ঢাকা শনিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর

২০ হাজার কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি করছে সরকার

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৭, ২০২৫, ১২:৫৫ পিএম

২০ হাজার কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি করছে সরকার

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

গাজীপুর সদরের উদ্যোক্তা তামিমা আক্তার ন্যান্সি। হোমিওপ্যাথি বিষয়ে পড়াশোনা শেষে প্র্যাকটিস না করে কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে ভালো করায় এটাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন। তামিমা আক্তারের স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও এখন কাজ ছেড়ে দিয়ে তার ব্যবসায় মনোযোগী হয়েছেন।  

তামিমা আক্তার বলেন, ‘আমার এ উদ্যোক্তা হওয়ার ব্যাপারে পরিবারের সবার কাছ থেকে অনেক সাপোর্ট পেয়েছি। ইতিমধ্যে আমি অফিস তৈরি করেছি। ব্যবসার জন্য টিআইএন, ট্রেড লাইসেন্স করেছি। বিপণনের যে লাইসেন্সগুলো দরকার হয় সবগুলো করেছি।’

তিনি আরো বলেন, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাধ্যমে আমি বিষয়গুলো জানতে পেরেছি। আমি সেখানে ট্রেনিং নিয়ে একজন স্বাবলম্বী উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে চাই।’

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা তাসলিমা সিকদার। তিনি বলেন, ‘করোনাকালে চাকরিটি চলে যাওয়ার পর আমি আর্থিক সমস্যায় পড়ি। তখন সব সময় মাথায় থাকত কিছু একটা করি। শেষে মাথায় এলো ফুড নিয়ে কাজ করার। করোনা থেমে যাওয়ার পর থেকেই আমি ফুড নিয়ে কাজ করছি। সেই থেকে পথচলা শুরু, যা এখনো চলছে।’

তাসলিমা সিকদারের পণ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম ডেইরি, বাটার ও ঘি। এ ছাড়া তিনি সিজনাল পণ্য হিসেবে আম, জাম, কাঁঠাল, তেঁতুল, বরই ও জলপাইয়ের আচার তৈরি করেন। সেই সাথে আছে আমসত্ত্ব¡, কাঁঠালসত্ত্ব ও মাছের চিপস। তিনি বলেন, ‘এ জাতীয় প্রোডাক্টগুলো নিয়ে আস্তে আস্তে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমি নিজেকে তৈরি করে ফেলি। এ নিয়ে আমি প্রচুর ট্রেনিং করেছি, এটা নিয়েই আমি আমার প্রোডাক্টগুলোকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি।’ আর্থিক সমস্যা ছিল, কিন্তু সেটা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কৃষি উদ্যোক্তা তৈরির বিষয়ে কীভাবে জানলেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সাথে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া ও নেওয়ার মাধ্যমে জড়িত। সেই সুবাধে জানতে পেরেছি পার্টনার (ডিএএম অঙ্গ) প্রোজেক্টের বিষয়ে।’

তামিমা আক্তার ন্যান্সি বা তাসলিমা সিকদারই নয়, উদ্যমী ও তরুণদের আয়বর্ধন কাজে নিয়োজিত করতে দেশব্যাপী উদ্যোক্তা তৈরির কাজ করছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উদ্দেশ্য তরুণ ও যুবকদের আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করা। এরই ধারাবাহিকতায় সারা দেশে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন ‘প্রোগ্রাম অন অ্যাগ্রিকালচালাল অ্যান্ড রুরাল ট্রান্সফরমেশন ফর নিউট্রিশন, অ্যান্টারপ্রেনারশিপ অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স ইন বাংলাদেশ (পার্টনার-ডিএএম অংগ)’ প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে ২০ হাজার তরুণ এবং নারী কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি কাজ করছে সরকার। চলতি বছর সারা দেশে ৩ হাজার  নারী ও পুরুষকে ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের ৮টি বিষয়ে ১২ দিনের অন দ্য জব প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। হাতে-কলমে প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য সরকারি বা বেসরকারি কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে পার্টনার (ডিএএম অঙ্গ) প্রকল্পের সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে উদ্যোক্তারা কৃষি ব্যবসায় নিয়োজিত হয়ে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারবে। উদ্যোক্তাদের কৃষি ব্যবসায় উদ্যোগ টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে ইনকিউবেশন সাপোর্টে প্রদান করা হবে। পার্টনার (ডিএএম অঙ্গ) প্রকল্প থেকে অগ্রগামী উদ্যোক্তাদের ম্যাচিং গ্রান্টের মাধ্যমে পরিবহন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্রপাতি দেওয়া হবে। জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে উদ্যোক্তা মেলা আয়োজন করা হবে। সেরা উদ্যোক্তাদের জন্য থাকবে জাতীয় এবং বিভাগীয় পর্যায়ের পুরস্কারের ব্যবস্থা।

এ ছাড়া প্রকল্প থেকে ৫টি কৃষিপণ্য যেমন- আলু, আম, কাঁঠাল, টমেটো এবং সুগন্ধি চালের ভ্যালুচেইন প্রমোশনাল বডি গঠন করা হবে। ইতিমধ্যে ভ্যালুচেইন প্রমোশনাল বডির নীতিমালা কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে। এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরে ৭৬০ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে।  

জানা গেছে, প্রশিক্ষিত উদ্যোক্তাদের ম্যাচিং গ্রান্ট সহায়তা করা হবে। ম্যাচিং গ্রান্ট হিসেবে গৃহপর্যায়ে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ যন্ত্রপাতি দেওয়া হবে। এসব যন্ত্রপাতি ক্রয়ে প্রকল্প থেকে ৭০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হবে। বাকি ৩০ শতাংশ উদ্যোক্তারা নিজে বহন করবে। মাঠপর্যায়ে স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে ভ্যালুচেইন প্রমোশনাল বডি প্রস্তুত করার জন্য ১৫ ক্যাটাগরির ২৫ জন করে সদস্য নিয়ে মার্কেট এক্টর বিজনেস স্কুল গঠন করা হচ্ছে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পার্টনার (ডিএএম অঙ্গ)-এর এজেন্সি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ড. মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল-ফারুক বলেন, ‘চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩ হাজার উদ্যোক্তাকে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, কৃষি উপকরণ এবং কৃষি যন্ত্রপাতি সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এসব প্রশিক্ষণ ১০টি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, কৃষি উপকরণ এবং কৃষি যন্ত্রপাতি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে হাতে-কলমে প্রদান করা হবে। প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য এ বছর ১০টি প্রতিষ্ঠানের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। পরবর্তীতে আরো ২০টি প্রতিষ্ঠানের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে অন দ্যা জব প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।’ 
তিনি আরো বলেন, ‘প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর প্রশিক্ষিত উদ্যোক্তাদের ইনকিউবেশন সাপোর্ট প্রদান করা হবে। তাদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য যেসব বাধা রয়েছে তা দূর করার প্রক্রিয়া নিয়ে ইনকিউবেশন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কাজ করবে। 
উদ্যোক্তাদের দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক অগ্রগতির কাণ্ডারি উল্লেখ করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. মাসুদ করিম বলেন, ‘উদ্যোক্তারা শুধু নিজে স্বাবলম্বী হয় না, তারা সমাজের আরও দশজনকে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়। বিশ্ব অর্থনীতিতে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হতে হলে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদেরও বিভিন্ন নতুন নতুন ধ্যান-ধারণা নিয়ে কাজ করে সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে।’

‘এই প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি করে কৃষিকে আধুনিক ও সম্মানজনক পেশায় পরিণত করা সম্ভব হবে। প্রশিক্ষণ নেওয়া উদ্যোক্তারা তাদের প্রাণচাঞ্চল্য, কর্মস্পৃহা এবং জীবনীশক্তি দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবেন’  বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে ৫ বছরে ২০ হাজার উদ্যোক্তা তৈরি করবে। যার মধ্যে ৬০ শতাংশ নারী ও ৪০ শতাংশ পুরুষ। অর্থাৎ ১২ হাজার মহিলা ও ৮ হাজার পুরুষ উদ্যোক্তা তৈরি করা হবে। উদ্যোক্তাদের বয়স পুরুষদের ক্ষেত্রে ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে এবং নারীদের ক্ষেত্রে ১৮ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে হতে হবে।

আরবি/জেআই

Link copied!