ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪
মডেল তিন্নি হত্যা

বিচারের অপেক্ষায় ২২ বছর, ঘাতক অভির নেই সন্ধান

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৬, ২০২৪, ০৯:২৫ পিএম

বিচারের অপেক্ষায় ২২ বছর, ঘাতক অভির নেই সন্ধান

মডেল তিন্নি ও ঘাতক অভি। ফাইল ছবি

২০০২ সালের ১১ নভেম্বর মডেল সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি হত্যাকাণ্ডের প্রায় ২২ বছর পার হলেও এখনো বিচার শেষ হয়নি। তবে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, খুব শিগগিরই মামলাটির বিচারকার্য শেষ হবে এবং ভুক্তভোগী ন্যায় বিচার পাবেন। বর্তমানে মামলাটি ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন বলে জানা যায়।

বহুল আলোচিত তিন্নি হত্যার রায়ের তারিখ ৩১ বার পেছানোর পর ঢাকা জেলা সপ্তম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে রায় ঘোষণার জন্য ২০২১ সালের নভেম্বরের ১৫ তারিখ নির্ধারিত হয়। কিন্তু সেই তারিখেও রায় হয়নি। মামলাটির দীর্ঘ তদন্তের একপর্যায়ে বেরিয়ে আসে এ আলোচিত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এক সময়ের দাপুটে ছাত্রনেতা ও সাবেক এমপি গোলাম ফারুক অভি জড়িত।

মডেল সৈয়দা তানিয়া মাহবুব ওরফে তিন্নি হত্যার ঘটনায় ওই সময় দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দেয়। তিন্নি খুনের ঘাতক বর্তমানে বিদেশে পলাতক আসামি গোলাম ফারুক ওরফে অভির সন্ধান করতে পারেনি আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা (ইন্টারপোল)।

সিআইডির তদন্তে বেরিয়ে আসে আশির দশকের আলোচিত ছাত্রদল নেতা সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভি মডেলকন্যা তিন্নির সঙ্গে পরকীয়া ও অবৈধ মেলামেশা এবং জোরপূর্বক বিয়ের চাপ দিয়েছিল। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সংবাদ মাধ্যমে তার অপকর্ম ফাঁস করার হুমকি দেওয়ায় পরিকল্পিতভাবে বুড়িগঙ্গা নদীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর উপর থেকে ফেলে তাকে খুন করা হয়। এই মডেলকন্যা তিন্নি হত্যা মামলায় ২০০৭ ও ২০১৮ সালে ইন্টারপোল অভির বিরুদ্ধে লাল নোটিশ জারি করে। কিন্তু দীর্ঘ ২২ বছরেও ঘাতক অভির সন্ধান করতে পরেনি আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল।

জানা যায়, ২০০২ সালের ১১ নভেম্বর নদী থেকে মরদেহ তোলার চার দিন পর ১৫ নভেম্বর একটি জাতীয় পত্রিকায় বেওয়ারিশ মরদেহের ছবি প্রকাশ করে পুলিশ। ছবি প্রকাশের পর তিন্নির স্বজনরা মরদেহটি তিন্নির বলে শনাক্ত করেন। মৃত্যুর ১১ দিন পর কবর থেকে তার মরদেহ তোলা হয়। এর আগে নিহত তিন্নির চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম কেরানীগঞ্জ থানায় একটি ‘মিসিং ডায়েরি’ করেন।

সুপরিচিত মডেল তারকা তিন্নির মরদেহ শনাক্তের পর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে পুলিশ। গ্রেপ্তার করে তিন্নির স্বামী শাফাকাত হোসেন পিয়াল, এবায়দুল্লাহ ওরফে স্বপন গাজী ও গাজী শরিফ উল্লাহ ওরফে তপন গাজীকে। তখনো প্রধান আসামি ধরাছোঁয়ার বাইরে। পরে আরও আটঘাট বেঁধে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। বেরিয়ে আসতে থাকে নতুন নতুন তথ্য, ঘুরতে থাকে তদন্তের মোড়। মামলাটি চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে ২০০২ সালের ২৪ নভেম্বর তদন্তভার সিআইডিতে ন্যস্ত হয়। এরপর মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডি। সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা মোজাম্মেল হকই ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর সাবেক ছাত্রনেতা ও সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভিকে একমাত্র আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে ৪১ জনকে সাক্ষী করা হয়।

এ ছাড়া এই মামলায় ২২টি আলামত জব্দ করা হয়। এরপর ২০১০ সালের ১৪ জুলাই ঢাকার ৭ম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এই মামলায় অনুপস্থিত অভির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। পরে অভিযোগপত্রভুক্ত ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। মডেল তিন্নি হত্যা মামলায় তার চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম ২০২২ সালের ২৩ মার্চ আদালতে দেওয়া সাক্ষ্য দেন। আর তিন্নি বাবাও সাক্ষ্য দিয়েছেন। আলোচিত এ হত্যা মামলায় রায় ঘোষণার জন্য গত বছরের ১৫ নভেম্বর দিন ধার্য ছিল। কিন্তু মামলার দুই সাক্ষী তিন্নির বাবা ও চাচা সাক্ষ্য দিতে চাইলে আদালত কর্তৃক রায় মুলতবি করা হয়। বহুল আলোচিত তিন্নি হত্যার রায়ের তারিখ ৩১ বার পেছানোর পর ঢাকা জেলা ৭ম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে রায় ঘোষণার জন্য ২০২১ সালের নভেম্বরের ১৫ তারিখ নির্ধারিত হয়। কিন্তু সেই তারিখেও রায় হয়নি।

আদালত সূত্রে জানা যায়, আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন্নির স্বামী পিয়ালসহ গ্রেপ্তারকৃতদের সিআইডির তদন্তে প্রমাণ না মেলায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। তখন কারাগারে বন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের স্বীকারোক্তিতে বেরিয়ে আসে অভির নাম।

জিজ্ঞাসাবাদে ইমন পুলিশকে জানান, তিনি যখন ভারতে পালিয়ে ছিলেন, তখন অভির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। সে সময় অভি কথা প্রসঙ্গে বলেন, মডেল তারকা তিন্নির সঙ্গে তার ভালোবাসা ও প্রেমের সম্পর্ক হয়। অভি তিন্নিকে দিয়ে তার স্বামী পিয়ালকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য করে এবং তিন্নিকে বিয়ের আশ্বাস দেন। হত্যাকাণ্ডের দিন এমন হুমকিতে দুজনের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হয়। একপর্যায়ে, অভি তিন্নির মাথা ধরে ধাক্কা দেন। তখন তিন্নি মাথায় আঘাত পান ও মারা যান। পরে অভি তার গাড়িতে করে তিন্নির মরদেহ বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচে ফেলে রাখেন।

মামলাটির ৩ নম্বর সাক্ষী তিন্নির পিতা সৈয়দ মাহবুব করিম। ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল আদালতে তার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। সাক্ষ্যে আদালতকে তিনি জানান, অভিনয়ে আগ্রহী ছিল না তিন্নি। তিন্নির স্বামী পিয়ালই তাকে নানা কৌশলে অভিনয়ে আনে। একদিন পিয়াল তাকে ব্যাংককে শপিংয়ে পাঠায়। সেখানে বাবু নামে এক ভদ্রলোক তাকে সহযোগিতা করবে বলে জানানো হয়। সেই বাবুই ছিল অভি। এরপর অভির সঙ্গে তিন্নির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে গভীর পরকীয়ায় রূপ নেয়। নির্মম মৃত্যুই তার পরিণতি ডেকে আনে।

সৈয়দ মাহবুব করিম জানান, রহস্যজনকভাবে তিন্নির স্বামী শাফকাত হোসেন পিয়ালকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে। মামলায় বর্তমানে একমাত্র আসামি সাবেক এমপি গোলাম ফারুক অভিও ধরাছোঁয়ার বাইরে। মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে একটি মহল এখনো নানা ষড়যন্ত্র করছে। তিন্নি হত্যাকাণ্ডের পরপরই এমপি অভি দেশত্যাগ করলেও পরের আট বছরে দুইবার দেশে এসেছিলেন। কিন্তু অদৃশ্য কারণে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। বিদেশ থেকে অভিকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য বর্তমান সরকারের কাছে তিনি আহ্বান জানান।

গোলাম ফারুক অভির উত্থান ঘটে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে। ছাত্র হিসেবে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। এসএসসি এবং এইচএসসিতে বোর্ড পর্যায়ে মেধার স্বাক্ষর রাখেন। নব্বইয়ের গণআন্দোলন ঠেকাতে এরশাদের নজর পান অভি। ওই সময় অপহরণ ও মুক্তিপণ এবং চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। তিনি নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে তিনি গ্রেপ্তার হন।

তবে নব্বইয়ের গণআন্দোলনের চরম পর্যায়ে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে কারাগার থেকে মুক্তি পান। আর ছাড়া পেয়েই পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। তিনি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯০ সালের ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছাত্রদল দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। অভি একটি অংশের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তার সাথে তৎকালীন সরকারের গোপন যোগাযোগ রয়েছে, এই অভিযোগে ওই বছরের ২৫ নভেম্বর তাকে ছাত্রদল থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৯৬ সালের ৯ মে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং ১২ জুন অনুষ্ঠিত ৭ম সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) আসন থেকে সর্বকনিষ্ঠ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯৯৮ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বিএনপির সাথে সংসদ বয়কটের সিদ্ধান্ত নিলে জাতীয় পার্টির তৎকালীন মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে গোলাম ফারুক অভিসহ দলের ১০ জন সংসদ সদস্য ভিন্নমত পোষণ করেন এবং এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) গঠিত হলে গোলাম ফারুক অভি এই দলের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গোলাম ফারুক অভি পরাজিত হন।

বিতর্ক ও খুনের অভিযোগ:

১৯৮৯ সালে একটি হত্যা মামলার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়াও ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে তার বিরুদ্ধে আটকাদেশ দেওয়া হয়। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর ডা. মিলন হত্যায়ও তিনি অভিযুক্ত ছিলেন। ১৮ মে ১৯৯২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের গেস্টরুম থেকে একটি কাঁটারাইফেল ও বিদেশি পিস্তলসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ২১ আগস্ট ১৯৯৩ সালে ওই মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ড হলে তিন বছর কারাভোগের পর উচ্চ আদালতে আপিল করে জামিন পান তিনি। কানাডার টরেন্টো থেকে অভি পাওয়ার অব অ্যাটর্নির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠিয়ে এক আইনজীবীর মাধ্যমে মামলাটির স্থগিতাদেশ চেয়ে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। যার রিট পিটিশন নম্বর ৯৫৩১/২০১০। শুনানি শেষে ২০১১ সালের ১৫ জানুয়ারি রুল জারি করেন হাইকোর্ট।

এরপর ২০১১ সালের ২৩ জুন হাইকোর্ট মামলাটির স্থগিতাদেশ দেন। এই কারণে প্রায় সাত বছর মামলার কার্যক্রম স্থগিত ছিল। হাইকোর্টের নির্দেশে এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া প্রায় পাঁচ বছর স্থগিত থাকার পরে ২০১৫ সালে মামলাটির বিচার কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়। মডেলকন্যা তিন্নি হত্যা মামলার আসামি অভি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে তার নির্বাচনী এলাকা বরিশাল-২ এ ঈদের নামাজে মোবাইল ফোনে তার সহযোগীদের সহযোগিতায় বক্তব্য দিয়ে থাকেন। বক্তব্যে তিনি বলে থাকেন, নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে দেশে ফিরে আবারও রাজনীতিতে ফিরবেন। নির্বাচনে জয়ী হয়ে এলাকার মানুষের জন্য কাজ করবেন।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!