ঢাকা শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৪

‘এডিস এলবোপিকটাস’ মশাতে গ্রামে ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু

উৎপল দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৬, ২০২৪, ১২:২২ পিএম

‘এডিস এলবোপিকটাস’ মশাতে গ্রামে ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু

ছবি: রুপালী বাংলাদেশ

প্রাদুর্ভাব, এপডেমিক স্তর পেরিয়ে এখন ‘এনডেমিক’
সিটির বাইরে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান
মশক নিধনে যথাযথ পদক্ষেপের অভাবসহ তিন কারণে আক্রান্ত বাড়ছে
জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়তে পারে ‘পিক সিজনের’ সময়    
২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু ১, ভর্তি ৪৭৭

এডিস ইজিপ্টি প্রজাতির স্ত্রী মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগ এখন ‘এনডেমিকে’ পরিণত হয়েছে। ডেঙ্গু রোগটি এর আগে ‘আউটব্রেক’ ও ‘এপিডেমিক’ স্তর পার হয়ে এনডেমিকে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ ডেঙ্গু রোগের এখন আর কোনো মৌসুম নেই। সব মৌসুমেই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে মানুষ। তবে রোগটির ‘পিক সিজন’ সময়ে সময়ে পরিবর্তন হতে পারে। তবে নতুন তথ্য হচ্ছে, গ্রামে ইদানীং নতুন একটি মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। মশার এই প্রজাতির নাম হচ্ছে- ‘এবিস এলবোপিকটাস’।  

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড হেলথ প্রমোশন ইউনিটের সমন্বয়ক ও রোগতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ডা. ইকবাল কবির রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ডেঙ্গু এখন প্রাদুর্ভাব, এপিডেমিক স্তর পার হয়ে এনডেমিকে পরিণত হয়েছে। বছরজুড়েই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে মানুষ।

তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু এতদিন শহরের রোগ হিসেবে চিহ্নিত হলেও ইদানীং গ্রামে এবিস এলবোপিকটাস নামের নতুন প্রজাতির একটি মশার মাধ্যমে মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে।

জলবায়ুর পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ণ ও মশক নিধনে যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে মন্তব্য করে এই রোগতত্ত্ববিদ বলেন, রোগটি প্রতিরোধের জন্য তিনটি কাজ করা অত্যন্ত জরুরি- এক. রোগটি যাতে না হয় সেজন্য মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার করা, দুই. ‘কেইস বেইজড সার্ভিলেন্স’ অর্থাৎ প্রতিটি আক্রান্ত ব্যক্তির তথ্য অবহিত হয়ে ওই এলাকায় নজরদারি এবং তিন. করোনাকালীন সময়ের মতো রোগীকে ‘আইসোলেশনে’ রাখা, যাতে কোনো মশা আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড় না দিতে পারে।

তিনি আরও জানান, আগে ‘জুলাই থেকে অক্টোবর’ ডেঙ্গুর মৌসুম ধরা হলেও চলতি বছর তা পরিবর্তিত হয়েছে ‘অক্টোবর থেকে জানুয়ারি’। এই রোগতত্ত্ববিদের আশঙ্কা, সামনের দিনগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাওয়া তথ্য ও পরিসংখ্যান থেকেও এই রোগতত্ত্ববিদের ভাষ্য প্রমাণিত হয়েছে। জানা গেছে, ডেঙ্গু একসময় রাজধানী ও সিটি করপোরেশন এলাকায় বেশি হলেও এবার সিটির বাইরেও তা ছড়িয়েছে সমানতালে। জানুয়ারি থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ৫৪ হাজার ২২৫ জনের মধ্যে সিটি করপোরেশন এলাকায় পুরুষ ১২ হাজার ৯৭৭ ও নারী ৯২৭৪ সহ রয়েছেন মোট ২২ হাজার ২৫১ জন। একই সময় সিটি করপোরেশনের বাইরে আক্রান্ত হয়েছেন পুরুষ ২১ হাজার ৩৩৯ জন ও নারী ১০ হাজার ৬৩৫ সহ মোট ৩১ হাজার ৯৭৪ জন। তবে সিটির বাইরে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলেও মৃত্যু বেশি সিটি করপোরেশনে। জানুয়ারি থেকে অক্টোবরের ২৪ দিনে সিটি করপোরেশন এলাকায় পুরুষ ৮৩ ও নারী ৯৭ সহ মোট মৃত্যু ১৮০। অন্যদিকে সিটির বাইরে পুরুষ ৪২ ও নারী ৪৬ সহ মোট মৃত্যু ৮৮।  

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি মাসের গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৫৪ হাজার ২২৫ জন। এই সময়ে মারা গেছে মোট ২৬৮ জন। জানুয়ারিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় ১০৫৫ জন। এ মাসে আক্রান্তদের মধ্যে মারা যায় ১৪ জন। চলতি মাসের গত ২৪ দিনে আক্রান্ত হয় ২৩ হাজার ২৮৭ জন। এই সময়ে মারা গেছে ১০৫ জন। অর্থাৎ চলতি মাসে গড়ে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ৪ জনের বেশি। বছরের প্রথম মাসেই ভয় ধরানো সংখ্যায় শুরু হলেও বছরের শেষে এসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত বেড়ে গেছে তেইশ গুণ। আর মৃত্যু বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৭ গুণ। বিশেষ করে আগস্টের প্রথম দিন থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৮৫ দিনে আক্রান্ত হয়েছে ৪৭ হাজার ৯০৫ জন। এই সময়ে মৃত্যু হয়েছে ২১২ জনের। অর্থাৎ মোট মৃত্যুর ৯০ শতাংশেরও বেশি হয়েছে এই সময়ে।

বছরের প্রথম থেকে ডেঙ্গুর চোখ রাঙানির বিষয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বারবার সতর্ক করছেন। তারপরও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কমছে না কেন সে বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, মূলত মশক নিধন কার্যক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় ডেঙ্গুর প্রকোপ কমানো যাচ্ছে না।

ডিএসসিসি সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন স্থানে পৌরসভা কার্যালয় ভাঙচুর হয়। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর মেয়র ও কাউন্সিলরদের অপসারণ করা হয়। বর্তমানে সিটি করপোরেশন এলাকায় ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের দাপ্তরিক কাজ করা সচিবদের মাধ্যমে মশক নিধন কার্যক্রম চললেও তেমন জোর পাচ্ছে না। 
অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র দাবি করে, মশক নিধন ভালোভাবে হলে ডেঙ্গু আক্রান্ত কমবে। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা যথাযথভাবে হচ্ছে কি না- তার দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। তবে মশক নিধন যথাযথ না হওয়ায় মৃত্যু কমানো যাচ্ছে না বলে দাবি সূত্রের।

এদিকে ডেঙ্গু চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ভালো চলছে মন্তব্য করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. শফিউর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, মোটামুটি সবকিছুই স্বাভাবিক। রোগীদের আক্রান্তের লক্ষণগুলোও একইরকম।

অন্যদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ  (ঢামেক) অ্যান্ড হাসপাতালে গত পাঁচ দিন ধরে ডেঙ্গু চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত ডা. রাশেদ বলেন, ঢাকা মেডিকেলের পরিস্থিতিও মোটামুটি স্বাভাবিক। তিনি জানান, গত পাঁচ দিনে ডেঙ্গুতে মেডিকেলে কোনো মৃত্যু নেই। হাসপাতালে নারী ও পুরুষ মিলিয়ে রোগী ভর্তির সংখ্যা গড়ে ১০ থেকে ১৫। তবে আউটডোরে প্রায় প্রতিদিনই এ-সংক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে তিনি জানান। তবে এর সংখ্যা জানাতে পারেননি।  

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাওয়া তথ্য ও পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, জানুয়ারি থেকে চলতি মাসের গত ২৪ দিনে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৫৪ হাজার ২২৫ জন। এ সময়ে মারা গেছেন মোট ২৬৮ জন। এই হিসাবে প্রতি সপ্তাহে আক্রান্ত হচ্ছেন ৫৬৪৩ জন। আর প্রতি সপ্তাহে মৃত্যু হচ্ছে ২৭ জনের। আক্রান্ত ও মৃত্যু দুটোই ক্রমবর্ধমান।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনায় তাৎপপর্যপূর্ণ যে বিষগুলো ওঠে এসেছে তার মধ্যে রয়েছে- ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মোট ৫৪ হাজার ২২৫ জনের ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও সিটির বাইরে তিন স্থান মিলিয়ে রয়েছে ৩১ হাজার ২৪ জন। অর্থাৎ মোট আক্রান্তের অর্ধেকেরও বেশি ঢাকা বিভাগে। অন্যদিকে এখন পর্যন্ত মোট ২৬৮ মৃত্যুর মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও সিটির বাইরে তিন স্থান মিলিয়ে রয়েছেন ১৮৯ জন। অর্থাৎ মৃত্যুতেও শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিভাগ। অন্যদিকে আক্রান্তের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম ৯ হাজার ৮২৬ জন।
ডেঙ্গুতে পুরুষ বেশি আক্রান্ত হলেও মৃত্যু বেশি হয়েছে নারীর। আক্রান্তের ক্ষেত্রে পুরুষ ৬৩ দশমিক ৩ শতাংশ হলেও নারী আক্রান্ত হয়েছেন তুলনামূলক অর্ধেকের কিছু বেশি ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে মৃত্যু বেশি নারীর। এক্ষেত্রে পুরুষ ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ হলেও নারী মৃত্যুর হার ৫৩ দশমিক ৪ শতাংশ।

ডেঙ্গুতে ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু ১, আক্রান্ত ৪৭৭: দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৭৭ জন। এই সময়ে মশাবাহিত রোগটিতে একজনের মৃত্যৃ হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে ৫৪ হাজার ৭০২ জন হলো। তাদের মধ্যে ২৬৯ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে মশাবাহিত রোগটি। নতুন রোগীদের মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ২২৮ জন, ঢাকা বিভাগে ১১৪ জন, ময়মনসিংহে ১২ জন, চট্টগ্রামে ৩৯ জন, খুলনায় ৩৩ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৯ জন, রংপুর বিভাগে ৫ জন, বরিশাল বিভাগে ২৫ জন এবং সিলেট বিভাগে দুজন রোগী ভর্তি হয়েছেন। যিনি মারা গেছেন, তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৫০ হাজার ৬৪৭ জন রোগী। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩৭৮৬ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ১৮২৭ জন। আর ১৯৫৯ জন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
এ বছর মোট ভর্তি রোগীদের মধ্যে ৩১ হাজার ৫৮৬ জন ঢাকার বাইরের রোগী। ঢাকার দুই মহানগর এলাকার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৩ হাজার ১১৬ জন।

অক্টোবরের ২৫ দিনে ২৩ হাজার ৭৬৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে ১০৬ জনের। এ বছর এক মাসে এটাই সর্বোচ্চ ভর্তি ও মৃত্যু।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য রাখে ২০০০ সাল থেকে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে এ রোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ১৭০৫ জনের মৃত্যুও হয় ওই বছর।

আরবি/জেআই

Link copied!