হত্যা মামলার আসামি সাবেক এমপি ও জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে তিন মাসেও খুঁজে পায়নি পুলিশ। অথচ অভিযোগ রয়েছে, শিরীন দম্পতির পাসপোর্ট হচ্ছে ভিআইপি সুবিধায়। ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতনদের যোগসাজশে অনৈতিকভাবে নতুন পাসপোর্ট পেতে ভিআইপি সুবিধা নিয়েছেন সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন ও তার স্বামী সৈয়দ ইশতিয়াক হোসাইন। এ জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের একাধিক সূত্র দাবি করেছে। অথচ তার বিরুদ্ধে বিদেশ যাত্রায় রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, হত্যা মামলায় আত্মগোপনে থাকা আসামি কীভাবে ঘরে বসে পাসপোর্ট করতে পারেন? তবে এ বিষয়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কেউ মুখ খুলছেন না। বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ফোন করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে পাসপোর্ট অধিদপ্তর জানিয়েছে, শিরীন শারমিন চৌধুরীর কূটনৈতিক পাসপোর্টের পরিবর্তে সাধারণ পাসপোর্ট প্রাপ্তির আবেদনটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে। তাকে অদ্যাবধি কোনো পাসপোর্ট প্রদান করা হয়নি।
পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে সরকার যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছে, সেভাবেই তাদের পাসপোর্ট করা হয়েছে। তবে তাদের পাসপোর্ট ইস্যু হয়নি, দেওয়াও হয়নি।
এদিকে শিরীন শারমিনের পাসপোর্ট আবেদনের স্ট্যাটাসে দেখা গেছে, এতে লেখা রয়েছেÑ‘প্রিয় শিরীন শারমিন চৌধুরী, আপনার পাসপোর্ট আবেদন পাসপোর্ট অফিস থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। দয়া করে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য পাসপোর্ট অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’
জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর আত্মগোপনে যান শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের দমনে পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-জনতার ওপর প্রকাশ্যে গুলি চালায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিলেট, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, পাবনা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সেসব সন্ত্রাসীর অস্ত্রসহ ছবি ও ভিডিও তখনই ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, প্রকাশিত হয় দেশের গণমাধ্যমগুলোতেও।
অভ্যুত্থানের পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় গুলি করে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সাবেক মন্ত্রী-এমপি, পুলিশ সাংবাদিকসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলা হয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ২৩৯টি মামলা দায়েরের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২০২টি হত্যা মামলা। বাকি মামলাগুলোয় হত্যাচেষ্টা ও অপহরণের অভিযোগ আনা হয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হওয়া এসব মামলার মধ্যে ঢাকার আদালত ও থানাগুলোয় হয়েছে ১৯৯টি।
গত ২৭ আগস্ট মঙ্গলবার রংপুরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে স্বর্ণশ্রমিক মুসলিম উদ্দিন (৩৮) নিহতের ঘটনায় জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়। অবশ্য অভ্যুত্থানের পরপরই আত্মগোপনে চলে যান তিনি।
শিরীন শারমিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে হওয়া হত্যা মামলার তদন্ত করছে রংপুর মহানগর পুলিশের (আরএমপি) কোতোয়ালি থানা পুলিশ। এ মামলার তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে আরএমপির উপকমিশনার (ক্রাইম) শিবলী কায়সার সাংবাদিকদের বলেন, শিরীন শারমিন চৌধুরী হত্যা মামলার পলাতক আসামি। পুলিশ তাকে খুঁজছে, তার সন্ধান পেলেই গ্রেপ্তার করা হবে।
বিভিন্ন সূত্রে অভিযোগ পাওয়া গেছে, পাসপোর্ট অধিদপ্তরে স্বৈরাচারী সরকারের সুবিধাভোগীরা এখন একজোট হয়ে সাবেক সরকারের মন্ত্রী ও এমপি যাদের লাল পাসপোর্ট বাতিল হয়েছে, তাদের নতুন পাসপোর্ট তৈরিতে আড়ালে থেকে সহযোগিতা করছেন। পাশাপাশি অনৈতিকভাবে পাসপোর্ট তৈরি করে দিয়ে নিজেরাও মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
জানা গেছে, আত্মগোপনে থাকা সাবেক এ স্পিকার গত ৩ অক্টোবর তার স্বামী সৈয়দ ইশতিয়াক হোসাইনসহ ঢাকার আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট অফিসে সাধারণ ই-পাসপোর্ট পেতে আবেদন করেন। গত ১০ অক্টোবর তাদের আঙুলের ছাপ ও চোখের আইরিশের ছবি দেওয়ার তারিখ ছিল, যা তারা ঘরে বসেই দিয়েছেন। অথচ ই-পাসপোর্ট আবেদনের নিয়মে বলা আছে, সব কিছু ঘরে বসে করতে পারলেও নির্ধারিত তারিখে আঙুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ দিতে আবেদনকারীকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট পাসপোর্ট অফিসে যেতে হবে। শুধু অসুস্থ ও শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিরা পাসপোর্ট অফিসের বিশেষ সেবা মোবাইল টিমের মাধ্যমে ঘরে বসে বা হাসপাতালে থেকে এ সুবিধা নিতে পারবেন। যদিও আবেদন করার পর আঙুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ দেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ হলেও, পাসপোর্ট সাসপেন্ড রয়েছে। শিরীন শারমিন ও তার স্বামী ইশতিয়াক হোসাইনের পাসপোর্টের আবেদনে স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে রাজধানীর ধানমণ্ডির ১৬ নম্বর সড়কের একটি বাসার ৪-ই ফ্ল্যাট। অবশ্য ওই ফ্ল্যাটে তারা বাস করেন না। শিরীন শারমিন চৌধুরীর পাসপোর্টের আবেদনের বিষয়টি জানতে ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের উপপরিচালক মো. ইসমাইল হোসেনকে ফোন দেওয়া হলে তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
পাসপোর্টের জন্য আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় একজন হত্যা মামলার আসামির বাসায় গিয়ে আঙুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নিরাপত্তা ও বহিরাগমন অনুবিভাগ) মো. ফিরোজ সরকার বলেন, এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। আপনি পিআরওকে ফোন করে বিস্তারিত জেনে নিন। এ বিষয়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) এ টি এম আবু আসাদকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে পাসপোর্ট অধিদপ্তর থেকে একটি বক্তব্য পাঠানো হয়েছে।
সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর পাসপোর্ট আবেদন গ্রহণের বিষয়ে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের বক্তব্য,
সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর নামে বর্তমানে কোনো অ্যাকটিভ পাসপোর্ট নেই। তার অনুকূলে ইস্যুকৃত কূটনৈতিক পাসপোর্টটি অন্যদের কূটনৈতিক পাসপোর্টের মতো আগেই বাতিল করা হয়েছে।
মাস দেড়েক আগে তিনি কূটনৈতিক পাসপোর্ট জমা দিয়ে সাধারণ পাসপোর্টপ্রাপ্তির জন্য আবেদন করেন। পাসপোর্টপ্রাপ্তির আবেদন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। বিভিন্ন পর্যায়ে যাচাই-বাছাই ও সম্পাদনের পরেই কোনো ব্যক্তির অনুকূলে পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়। শিরীন শারমিন চৌধুরীর কূটনৈতিক পাসপোর্টের পরিবর্তে সাধারণ পাসপোর্ট প্রাপ্তির আবেদনটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে। তাকে অদ্যাবধি কোনো পাসপোর্ট প্রদান করা হয়নি।
আপনার মতামত লিখুন :