সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগের সাবেক নেতা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সেনাবাহিনীর অন্যতম প্রভাবশালী কর্মকর্তা ছিলেন। র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় অনেক বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনার কারিগর ছিলেন মজিবুর। সে সময় তার দুই সহযোগী ছিলেন বর্তমানে গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান ও নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোহায়েল।
অন্যদিকে আবাসন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অনলাইন গ্রুপ নামে একটি কোম্পানিকে বিধিবহির্ভূত নানা অনিয়মের সুযোগ করে দিয়ে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। ৫ আগস্টের আগে প্রভাবশালী এই সেনা কর্মকর্তার মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে অনলাইন গ্রুপের বিরুদ্ধে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মজিবুর ২০১৮ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তায় নিয়োজিত স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) মহাপরিচালকের দায়িত্ব নেন। এরপর থেকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার আগপর্যন্ত তিনি মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এই দীর্ঘ সময়ে মজিবুর নিজেও যেমন নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়ান, তেমনি তার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে অনলাইন গ্রুপও ব্যবসায় ফুলে-ফেঁপে ওঠে।
আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডের জিওসি হিসেবে দায়িত্বরত থাকার সময় গত ১০ সেপ্টেম্বর মজিবুর রহমানকে বরখাস্ত করা হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই কর্মকর্তার বিষয়ে আদেশ জারি করে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এ তথ্য জানায়।
বরখাস্ত হওয়ার পর মজিবুর ও অনলাইন গ্রুপের দুর্নীতির বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করছে দুদক। বাহিনী থেকে বরখাস্তের পর গ্রেপ্তার এড়াতে মজিবুর আত্মগোপনে রয়েছেন। ভুক্তভোগীদের দাবি, দ্রুত তাকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
জানা গেছে, অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের সিংহভাগ বিদেশে পাচার করেছেন মজিবুর। রাষ্ট্রীয় একাধিক বাহিনীকে ব্যবহার করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে গুম, খুন, নির্যাতনেও অংশ নেন তিনি। অধীনস্তদের দিয়ে বিরোধী মত দমন-পীড়নে নেতৃত্ব দিতেন তিনি।
আরও জানা গেছে, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার আগে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে সামরিক শাসন জারির বিষয়ে তর্কে জড়ান মজিবুর। ঘটনাটি পুরো বাহিনীতে আলোচনার জন্ম দেয় সে সময়।
এ বিষয়ে সূত্র জানায়, মজিবুর একসময় শেখ হাসিনার নিরাপত্তায় নিয়েজিত স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) মহাপরিচালক ছিলেন। তার হুকুমের বাইরে কোনো কিছু সম্ভব ছিল না বলে জানিয়েছেন এই বাহিনীর একাধিক সাবেক কর্মকর্তা। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে দিতেন না প্রভাবশালী কর্মকর্তা মজিবুর।
এদিকে দুদকে জমা পড়া অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, অনলাইন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খান মোহাম্মদ আক্তারুজ্জামান একসময় লজিং মাস্টার ছিলেন। ঢাকা সেনানিবাস এলাকার আশপাশে জমি-বাড়ি জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দখল করে তিনি হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। মজিবুরের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তিনি এসব দখল ও জালিয়াতি করতেন। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এবং বিশেষ বাহিনীর গোপন নথিতেও অনলাইন গ্রুপের মালিকানায় মজিবুর রহমানের নাম রয়েছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়, তিনি কানাডা ও দুবাইয়ে বিলাসবহুল বাড়ি ও ফ্ল্যাট কিনেছেন, যার পুরো অর্থই নিয়েছেন হুন্ডি ও মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে।
এ বিষয়ে ডিএমপির গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) জানান, ক্যান্টনমেন্ট, মানিকদী ও মাটিকাটা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আক্তারের নাম রয়েছে। তার বিষয়ে পুলিশি তদন্ত অব্যাহত আছে।
জানা গেছে, বরখাস্ত সেনা কর্মকর্তা মজিবুরের ক্ষমতার প্রভাবে আক্তারুজ্জামান ঢাকা সেনানিবাসসংলগ্ন মানিকদী, মাটিকাটা ও ইসিবি চত্বর এলাকায় রামরাজত্ব কায়েম করেন। ইসিবি চত্বরে অনলাইন সিটি, বিজে টাওয়ার, ওয়াসি টাওয়ারে ৩০টির বেশি ফ্ল্যাট রয়েছে মুজিবরের। সব কটি ফ্ল্যাট অবৈধ দখলবাজির সহযোগী হিসেবে উপঢৌকন পেয়েছেন বলে জানা গেছে।
ইসিবি চত্বর থেকে পশ্চিমে ব্লুমুন রেস্টুরেন্ট-সংলগ্ন ও মাস্টারটেকে কয়েক একর জমির মালিকানা রয়েছে মুজিবুর ও আক্তারুজ্জামানের নামে। তাদের বিরুদ্ধে শহিদ পরিবারের জমি দখলেরও অভিযোগ রয়েছে। তাদের থাবায় মাথা গোঁজার সম্বলটুকুও হারিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহিদ সৈয়দ সিরাজ উদ্দিনের পরিবার।
শহিদ সিরাজ উদ্দিনের মেয়ে সৈয়দা মোছাদ্দিকা দিকু জানান, ইসিবি চত্বরের কিছুটা দূরে, দক্ষিণ মানিকদীতে তার পরিবারের রয়েছে তিন কাঠার প্লট। ২০০৪ সালে জমিটি কেনেন তারা। বছরখানেক আগে অনলাইন গ্রুপ জমিটি কেনার প্রস্তাব দেয়। তাদের প্রস্তাবে রাজি হয়নি শহিদ পরিবারটি। তাই জোর করেই এটি দখল করে নেয় অনলাইন গ্রুপ। এখন নিজের জমিতেই যেতে পারছেন না তারা।
অনলাইনে গ্রুপের শিকার আরেক ভুক্তভোগী সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক ফিরোজ মিয়া। তিনি জানান, জাতিসংঘ মিশন থেকে ফিরে সেই টাকায় নিষ্কণ্টক জমি কিনেছিলেন। তাতে চোখ পড়ে অনলাইন গ্রুপের। তারপর নানা দুর্বিপাকে যেতে হয়েছে তাকে।
আরেক ভুক্তভোগী স্বপ্না আক্তার বলেন, ইসিবি চত্বরে তারা কয়েকজন মিলে ৪১টি শেয়ারে ১২ কাঠার একটি জমি কেনেন। তাতেও চোখ পড়ে অনলাইন গ্রুপের। জমিটি দখল করতে পাঁচটি শেয়ার প্রতারণার মাধ্যমে কিনে নেয় অনলাইন গ্রুপ। এরপর থেকে পুরো জমি দখলে নেওয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিটি।
স্থানীয় ভুক্তভোগী নাজিম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, তদবিরবাজ, প্রতারক, জালিয়াতির আমলনামায় সেরা আক্তারুজ্জামান এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। কেউ জমি বিক্রি করতে চাইলে তিনি (আক্তারুজ্জামান) নামমাত্র মূল্যে ভুয়া চেক দিয়ে জমি বায়না করে তারপর দখল প্রক্রিয়া শুরু করেন। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করেন। তার অপকর্মের প্রতিবাদ করে অনেক গায়েবি মামলার শিকার হয়েছেন মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন ভূইয়া নামে এক ব্যক্তি।
আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডের জিওসি হিসেবে বরখাস্ত হওয়ার আগে মজিবুর রহমান সেনা সদর দপ্তরে কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) অতিরিক্ত মহাপরিচালকও ছিলেন। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে হোলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলার সময় ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনা করে তিনি আলোচনায় আসেন। ২০১৮ সালে তিনি এসএসএফের মহাপরিচালক হন।
আপনার মতামত লিখুন :