ঢাকা: নিষিদ্ধ জগতে অস্ত্রের পর সবচেয়ে লাভবান ব্যবসা মাদক। বিশেষ করে ফেনসিডিল ও ইয়াবা সহজলভ্য ও বহনযোগ্য বলে এর বিস্তার দেশজুড়ে। দেশের এমন কোনো এলাকা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে মাদকের থাবা নেই। শহর থেকে গ্রাম সবখানেই ছবিয়েছে মাদকের জাল। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষজন জড়িয়েছে মাদক কারবারে। ব্যবসা পরিচালনা করতে আশ্রয় নেয় বিভিন্ন কৌশলের। দেশজুড়ে এক বিশাল জাল বিস্তার করে আছে এই মরণ নেশার ভয়াবহ সিন্ডিকেট।
আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্র মাফিয়াদের সঙ্গে রয়েছে এদের শক্ত ও গভীর যোগাযোগ। মাদকের রয়েছে বিভিন্ন রুট। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দর, সীমান্ত এলাকায় মাদকের ছড়াছড়ি। এর কিছু ধরা পড়ে। বাকিটা চলে যায় মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের কাছে। মূলত এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক শক্তি। প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছাড়ায় হয়ে উঠে আরো প্রভাবশারী। রাজধানীতেও মাদকব্যবসা রমরমা। মাদকের জগতে এক সময় ‘হেরোইন’ নামক মরণ নেশা ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল। এ পদার্থটি মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ করে অবধারিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এটি খুব দামি বলে পরবর্তী সময়ে এর স্থান দখল করে নেয় ফেনসিডিল ও ইয়াবা। বর্তমান তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এ দুটি নেশাদ্রব্য বেশি জনপ্রিয়। একে ঘিরে দেশব্যাপী গড়ে উঠেছে বিশাল নেটওয়ার্ক। মদ ফেনসিডিলের চেয়ে ইয়াবাই বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
সারা দেশে সক্রিয় লক্ষাধিক মাদক কারবারি। তাদের মধ্যে ‘গডফাদার’ হিসেবে পরিচিত শীর্ষ মাদক কারবারির সংখ্যা শতাধিক। তাদের নিয়ন্ত্রণে মাঠ পর্যায়ে সক্রিয় রয়েছে বিপুলসংখ্যক খুচরা বিক্রেতা। এই তথ্য পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি)। জানা যায় এখন মাদক হোমডেলিভারি ও দেয়া হয়। অনলাইনেও ছড়িয়েছে মরন নেষার জাল।
মাদকসংশ্লিষ্ট অর্থ পাচারের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। আর এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। বাংলাদেশ থেকে মাদকের কারণে প্রতিবছর পাচার হয়ে যায় ৪৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। আর মাদক কেনাবেচা করে অর্থ পাচারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। এশিয়ার দেশগুলো বিবেচনায় নিলে মাদকের মাধ্যমে টাকা পাচারের ঘটনায় বাংলাদেশ একেবারে শীর্ষে রয়েছে।
রাজধানী ঢাকার সর্বত্র এখন মাদক বিক্রির স্পট। রাজধানীর ৬টি এলাকাকে মাদকের রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করেছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। রেড জোনে রয়েছে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, মহাখালীর কড়াইল বস্তি, কালশী বিহারি ক্যাম্প, কারওয়ান বাজার, খিলগাঁও ও যাত্রাবাড়ী। এ ছাড়া ইয়েলো ও গ্রিন জোনের তালিকায় রয়েছে পুরো রাজধানী। গলির মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে সম্প্রতি মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে ঝড়ছে প্রাণ। এমনকি হত্যার পর নেচে গেয়ে উৎসব পর্যন্ত করছে জেনেভা ক্যাম্পের মাদক সিন্ডিকেটের গডফাদাররা। বিচারতো দূরে থাক উল্টো নিহতের পরিবারের নামেই দেয়া হচ্ছে মামলা। যৌথ বাহিনীর অভিযানেরও পর প্রকাশ্যে গুলি করা এসব সিন্ডিকেট সদস্যরা ক্যাম্পের মধ্যেই অবস্থান করছেন। পুলিশ বলছে, জড়িতদের গ্রেপ্তারে ভিডিও ফুটেজ দেখে চলছে অভিযান। প্রায় প্রতিরাতেই চলছে যৌথ বাহিনীর অভিযান। গ্রেফতার হলেও থেমে নেই ব্যবসা। প্রশাসনের অভিযান আরো নড়ে চড়ে বসে মাদক ব্যবসায়ীরা। নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে তারা।
মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে ৯টি সেক্টর আর ৩০টির বেশি সরু রাস্তায় বিভক্ত এই এলাকা। মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘর্ষ-প্রাণহানি যেন এখানে নিত্য ঘটনা। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ঘটনা গড়ায় বোমাবাজিতে পর্যন্ত। এতে প্রাণ ঝরে নিরীহ বাসিন্দাদেরও। গলির একটি ঘরটি থেকে রেশমা নামের মায়ের হাতে ভাত খেয়ে সেদিন বের হয়েছিলো সাগর (২৬)। গলিতে যাওয়া মাত্রই অতর্কিত গুলিতে হাসপাতাল পর্যন্ত যাওয়ার ভাগ্য হলেও, বেঁচে আর ঘরে ফেরা হয়নি। ছোট্ট মেয়েটি আজও বাবার অপেক্ষায়। পরিবার বলছে, প্রত্যেকটি হত্যার পর ক্যাম্পে আনন্দ-উল্লাস পর্যন্ত করে এসব সন্ত্রাসীরা। নতুন সম্রাট হয় মাদকের এই সাম্রাজ্যে।
একটি ভিডিও ফুটেজে স্পষ্ট ছবি আছে এসব হত্যাকারীদের, তবুও এখন পর্যন্ত ধরাছোয়ার বাইরে তারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই ফুটেজে সামনে থেকে যাকে গুলি করতে দেখা যাচ্ছে তার নাম জাম্বু, কটি পড়া আরেক জনকে দেখা যায় সেই যুবকের নাম সেলিম ওরফে চুয়া সেলিম, পেছনে অস্ত্র হাতে থাকা যুবক আকরাম। ছাদ থেকে হলুদ গেঞ্জি পড়া যে যুবকটি ককটেল ছুড়ছে তার নাম পারভেজ, মূলত পারমনুরের নেতৃত্বে থাকা এই গ্রুপটি পাঁচ আগস্ট পরবর্তী ক্যাম্পের বেশিরভাগ গলির মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রন নেয়। সাত নম্বর গলির নিয়ন্ত্রন নিতেই এখনো চলছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। ৭ নাম্বার গলি নিয়ন্ত্রনে নিতেই চলে তাদের এই গোলাগুলি। সেই গুলিতে নিহত হয় হতভাগ্য সাগর। ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানান সাগর জড়িত নয় মাদক ব্যবসায়। ক্যাম্পে অভিযুক্তদের খুঁজেও দিনের আলোতে তাদের দেখা মেলেনি। তবে ভিডিওতে না দেখা গেলেও ঘটনার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে আলোচনায় আসা সেই ভূইয়া সোহেলের সঙ্গে কথা হয় টেলিফোনে। সে জানান মাদক ব্যবসায় তিনি জড়িত নয়। তার দাবী অন্যরা করে মাদক ব্যবসা। ক্যাম্পের মাদক কারবারিরা দিনের বেলায় ঘুমায় রাতের বেলায় অন্ধকারে করে তাদের জমজমাট ব্যবসা। কেউ বাধা দিলে তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে দ্বিধা করে না।
নিরাপত্তা জোরদারে বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ বসালেও স্থানীয়রা বলছেন ক্যাম্পের মধ্যে এখনো সক্রিয় সবাই। তবে পুলিশ বলছে, নিয়মিত অভিযান চলছে। র্যা ব পুলিশের সহায়তায় সেনাবাহিনীর অভিযানও চলছে নিয়মিত। তবে ধরা পড়ছে না মূল কুশীলবরা।
জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন স্ট্রান্ডেড পাকিস্তানিজ জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশন্সের (এসপিজিআরসি) সভাপতি আব্দুল জব্বার খান বলেন, ‘এরা যদি স্থায়ীভাবে কর্মে ঢুকতে পারে, তাহলে মাদক বিক্রির প্রবণতা কমে আসবে। ক্যাম্পে বসবাসকারীদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা জরুরি।’ তিনি আরো বলেন, ‘কেউ তো নিজ ইচ্ছায় খারাপ কাজে জড়াতে চায় না। মাদক বিক্রি বন্ধ করতে হলে জেনেভা ক্যাম্পে কর্মসংস্থান জরুরি। সবাইকে কাজের সুযোগ দিতে হবে।’
আপনার মতামত লিখুন :