১৮৬১ সালের সেই পুলিশ আইনসহ অনেক পুরোনো আইনেই ২০২৪ সালেও চলছে দেশের পুলিশ বাহিনী। প্রায় ১৫০ বছরের পুরোনো এই আইন সংস্কার ও পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, সময়োপযোগী, আধুনিক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছে ‘পুলিশ সংস্কার কমিশন’। চলতি মাসের শুরুতে কাজ শুরু করেছে কমিশন। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক উন্নত দেশে পুলিশ কীভাবে কাজ করে, সেই ধারণাগুলো নেওয়া হচ্ছে। পুলিশের প্রশ্নবিদ্ধ আইনের ধারা পরিবর্তন বা সংশোধন করা হবে। শিগগিরই একটি ওয়েবসাইট খুলে সকল পর্যায়ের মানুষের মতামত নেওয়া হবে। বিশেষ করে সংস্কারের জন্য ‘বাংলাদেশ পুলিশ অধ্যাদেশ ২০০৭’ নামে যে খসড়া প্রস্তাব দীর্ঘকাল ধরে ঝুলে রয়েছে, সেটি যাচাই-বাছাই করে গুরুত্ব দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে আইন আধুনিকায়ন করার মধ্য দিয়ে পুলিশ যাতে জনবান্ধব হয়, সেই লক্ষ্যে তিন মাসের মধ্যে আগামী ডিসেম্বরে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করবে কমিশন। সুপারিশ পেলেই শুরু হবে বাহিনীটির পুনর্গঠন ও সংস্কারকাজ। এ ক্ষেত্রে সব ধরনের সহযোগিতা করছে সরকার। এ লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ আটটি সংস্কার কমিটিও কাজ করছে বলে জানা গেছে।
সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব সফর রাজ হোসেনকে পুলিশ সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান করা হয়েছে। এই কমিশনে সদস্য হিসেবে রয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইকবাল, সাবেক বিভাগীয় কমিশনার ও যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ হারুন চৌধুরী, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক শেখ সাজ্জাদ আলী, ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ গোলাম রসুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহনাজ হুদা, মানবাধিকার কর্মী এ এস এম নাসিরউদ্দিন এলান এবং একজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি। জানতে চাইলে কমিশনের সদস্য সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইকবাল বলেন, ‘পুলিশ সংস্কারের ব্যাপারে সুশীল সমাজসহ সবার মতামত নেওয়া হবে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের পাশাপাশি কিছু সংস্কার কার্যক্রমের সঙ্গে আর্থিক বিষয় থাকবে। কমিটি কয়েক দফা বৈঠক করেছে। পুলিশের মুখ্য উদ্দেশ্যই যেন হয় জনগণকে সেবা দেওয়া, সেভাবেই আধুনিক পুলিশিংয়ের সুপারিশ করবে কমিটি। আশা করছি এই তিন মাসের মধ্যে আমাদের কাজ শেষ হবে।’
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ নির্ভরতায় বাহিনীটির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। সবশেষ আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি ও অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে সবার চক্ষুশূল হয়ে ওঠে পুলিশ। সর্বত্র সমালোচনার মুখে পড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত এই বাহিনী। সরকারের পতনের পর জনরোষে পড়ে প্রায় অর্ধশত পুলিশ সদস্য প্রাণ হারান। দেশের বিভিন্ন এলাকার থানা, ফাঁড়িসহ পুলিশের ২২৪টি স্থাপনা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ভাঙচুর করা হয় আরও ২৩৬টি পুলিশ স্থাপনা। পালিয়ে যান অনেক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দীর্ঘদিন পরও পুলিশ কার্যকর ভূমিকায় যেতে পারেনি। এমন বাস্তবতায় পুলিশ বাহিনী পুনর্গঠন ও সংস্কারের দাবি ওঠে। পুলিশের আচরণে সমস্যার বিষয়ে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন খোদ সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা। ভুক্তভোগীদের মতে, ঢেলে সাজাতে হবে থানা, বাড়াতে হবে প্রশিক্ষণ।
এদিকে প্রশ্ন উঠেছে, তিন মাসের স্বল্প সময়ের মধ্যে এত পুরোনো একটি আইন, দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রতিবেদন দাখিল ও সংস্কার শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে কি না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার বিষয়টি কীভাবে নেবে? তা ছাড়া পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তারাই বা কতটা জবাবদিহি চান, সেটাও দেখার বিষয়। তবে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন জমা সম্ভব হবে বলে সম্প্রতি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সাবেক সচিব সফর রাজ হোসেন।
তিনি বলেন, প্রায় ১৫০ বছরের পুরোনো পুলিশ আইন সংস্কারের সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হবে। এ জন্য তিন মাসের মধ্যে সকল পর্যায়ের মানুষের মতামত নেওয়া হবে। এরপর সুপারিশ পেলেই শুরু হবে পুলিশ বাহিনী পুনর্গঠন ও সংস্কারের কাজ।
সংস্কারের কোন জায়গাটায় গুরুত্ব দেওয়া হবে এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই স্বরাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘১৮৬১ সালের সেই পুলিশ আইনসহ অনেক পুরোনো আইনের তো তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। পুলিশ আইন আধুনিকায়ন করা উচিত। পুলিশ যাতে জনবান্ধব হয়, সেটা নিয়ে কাজ করব। পুলিশের মুখ্য উদ্দেশ্যই যেন হয় জনগণকে সেবা দেওয়া। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশ কীভাবে কাজ করে, সেই ধারণাগুলো আমরা নিচ্ছি।’
এদিকে পুলিশের সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের বিষয়ে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘এগুলো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। কারণ, সব রাজনৈতিক দলই চায় পুলিশকে সঙ্গে রাখার জন্য। এটা দুনিয়ার সব জায়গাতেই হয়। আমাদের মতো দেশে একটু বেশি হয়। সংস্কার বা পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় যা দেখানো হয়েছিল, সেই হিসাবে পুলিশ সম্পূর্ণ স্বাধীন। আমাদের মতো তৃতীয় বিশে^র দেশে পুলিশের কি স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ আছে? অন্যদিকে পুলিশ কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পুলিশ বাহিনী পুনর্গঠনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পুলিশ এবং ইউনাইটেড ন্যাশন্স ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম বা জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি খসড়া প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছিল, যে কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছিল সাবেক আইজিপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ এস এম শাহজাহানকে। এই কমিটি ২০০৭ সালের মে মাসে কাজ শুরু করে। পরে তারা একটি খসড়া সংস্কার আইন জমাও দিয়েছিল। কিন্তু সেই সংস্কার প্রস্তাব আজও আলোর মুখ দেখেনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো এক কক্ষের ফাইল কেবিনেটে সেটি এখন বন্দী হয়ে আছে। কমিটির পক্ষ থেকে একটি খসড়া অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হলেও নানান বাস্তবতায় তা আলোর মুখ দেখেনি। পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, প্রস্তাবিত সংস্কার আইনটি বাস্তবায়িত না হলেও সময়ের প্রয়োজনে পুলিশের সংস্কার প্রতিনিয়তই হচ্ছে।
একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ২০০৭ সালে ‘বাংলাদেশ পুলিশ অধ্যাদেশ, ২০০৭’ নামে যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা যুগোপযোগী একটি প্রস্তাব। উন্নত রাষ্ট্রের পুলিশ কাঠামোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে করা হয়েছে।
পুলিশ অধ্যাদেশে এমন কিছু বিধানের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা কার্যকর হলে পুলিশের বিদ্যমান অনেক সমস্যা দূর হবে। যেমন পুলিশ সদস্যদের ওপর রাজনৈতিক খবরদারি করার সুযোগ থাকবে না, চার স্তরে পুলিশের জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকবে। জাতীয় পুলিশ কমিশন, অভিযোগ কমিশন, নীতিনির্ধারণী গ্রুপ গঠন ইত্যাদি বিধান কার্যকর করার মধ্য দিয়ে পুলিশে ব্যাপক সংস্কার হবে। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন পুলিশ বিভাগের জন্য পৃথক পুলিশ বিভাগ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে, যে বিভাগের প্রধানের পদবি হবে ‘চিফ অব পুলিশ’। চিফ অব পুলিশের অধীনে থাকবেন ইন্সপেক্টর জেনারেল, অতিরিক্ত ইন্সপেক্টর জেনারেল, ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল থেকে শুরু করে পুলিশের অন্য পদবির কর্মকর্তারা। পুলিশ বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেলদের মধ্য থেকে একজনকে সরকার চিফ অব পুলিশ হিসেবে নিয়োগ দেবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, অতীতে পুলিশের পেশাদার হতে না পারার পেছনে জনবলের সংকট, বাজেটের স্বল্পতা ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতাকেই প্রধান কারণ হিসেবে দেখানো হতো। তবে ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৩) এই ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। এই সময়ে পুলিশে ৮৩ হাজার ৭০টি পদ সংযোজন করা হয়। ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য উচ্চপর্যায়ের ১৭৮টি পদ সৃষ্টি করা হয়। ১ লাখ ২০ হাজার জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়। এই জনবলের বড় অংশই নেওয়া হয় দলীয় ও রাজনৈতিক বিবেচনায়। জননিরাপত্তা বিভাগের গত নভেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে পুলিশের মোট সদস্যসংখ্যা প্রায় ২ লাখ ১৩ হাজার।
এ প্রসঙ্গে সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, পুলিশের জন্য জরুরি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত কাজের পরিবেশ তৈরি করা।
পুলিশের কোনো সদস্য গুরুতর অপরাধে জড়ালে বাহিনীর বাইরে আলাদা একটি কমিটি থাকবে, যারা এর তদন্ত করবে। এই কমিটির যেন শাস্তির সুপারিশ করার ক্ষমতা থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশের আচরণে সমস্যার বিষয়ে কাজ করতে হবে। নিয়মকানুন মেনে পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে। নিয়োগ-বদলি, পদোন্নতি শতভাগ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :