শিক্ষার্থীদের তিন আন্দোলন ঘিরে গতকাল বুধবার রাজধানী রূপ নিয়েছিল বিক্ষোভের শহরে। এর মধ্যে শাহবাগে ৩৫+ চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলন পুলিশের বাধায় পন্ড হয়েছে। সায়েন্সল্যাবে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে দীর্ঘ আট ঘণ্টা ‘ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করে ৩ নভেম্বর ফের ব্লকেড ও অনশন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে তারা।
একই জায়গায় অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষসহ চার শিক্ষককে অপসারণের দাবিতে গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ করেছে সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা।
তিন আন্দোলন ঘিরে চাকরিপ্রত্যাশীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ ও সড়ক অবরোধে মিরপুর রোড ও আশপাশের সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে নীলক্ষেত মোড় থেকে আজিমপুর পর্যন্ত এবং সায়েন্সল্যাব মোড় থেকে ধানমন্ডি ২৭ পর্যন্ত সড়কে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ যানজট।
এদিকে সাত কলেজের স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিসহ শিক্ষা খাতের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ শিক্ষাঙ্গনে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
উপদেষ্টা বলেন, শিক্ষা খাতে শৃঙ্খলা ও স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। এসব দাবি-দাওয়ার মধ্যে ন্যায্য-অন্যায্য এবং কিছু ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী দাবিও আছে। একটি বৈষম্যবিরোধী দাবি মানলে অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষা খাতের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের দাবি পূরণের সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকে এবং এর জন্য তাৎক্ষণিক সমাধান দেওয়া কঠিন। অথচ সব কটি দাবির পেছনের আন্দোলনকারীরা তাদের দাবিকেই সবচেয়ে অগ্রাধিকার হিসেবে দেখছেন এবং দাবিগুলো শুধু রাস্তায় আন্দোলন করে তাৎক্ষণিক সমাধানযোগ্য মনে করছেন। এতে একদিকে যেমন রাস্তা অবরোধের ফলে অপরিসীম জনদুর্ভোগ হচ্ছে; সরকারও দাবিগুলো যথাযথ বিবেচনার সুযোগ পাচ্ছে না।
উপদেষ্টা জানান, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের দাবি বিবেচনার জন্য সরকার ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটি সাত সপ্তাহের মধ্যে একটি প্রতিবেদন তৈরি করবে।
উপদেষ্টা বলেন, শিক্ষার্থীদের অবরোধ, আন্দোলন ও আলটিমেটামের মাধ্যমে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দেওয়ার কোনো নজির কোথাও নেই। তাই শিক্ষার্থীদের রাস্তায় জনদুর্ভোগ তৈরি না করে ধৈর্য ধরার এবং নিজ নিজ শিক্ষাঙ্গনে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানান শিক্ষা উপদেষ্টা।
৭ কলেজের আন্দোলন : শিক্ষা উপদেষ্টার বক্তব্যে হতাশা প্রকাশ করে আগামী ৩ নভেম্বর রোববার ফের ব্লকেড ও অনশন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকেল ৫টায় অবরোধ শেষে এই কর্মসূচির ঘোষণা দেয় সাত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর টিম।
প্ল্যাটফর্মটির ফোকাল পার্সন আবদুর রহমান বলেন, ‘শিক্ষা উপদেষ্টার বিবৃতি শিক্ষার্থীদের হতাশ করেছে। তাই, অনতিবিলম্বে শিক্ষাবিদ, শিক্ষার্থী প্রতিনিধির সমন্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবি জানাচ্ছি।’
তিনি জানান, আজ বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত অনলাইনে প্রচারণাসহ প্রতিটি কলেজের ডিপার্টমেন্টভিত্তিক অনলাইনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে।
সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের তিন দাবির মধ্যে রয়েছে- ১. অনতিবিলম্বে সাত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন গঠন করতে হবে; ২. এই কমিশন বিভিন্ন বিষয় যাচাই-বাছাই করে ৩০ দিনের মধ্যে একটি রূপরেখা প্রণয়ন করবে; ৩. স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কোনো সেশনজট তৈরি হতে পারবে না। যত দিন বিশ্ববিদ্যালয় গঠন না হবে, তত দিন সেশনজট যেন না হয় সেভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে নিতে হবে।
৩৫+ চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলন : সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে আন্দোলনরত চাকরিপ্রত্যাশীদের মিছিল লাঠিচার্জ করে ও জলকামান দিয়ে পানি ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে পুলিশ। গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে রাজধানীর শিক্ষা ভবনের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বুধবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে অবস্থান নেন ৩৫ প্রত্যাশী আন্দোনকারীরা। কিন্তু তাদের দাঁড়াতে দেয়নি পুলিশ। পরে দুপুরে তারা মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের দিকে যেতে থাকলে পুলিশ লাঠিচার্জ এবং জলকামান থেকে তাদের ওপর গরম পানি ছিটাতে শুরু করে। এতে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পুলিশের লাঠিচার্জে বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার দাবি করেছেন ৩৫ প্রত্যাশীরা।
সিটি কলেজ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ : সিটি কলেজের অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের অপসারণ ও চার শিক্ষককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে গতকাল সায়েন্স ল্যাব মোড়ে দ্বিতীয় দিনের মতো আন্দোলন করেছে শিক্ষার্থীরা। বেলা পৌনে ৩টায় বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. নেয়ামুল হক, উপাধ্যক্ষ মোখলেছুর রহমান, হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন এবং বিবিএর সহযোগী শাহিনুর সোবহান নঈমকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। এরপর বেলা ৩টার দিকে শিক্ষার্থীরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ধানমন্ডির বাসায় রওনা দেন।
যানজটে ভোগান্তি, বিরক্ত মানুষ : শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে দিনভর যানজটে প্রচণ্ড ভোগান্তিতে বিরক্ত ছিল মানুষ। সায়েন্সল্যাব মোড় অবরোধের কারণে নিউমার্কেট থেকে মিরপুর সড়কটিতে যান চলাচল ব্যাহত হয়। এছাড়া নিউ এলিফ্যান্ট রোডের মোড়ে বাঁশ দিয়ে সব যানবাহন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ঝিগাতলাসহ সায়েন্সল্যাব সংযুক্ত অন্যান্য সড়কেও যান চলাচল ব্যাহত হয়। যানবাহন না পেয়ে অনেককেই হেঁটে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে দেখা গেছে। সায়েন্সল্যাবে মোড়ে না পেরে অনেকেই ভিন্ন পথে গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করেছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের অবরোধের কারণে নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, সায়েন্সল্যাবসহ আশপাশের এলাকা। নীলক্ষেত থেকে সায়েন্সল্যাব অভিমুখী সড়ক, শাহবাগ থেকে সায়েন্সল্যাব, ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুর থেকে সায়েন্সল্যাব অভিমুখী সব সড়কেই তৈরি হয় তীব্র যানজট। এই সড়কগুলোতে যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে।
রবিউল হাসান নামের এক চাকরিজীবী বলেন, ‘সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের বলার কোনো জায়গা নেই। এখানে অবরোধের কথা তো জানি না। ধানমন্ডি থেকে পায়ে হেঁটে এ পর্যন্ত এসেছি। শনির আখড়া যাব। কোথায় গিয়ে বাস পাব জানি না।’
আপনার মতামত লিখুন :