ এএম

গুম-খুনের মাস্টারমাইন্ড তারিক আহমেদ সিদ্দিক

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে দেশে অন্তত পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে গুম-অপহরণের ঘটনার অভিযোগ রয়েছে। যদিও মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকারের’ ভাষ্যমতে, গত জুন পর্যন্ত ৭০৯ জন গুমের শিকার হয়েছেন। গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশনে ইতোমধ্যে প্রায় ৪৫০টি অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। একইভাবে পতিত সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে কয়েক হাজার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে। এসব ভয়ংকর অপরাধের বেশির ভাগের মূল পরিকল্পনাকারী বা মাস্টারমাইন্ড ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক। তার সহযোগী হয়ে নির্দেশদাতার ভূমিকায় ছিলেন বরখাস্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, সাবেক আইজিপি এ একে এম শহীদুল হক ও বেনজীর আহমেদ। 
গুমের শিকার হয়ে ভারতের সিলং থেকে ফিরে আসা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, ‘আয়নাঘর’ (গোপন বন্দিশালা) থেকে মুক্তি পাওয়া সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আযমী, ব্যারিস্টার আরমান, লে. কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান কর্নেল (অব.) তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরীসহ ভুক্তভোগীদের অনেকে গুমসংক্রান্ত কমিশনে এমন অভিযোগ দিয়েছেন। হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের প্রাথমিক তদন্তে এর সত্যতা মিলেছে। তারপরও অধিকতর তদন্ত চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দাবি। 
সূত্রমতে, গুমসংক্রান্ত কমিশন ও একাধিক মানবাধিকার সংস্থার তদন্তে উঠে এসেছে, বিগত সরকারের আমলে গুম ও খুনের মাধ্যমে দেশজুড়ে ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়েছিল। এই অপকর্মে চার মূল হোতা ছাড়াও আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েকজন নেতা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আরও কয়েকজন কর্মকর্তা যুক্ত ছিলেন। গুমের ঘটনা ব্যাপকভাবে ঘটতে থাকে দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন সামনে রেখে ২০১৩ সাল থেকে, চলে সরকার পতনের আগ পর্যন্ত। একটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থাসহ কতিপয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে এ কাজে ব্যবহার করা হয়। এদিকে একটি গোয়েন্দা সূত্র বলছে, গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত বহু অপকর্মের মাস্টারমাইন্ড তারিক সিদ্দিক বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই দেশ থেকে পালিয়ে যান তিনি। ২০১৮ সালে প্রায় দুই মিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে লন্ডনের অভিজাত গোল্ডারস গ্রিন এলাকার আলিশান বাড়িটি ছোট মেয়ে বুশরার নামে ক্রয় করেন তারিক। এ ছাড়াও সেখানে তার বিপুল সম্পদের মালিকানা রয়েছে। 
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের বিএনপিসহ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন, বিরোধী মত দমন, ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক খাতে লুটপাট, ব্যাপক মাত্রায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এসব কাজে আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে কুশিলবের ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন সরকারের উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা। নেপথ্যের মূল কারিগর ছিলেন মহা ক্ষমতাধর তারিক আহমেদ সিদ্দিক। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন ও ছোট বোন শেখ রেহানার দেবর। এদিকে সূত্র বলছে, রিমান্ডে থাকা অবস্থায় সেনাবাহিনীর বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান গোয়েন্দাদের জেরার মুখে বলেছেন তারিক আহমেদ সিদ্দিকের নাম। জিয়া বলেছেন, তার কাছে সব ধরনের নির্দেশ আসত তারিকের কাছ থেকে। এ ছাড়া সাবেক দুই পুলিশপ্রধান শহীদুল হক ও বেনজীর আহমেদও অনেক ঘটনার নির্দেশদাতা ছিলেন। 
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকারের’ পরিচালক ও গুমসংক্রান্ত কমিশনের সদস্য নাসির উদ্দিন এলান বলেন, গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশন কিছুদিন আগে ‘আয়নাঘর’ পরিদর্শন করেছে। এ ছাড়া পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক বন্দিশালা বা টর্চার সেল পরিদর্শন করেও আলামত মিলেছে। সরকার পতনের পর কিছু আলামত নষ্ট করা হয়েছে। তারপরও আশা করছি, কমিশনের প্রতিবেদনে বিগত সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের ঘটনায় কারা জড়িত ছিল, সে সম্পর্কে ধারণা মিলবে। আমাদের প্রাথমিক তদন্তেও অনেক কিছু উঠে আসছে। তিনি আরও জানান, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের শিকার মোট ৭০৯ জনের মধ্যে ৮৩ জনের লাশ পাওয়া গেছে। ৪৭১ জন ফিরে আসতে পারলেও এখনো ১৫৫ জন নিখোঁজ রয়েছেন। 
ক্ষমতাচ্যুত আ.লীগ সরকারের ভয়ংকর সব কর্মকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক এখনো গ্রেপ্তার না হওয়ায় জনমনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। পিলখানায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে নিষ্ঠুরভাবে খুন করা, শাপলা চত্বরে রাতের আঁধারে হেফাজতের নেতাকর্মী ও মাদ্রাসার ছাত্রদের হত্যা এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় শত শত ছাত্রদের হত্যার নেপথ্যে কারিগর ছিলেন এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা। সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার ও তার স্ত্রী শাহনাজ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে। শেখ রেহানার জা হিসেবে বড় প্রভাব রাখতেন শাহনাজ। শেখ হাসিনার প্রশ্রয়ে বিপুল অর্থ আয় ও পাচার করেছেন এই দম্পতি। তারিক সিদ্দিকের অর্থ লুটপাট এবং সেনাবাহিনীর অনেক পেশাদার কর্মকর্তাকে হয়রানি করে চাকরিচ্যুতসহ নানা নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে দুদক ও গোয়েন্দাদের তদন্তে।
ওদিকে ভিকটিম ও গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, তারিক আহমেদ সিদ্দিকের ডান হাত হিসেবে পরিচয় পাওয়া চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান ওরফে জিয়া অনেকের কাছেই ছিলেন মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম। শেখ হাসিনা সরকারের সময় নানাভাবে আলোচনায় এসেছিলেন তিনি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ফোনে আড়ি পেতে কল রেকর্ড ফাঁস, অপহরণ-গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ নানা অভিযোগ শোনা গেছে তার বিরুদ্ধে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অধীন প্রতিষ্ঠান জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (এনটিএমসি) যাত্রা শুরু করে ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি। ২০১৭ সালের ৬ মার্চ থেকে জিয়াউল আহসান এনটিএমসির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। হাসিনার পতনের পর জিয়াউলকে গ্রেপ্তার করা হয়। অনেক হত্যা মামলার আসামি তিনি। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি গুম ও খুনের জন্য কথিত আয়নাঘর তৈরির জন্য তারিক সিদ্দিকের নাম উল্লেখ করেছেন।
অপরদিকে ২০১৫ সালের শুরু থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পুলিশের আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এ কে এম শহীদুল হক। এ আইজিপির সময়কালে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনা অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় ছিল সর্বোচ্চ। বিরোধী দলের ওপরেও নিপীড়ন, ধরপাকড় ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। ২০১৪ সালে জামায়াত নিধনের নামে পুলিশকে তিনি গুলি করার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। মিছিল করার অপরাধে বহু নেতা-কর্মী পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি ডিএমপি কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেও একইভাবে বিতর্কিত হন। অন্যদিকে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ তিন পদে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করেছেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। বিরোধী দল ও ভিন্নমত দমনে অতিউৎসাহী ভূমিকা পালন করেন। সাবেক এই পুলিশপ্রধানের বিরুদ্ধে বহু বিরোধী রাজনীতিককে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। র‌্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকার সময় ক্রসফায়ারে বিরোধীদলীয় বহু নেতাকর্মী হত্যার ঘটনা ঘটে। আইজিপি থাকা অবস্থায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়ে ব্যাপক সমালোচিত হন তিনি।
গত ১৫ অক্টোবর গুম কমিশনের প্রধান সাবেক বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, শেখ হাসিনার নির্দেশে সাবেক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, বেনজীর এবং তারিক সিদ্দিক গুম-খুন করেছেন। এরাসহ গুম-খুনের মূলহোতাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দেশ থেকে চিরদিনের জন্য গুম-খুনের সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। বেনজীর আহমেদসহ আরও যারা গুম-খুনের হোতা ও নায়ক রয়েছে, তারা নির্দেশ পেয়েছিল সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ও তারেক সিদ্দিকসহ যাদের কাছ থেকে, সবাইকে খুঁজে বের করতে হবে।
এর আগে গত ৫ অক্টোবর রাজধানীর রাওয়া ক্লাবে সাবেক সামরিক কর্মকর্তাদের এক সেমিনারে গুমের শিকার লে. কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান বলেন, আয়নাঘরের মূল কারিগর সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, জিয়াউল আহসান ও মামুন খালেদ। বিগত সরকার আমার ওপর যে নিপীড়ন করেছে তা অবর্ণনীয়। আমাকে আমার কর্মস্থল থেকে তুলে নিয়ে গুম করা হয়। সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে আমি সেনাবাহিনী থেকে পুরস্কৃতও হয়েছিলাম, সেই আমাকেই জঙ্গি তকমা দেওয়া হয়েছে। এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের সাবেক কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও গুম-খুনের অভিযোগ  রয়েছে। এদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
গুমসংক্রান্ত কমিশনের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী গত সপ্তাহে জানিয়েছেন, রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী কর্তৃক যারা গুম হয়েছেন তাদের অভিযোগগুলো নিয়েই আমরা কাজ করেছি। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদেরও ডাকব। বক্তব্যের জন্য সমন দেব। অভিযুক্তরা না এলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি গুমের অভিযোগ এসেছে র‌্যাব, ডিজিএফআই, ডিবি ও সিটিটিসির বিরুদ্ধে। ২৫ সেপ্টেম্বর আয়নাঘর ও ১ অক্টোবর ডিবি ও সিটিটিসি কার্যালয় পরিদর্শন করেছি। তবে সেখানে কোনো বন্দি পাইনি। সম্ভবত ৫ আগস্টের পর সেখান থেকে সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিগত সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশ ছাড়াও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা স্বপ্রণোদিত হয়েও সরকারের দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন। তারা নৈতিকতা বিবর্জিত হয়ে ব্যক্তিস্বার্থেও এসব জঘন্য কাজ করেছেন। সরকারের অন্যায় আদেশ তারা মানতে বাধ্য না। তারা চাইলে জনগণের স্বার্থে কাজ করতে পারতেন। সময় এসেছে তদন্তসাপেক্ষে গুম-খুনে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করার।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!