ছাত্র-জনতার দুর্বার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ আমির হোসেন আমুর বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস কখনোই পায়নি দক্ষিণাঞ্চলে দলের কেউ। বিশেষ করে নির্বাচনি এলাকা ঝালকাঠিতে গেল সাড়ে ১৫ বছরে তার কথাই ছিল শেষ কথা। মৃদু প্রতিবাদেও ধ্বংস হয়ে যেত রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। কেবল আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপি নেতারাও ভয়ে কখনো কথা বলত না তার বিরুদ্ধে। যেন সবার কাছেই জ্যান্ত আতঙ্ক ছিলেন ১৪ দলের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও মুখপাত্র এই নেতা ও সাবেক মন্ত্রী। জাতীয় নেতা হলেও তার প্রভাব-প্রতিপত্তি সবচেয়ে বেশি ছিল ঝালকাঠিতে। পতিত সরকারের আমলে একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছিল ঝালকাঠি-নলছিটিতে, যারা আমুর হয়ে জেলার সব ধরনের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ-বাণিজ্য, অন্যের জমি দখল, কমিটি গঠন, নির্বাচনি মনোনয়ন বিক্রি করত। এই চক্রের মাধ্যমে আমু হয়ে উঠেছিলেন ঝালকাঠির গডফাদার। তার বিরুদ্ধে জমি দখল, কমিশন বাণিজ্য ও চাঁদাবাজিসহ নানা দুর্নীতি-অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাসহ খোদ দলীয় নেতাকর্মীরা জানান, নিজ দলের অনেক নেতাকর্মীকেও তিনি মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল খাটিয়েছেন কিংবা এলাকাছাড়া করেছেন। টাকা ছাড়া কোনো কাগজে স্বাক্ষর কিংবা কাজ করতেন না আমু। ফলে তিনি অবৈধভাবে ধীরে ধীরে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যান। তবে তিনি সাধারণত ব্যাংকে টাকা রাখতেন না। বস্তায় বস্তায় টাকা রাখতেন বাসায়। তাই দল ক্ষমতাচ্যুত হয়ে আত্মগোপনে যাওয়ার পর আমুর ঢাকার ইস্কাটন ও ঝালকাঠি শহরের বাসায় মেলে নগদ কোটি কোটি টাকা।
শেখ হাসিনা সরকারের ৫ আগস্টে পতনের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দোর্দণ্ড প্রতাপশালী নেতা ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আমির হোসেন আমুকে অবশেষে গ্রেপ্তারে সফলতা পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তিন মাস পলাতক থাকার পর গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি হত্যা মামলা রয়েছে। আজ তাকে আদালতে তুলে রিমান্ডে আনা হতে পারে।
এদিকে রাজধানীতে আমুর গ্রেপ্তার হওয়ার খবরে গতকাল বিকেলে খোদ তার সংসদীয় আসন ঝালকাঠি সদর ও নলছিটির বিএনপি নেতাকর্মীসহ আওয়ামী লীগ শাসনামলে নির্যাতিত-নিপীড়িতরা আনন্দ উল্লাস করেছেন এবং একে অপরকে মিষ্টিমুখ করান। একইভাবে উল্লাস করেন নিজ দলের নির্যাতিত নেতাকর্মীরা। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের দোসর আমুর কঠোর শাস্তিও দাবি করেছেন সবাই।
জানা গেছে, বিগত সরকারের পতনের পর ঝালকাঠিতে বিএনপি নেতাদের করা প্রথম তিনটি মামলায় আসামি করা হয়নি তাকে। বিষয়টি নিয়ে কথা উঠলে ২ সেপ্টেম্বর দায়ের হওয়া সর্বশেষ মামলায় অনেকটা দায়সারাভাবে অন্তর্ভুক্ত হয় তার নাম। তাও সেই মামলার বাদী হননি বিএনপির দায়িত্বশীল কেউ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে আমির হোসেন আমুর ছত্রচ্ছায়ায় এবং আশ্রয়-প্রশয়ে জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক জিএস জাকির, জেলা আওয়ামী লীগের নুরুল আমিন সুরুজ, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের হাফিজ আল মাহামুদ এবং জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক কামাল শরীফের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী। টেন্ডার বাণিজ্যসহ সরকারি উন্নয়ন বরাদ্দের অর্থে আমু তাদের মাধ্যমে ভাগ বসাতেন, কেউ প্রতিবাদী হয়ে উঠলে এই বাহিনী তাকে শায়েস্তা করত।
বিএনপি নেতাকর্মীসহ ভিন্নমতের মানুষ আমুর বিচারসহ বহু অঘটন ঘটন পটিয়সী ‘চার খলিফা’ জিএস জাকির, জেলা আওয়ামী লীগের নুরুল আমিন সুরুজ, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের হাফিজ আল মাহামুদ এবং জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক কামাল শরীফকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবি রেখেছেন।
ঝালকাঠি জেলা বিএনপির সদস্যসচিব শাহাদাৎ হোসেন বলেন, গত ১৬ বছর সব সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনকে কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন আমির হোসেন আমু। নৈশপ্রহরী থেকে শুরু করে সব চাকরিতে আমুকে টাকা দিতে হতো। বিএনপির নেতাকর্মীরা বাড়িতে ঘুমাতে পারেননি ঝালকাঠির এই দোর্দণ্ড প্রতাপশালী নেতা এবং তার খলিফাদের অত্যাচারে।
অভিযোগ আছে, ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গা দখল করে আমির হোসেন আমু নিজের মা-বাবার নামে আকলিমা মোয়াজ্জেম হোসেন ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে প্রায় ছয় একর জমি জোর করে নামমাত্র মূল্যে লিখে নেন।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, আমু নিজেই পুলিশের ভয় দেখিয়ে লোক দিয়ে জমি দখল করেন। কলেজের পাশে ঝালকাঠি শহরের লবণ ব্যবসায়ী ফজলুল হক হাওলাদারের ৩৬ শতক জমি ছিল। তার জামাতা প্রবাসী আতিকুর রহমানের আরও ৭৫ শতাংশ জমি নিয়ে ফজলুল হক যৌথভাবে হাওলাদার ফিলিং স্টেশন নামে একটি পাম্প নির্মাণ শুরু করেন। স্থাপনা নির্মাণসহ বিভিন্ন দপ্তর থেকে অনুমোদন নিতে ৩৬ লাখ টাকা খরচ করেন। কিন্তু আমু তার প্রতিষ্ঠিত কলেজের জন্য সেই জমি লিখে দিতে চাপ সৃষ্টি করেন। ফজলুল হক অস্বীকৃতি জানানোয় আমুর ‘খলিফা’ জিএস জাকিরের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা প্রায়ই তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে জমি লিখে দিতে হুমকি দিয়ে আসতেন। তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) এমএম মাহামুদ হাসানের নেতৃত্বে একদল পুলিশ প্রায়ই তার ছেলে রিয়াজুল ইসলামকে তুলে নিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত থানায় বসিয়ে রাখত, দেখাত ‘ক্রসফায়ারের’ ভয়।
খলিলুর রহমান নামে অপর এক জমির মালিক অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার অনেক কষ্টে জমানো টাকায় ৬ শতক জমিতে একটি পাকা টিনশেড ঘর তৈরি করি। সেই জমি লিখে নিতে জাকির চাপ সৃষ্টি করেন। পরে আমার বাড়ির প্রবেশপথ কলেজের সীমানাপ্রাচীর দিয়ে আটকে দেন আমু। কিছুদিন আমি ও আমার স্ত্রী মই দিয়ে প্রাচীর টপকে বাড়িতে প্রবেশ করতাম। আমুর ঢাকার বাসায় গিয়ে আমার স্ত্রী কিছুদিন গৃহকর্মীর কাজ করেছে, যাতে জমিটি লিখে দিতে না হয়। কিন্তু আমুর মন গলেনি। একপর্যায়ে মাত্র আট লাখ টাকার বিনিময়ে বাড়িসহ ৬ শতক জমি লিখে দিতে বাধ্য হই।’
একইভাবে আমু তার প্রতিষ্ঠিত কলেজের জন্য আবদুর রাজ্জাক, পাদুকা ব্যবসায়ী সম্রাট ও হাউসের মালিক পরিমল চন্দ্র দে, সাবিহা কেমিক্যাল ওয়ার্কসের মালিক মো. সামসুল হক ও তার ভাই-বোনদের ৩৬ শতকসহ অনেকের জমি দখল করে নেন। এসব জমি ভরাটের জন্য জেলা পরিষদ থেকে ২০ লাখ টাকা বরাদ্দও দেওয়া হয়। এক সূত্র দাবি করেছে, ২০১৫ সালে আমুর নির্দেশে জেলা প্রশাসন পরিচালিত কালেক্টরেট স্কুল ভবনের দুটি কক্ষ ও সীমানাপ্রাচীর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেন পৌর মেয়র লিয়াকত আলী তালুকদারের লোকজন। কালেক্টরেট স্কুলের পাশেই আমুর স্ত্রীর নামে বেগম ফিরোজা আমু ঝালকাঠি টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের ভবন নির্মাণের জন্য এ ভাঙচুর চালানো হয়। ২০১৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সুগন্ধা নদীর তীরে কালেক্টরেট স্কুলটি নির্মাণ করা হয়। বিদ্যালয়টির সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য জেলা প্রশাসনের সামনেই একটি পুকুর ও চারপাশে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করে। কালেক্টরেট স্কুলটির পাশেই নির্মাণ করার কথা ছিল বেগম ফিরোজা আমু ঝালকাঠি টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের ভবন। পরে সেখানে আর সেই প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হয়নি, যদিও জমি দখলে রয়েছে। পরে ওই জমির পেছনে ২০২৩ সালে বেগম ফিরোজা আমু হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নামে একটি ভবন নির্মাণ করা হয়।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আমু ঝালকাঠি-২ আসনের সাবেক এমপি হলেও ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর-কাঁঠালিয়া) আসনের রাজনীতিতেও ছিল তার একক আধিপত্য। প্রতিটি সাংগঠনিক কমিটিতে তার মনোনীত ব্যক্তিরা স্থান পেয়ে এসেছেন। ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে অর্থের বিনিময়ে বিএনপিপন্থি ব্যক্তিদের বড় পদে বসানোর অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, সব টাকাই নগদ দিতে হতো আমুকে। লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করতেন তার এপিএস কিরণ, যিনি সম্পর্কে আমুর ভায়রা। কিরণের বাড়ি নরসিংদী জেলায়। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের ছোট ভাই কিরণ তার নিজের এলাকা বাদ দিয়ে পড়ে থাকতেন ঝালকাঠিতে। কেবল কমিশন আদায় নয়, নির্বাচনি এলাকায় আমুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও দেখাশোনা করতেন তিনি।
নলছিটি উপজেলার আওয়ামী লীগের এক ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমুর সঙ্গে দেখা করতে হলে অনুমতি নিতে হতো কিরণের। নলছিটির সব কাজের ভাগ-বাটোয়ারা করতেন তিনি।
পরিচয় না প্রকাশের শর্তে ঝালকাঠির একাধিক বাসিন্দা বলেন, ‘ক্ষমতার আমল কেবল নয়, ক্ষমতার বাইরে থাকলেও আমু প্রশ্নে নেতিবাচক কিছু বলার সাহস পেত না কেউ। অথচ ঝালকাঠিতে হেন দুর্নীতি নেই যা করেননি এই নেতা। সব দপ্তরের ঠিকাদারি কাজে নির্দিষ্ট অঙ্কের পার্সেন্টেজ দিতে হতো তাকে। টিআর কাবিখা আর সংসদ সদস্যদের নামে বিশেষ বরাদ্দের ক্ষেত্রেও নিতেন টাকা।’
নলছিটি উপজেলার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘আমার বিদ্যালয়ে গত বছর নৈশপ্রহরী, অফিস সহকারী ও আয়া পদে তিনজন লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হয়েছে আমির হোসেন আমুর নির্ধারিত প্রতিনিধিকে। কেবল আমি নই, বিদ্যালয়সহ সব ধরনের নিয়োগেই ছিল একই নিয়ম।’
ঝালকাঠি সড়ক বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যত ধরনের ঠিকাদারি টেন্ডার, সব ক্ষেত্রেই আমুকে দিতে হতো টাকা। ঠিকাদার নির্বাচন প্রশ্নেও তার সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। ই-টেন্ডার চালু হওয়ার পরও নানা কৌশলে টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। কথা না শুনলে কেবল বদলি নয়, শারীরিক-মানসিকভাবেও হতে হতো হেনস্তা।’ সড়ক বিভাগের মতো এলজিইডি, শিক্ষা প্রকৌশল দপ্তর, গণপূর্ত, থানা প্রকৌশলী এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন বিভাগসহ সব ক্ষেত্রেই ছিল একই অবস্থা।
বেপরোয়া এই অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে হাজার কোটি টাকা আয় করলেও দেশে আমির হোসেন আমুর তেমন কোনো সম্পদের সন্ধান মেলেনি। ঝালকাঠির রোনালস রোডে ভবন, বরিশাল নগরীর বগুড়া রোডে প্রাসাদসম আলিশান বাড়ি এবং রাজধানী ঢাকার ইস্কাটনে বেশ বড়সড় একটি বাগানবাড়ি রয়েছে তার।
আপনার মতামত লিখুন :