ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪

নাম পবিত্র কাজে অপবিত্র

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: অক্টোবর ২২, ২০২৪, ০৭:০৬ এএম

নাম পবিত্র কাজে অপবিত্র

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

গণপূর্ত অধিদপ্তরে দুর্নীতির ‘মহারাজা’ নামে পরিচিত। সেখানকার নির্বাহী প্রকৌশলী পবিত্র কুমার দাস আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মির্জা আজমের আস্থাভাজন হয়ে এতই বেপরোয়া ছিলেন যে, অধিদপ্তরের ঊধ্বর্তন কর্মকর্তার নির্দেশও মানেন না। বহুগুণে গুণান্বিত পবিত্র কুমারের বিরুদ্ধে কর্মক্ষেত্রে কাজ না করেই বিল হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ই-এম শাখা-৬-এর নির্বাহী প্রকৌশলী পবিত্র কুমার দাস নিজেকে অত্যন্ত সাধু ব্যক্তি হিসেবে প্রচার করে থাকেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে একাধিক অভিযোগ জমা পড়লেও অদৃশ্য ক্ষমতার জোরে তা অনুসন্ধানে আলোর মুখ দেখছে না, বিভাগীয় তদন্তও থেমে আছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যার অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার একটিতে আসামি হয়েছেন তিনি। এতে তার বিরুদ্ধে হামলায় অর্থের জোগান দেওয়া ও সহযোগিতা করার অভিযোগ আনা হয়।

এতকিছুর পরও এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন এই কর্মকর্তা।
ক্ষমতার পটপরিবর্তনে স্বৈরাচার হাসিনার দোসর গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী পবিত্র নিজেকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে বিএনপির নেতাদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থও ঢালছেন। তার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা হত্যায় অর্থ সরবরাহের অভিযোগ করেছেন অধিদপ্তরের কর্মরতরা। হাসিনা সরকারের পতনের পর ভোল পাল্টে বিএনপির লোক বলে প্রচার চালাচ্ছেন তিনি। বিএনপির অসাধু ও অসৎ নেতাকর্মীদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তাদের আত্মীয় পরিচয় দিচ্ছেন। বিএনপির তথাকথিত নেতারা কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে তার পক্ষে তদ্বির করছেন। পবিত্রকে নিজের খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন তারা। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের দোসরদের নিরাপত্তা বা পুনর্বাসন করতে মরিয়া বিএনপির এসব নেতা। গণপূর্ত নির্বাহী প্রকৌশলী পবিত্র রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে ভুয়া ভাউচারে ১০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে আলোচনার জন্ম দেন।

গণপূর্তের কর্মচারীরাই বলছেন, নাম পবিত্র হলেও অনিয়ম ও দুর্নীতিতে তিনি যেন চরম অপবিত্র। তার কাজের সঙ্গে নামের ফারাক যেন আকাশ-পাতাল। দরপত্রে অনিয়ম, কাজের আগে বিল পরিশোধ, দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় পদায়নরত থেকে মির্জা আজমকে গুরু মেনে সিন্ডিকেট পরিচালনা করে আসছেন। বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ ওঠার পর প্রথমে ঢাকঢোল পিটিয়ে তদন্ত শুরু হলেও পরে সব মিটমাট করে ফেলেন ক্ষমতা ও অর্থের বিনিময়ে। ফলে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া এই প্রকৌশলীকে কোনো শাস্তি পেতে হয়নি। চাকরিজীবনে বেশির ভাগ সময় পবিত্র কাটিয়েছেন ঢাকায়।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) উন্নয়ন প্রকল্প, পুলিশ ও র‌্যাবের উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি করেছেন তিনি। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ নামে-বেনামে বিনিয়োগের পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন। রাজধানীতে একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক তিনি।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের ই/এম-৬ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পবিত্র কুমার দাসের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের জন্য ছাত্রলীগ-যুবলীগকে অর্থসহায়তার অভিযোগে আদালতে মামলা হয়েছে। এ মামলায় পবিত্র কুমার দাসের বিরুদ্ধে আন্দোলন দমাতে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ও হামলা করতে অর্থ দেওয়া এবং সাবেক স্বৈরাচার সরকারের দলীয় লোকদের সহযোগিতা করার অভিযোগ আনা হয়। এ মামলায় স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রধান আসামি। এ মামলায় নির্বাহী প্রকৌশলী পবিত্র আসামির তালিকায় ৭ নম্বরে রয়েছেন।

জানা যায়, আওয়ামী লীগ আমলে বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং বিশ^বিদ্যালয় শাখা কমিটিতে নেতা ছিলেন পবিত্র। গণপূর্তে চাকরি পাওয়ার পর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রাতারাতি তিনি কোটিপতি বনে গেছেন। দেশের বাইরে তিনি শতকোটি টাকা পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। বর্তমানে পল্টি দিয়ে বিএনপি সেজে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। গণপূর্তে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করার পর ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তা ধামাচাপা দিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে গত ৪ মে সংগঠনটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক এমপি মির্জা আজমের কাছ থেকে লোভনীয় স্থানে যাওয়ার জন্য কোটি টাকার বিনিময়ে পবিত্র কুমার দাস একটি ‘ডিও লেটার’ নিয়েছেন।

ডিও লেটারে উল্লেখ আছে, পবিত্র কুমার দাস গণপূর্ত (ই/এম) বিভাগ-৬ ঢাকায় কর্মরত। তাকে ই/এম বিভাগ-৪ ঢাকায় বদলি করার জন্য প্রধান প্রকৌশলী বরাবর অনুরোধ করেন মির্জা আজম।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী পবিত্র কুমার দাস গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট ও আলাদা বলয়। দীর্ঘ সময় একই স্থানে থেকে ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তার করে অপকর্ম-দুর্নীতিতে ডুবে রয়েছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে ভয়াবহ অপকর্ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকার পরও তিনি আছেন বহাল তবিয়তে। দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর যাবৎ একই বিভাগে থাকার কারণে তিনি পুরো ই/এম-৬ বিভাগটি দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছেন। পবিত্রের গ্রামের বাড়ি নড়াইল। সাধারণ পরিবারের সন্তান পবিত্র বিলে নয়ছয়, কমিশনের বিনিময়ে পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দেওয়ায় সিদ্ধহস্ত।

জানা যায়, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সংস্কার ও মেরামতে বরাদ্দকৃত ২২টি কাজের মধ্যে মাত্র একটি কাজ সম্পন্ন করেছেন ঠিকাদার। বাকি ২১টি কার্যাদেশের বিপরীতে কোনো কাজই হয়নি। অথচ এর মধ্যেই সব কাজ সম্পন্ন হয়েছে মর্মে ভুয়া ভাউচার দেখিয়ে বরাদ্দের প্রায় ১০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। হাসপাতাল সংস্কার ও মেরামতের মোট ২৭টি কাজের মধ্যে ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৪-এর অধিভুক্ত পাঁচটি এবং গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-৬-এর আওতাধীন রয়েছে ২২টি কাজ। গণপূর্ত ই/এম-৬-এর নির্বাহী প্রকৌশলী পবিত্র কুমার দাস ও উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান রনির তত্ত্বাবধানেই এসব কাজ ঠিকাদারকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কাজ সম্পন্ন না করেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ সম্পন্নের প্রত্যয়নপত্রের জন্য কাগজপত্র দাখিল করেছে। সংশ্লিষ্ট কাজের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী পবিত্র কুমার দাস ও প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান রনি ২২টি কাজে বরাদ্দ থাকা প্রায় ১০ কোটি টাকার ভুয়া ভাউচার দেখিয়ে সেই অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

মুগদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ২২টি সংস্কারকাজের জন্য আলাদা আলাদা কার্যাদেশ দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র একটি কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো সব কাজ সমাপ্ত হওয়ার প্রত্যয়নপত্র চেয়ে কাগজপত্র দাখিল করে। তবে অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধানে কাজের প্রকৃত চিত্র উঠে আসায় প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে অভিযোগ ও গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-৬-এর ২২টি কাজসহ ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৪-এর আওতাধীন পাঁচটি কাজের সরেজমিন পরিদর্শনপূর্বক তদন্তের অনুরোধও জানিয়েছে।

মুগদা হাসপাতালের ওইসব কাজের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন অকেজো সরঞ্জাম মেরামত ও সংস্কার। মেরামত কাজের মধ্যে ছিল হাসপাতাল কম্পাউন্ডে নিরাপত্তার জন্য অকেজো/নষ্ট সিকিউরিটি লাইট, গার্ডেন লাইট, ভবনের চতুর্থতলায় অবস্থিত ফ্লাডলাইট মেরামত বা পরিবর্তনসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ। এ ছাড়া হাসপাতালের পাম্প মটরের অকেজো নষ্ট যন্ত্রাংশ মেরামত বা পরিবর্তনসহ আনুষঙ্গিক কাজও এর আওতাধীন ছিল। আরেকটি কাজ ছিল হাসপাতালের রোগীদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা প্রদানের জন্য হাসপাতালে স্থাপিত ২০০ কেভিএ একটি, ২২৫ কেভিএ দুটি এবং ২৫০ কেভিএ একটি অকেজো বা নষ্ট ডিজেল জেনারেটর সেট মেরামত কিংবা সার্ভিসিংসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ। ভিন্ন ভিন্ন কার্যাদেশে কনফারেন্স রুমে অকেজো বা নষ্ট বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং ফিটিংস ফিকচার মেরামত কিংবা পরিবর্তন; হাসপাতালের পঞ্চমতলার পশ্চিম পাশে স্থাপিত ওয়ার্ডগুলোর অকেজো বা নষ্ট বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং ফিটিংস ফিকচার মেরামত কিংবা পরিবর্তন; মেডিকেল কলেজের নবমতলার পূর্ব পাশে স্থাপিত ওয়ার্ডগুলোর অকেজো বা নষ্ট বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং ফিটিংস ফিকচার মেরামত কিংবা পরিবর্তন; নিয়ন সাইন বোর্ডে অকেজো বা নষ্ট লাইট পাওয়ার সাপ্লাই মেরামত কাজ।

অপরদিকে একাধিকবার অধীনস্থ নারী সহকর্মীদের সাথে পবিত্র কুমার দাসের অনৈতিক সম্পর্কের বিচার করতে হয়েছে গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী শামীম আকতারের। যা অধিদপ্তরের সবাই জানে। উপ-সহকারী প্রকৌশলীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে পারিবারিকভাবে বিভিন্ন সময় ঝামেলা হয়েছে। এর আগে বরিশালে অফিস সহকারীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক নিয়েও আলোচনা আছে। পরে এ ঘটনা মীমাংসা করে দেন প্রধান প্রকৌশলী। সে সময় ওই অফিস সহকারী আত্মহত্যা করতে যান। তার সাবেক এক স্টাফ জানান, গুলশান-বনানী স্যারকে বডিবিল্ডার হিসেবে অনেকেই চিনেন। তিনি সেখানে প্রতি রাতে মদ খেয়ে নারীদের সাথে আড্ডা দেন।

আরবি/জেডআর

Link copied!