ঢাকা সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

খালি পড়ে আছে রাজশাহীর ৬৩ কোটি টাকার বঙ্গবন্ধু চত্বর

জনাব আলী, রাজশাহী

প্রকাশিত: নভেম্বর ১১, ২০২৪, ১১:১১ এএম

খালি পড়ে আছে রাজশাহীর ৬৩ কোটি টাকার বঙ্গবন্ধু চত্বর

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

রাজশাহী নগরীর ব্যস্ততম তালাইমারী এলাকায় সরকারি জমিতে বঙ্গবন্ধু চত্বর নামে একটি বিশালাকার নতুন ভবন নির্মাণ বাবদ ১২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হলেও ৬২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে কেবল ভবনটির অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষ করা হয়। এ অবস্থায় দীর্ঘদিন খালি পড়ে আছে ভবনটি। বাদবাকি অর্থের কোনো হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল মূলত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খুশি করতে। পাশাপাশি বাড়তি ব্যয় দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করতে।

তৎকালীন আরডিএ’র চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি বজলুর রহামন এ প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিলেন। ৬২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে (প্রায় ৬৩ কোটি টাকা) চলতি বছরের মার্চের দিকে ভবনটির প্রথম ধাপের অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষ হয়। তবে অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হলেও এখন সেটি পড়ে আছে। এখন কি কাজে ব্যবহার হবে তা বলতে পারছে না আরডিএ কর্তৃপক্ষ।

এমনকি আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ায় বঙ্গবন্ধু চত্বর নাম পাল্টিয়ে কি নাম দেওয়া হবে সেটিও ঠিক করতে পারছে না আরডিএ’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে সরকারি সম্পত্তি ও প্রায় শতকোটি টাকা খরচ করে শেখ হাসিনা খুশি করতে এবং এ ধরনের প্রকল্প নিয়ে শুরু থেকেই আরডিএ’র কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাঝে ছিল ক্ষোভ। তবে চাকরি হারানোর ভয়ে কেউ এতদিন মুখ খুলতে সাহস পাননি।

তারা বলছেন, ‘নিজেদের স্বার্থে করা এই প্রকল্প বাতিল করে জনগণের প্রয়োজনে ভবনটি এখন ব্যবহার করা হোক। পাশাপাশি এই ভবন নির্মাণে যে দুর্নীতি হয়েছে, সেটি তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

এদিকে, অবকাঠামো নির্মাণের জন্য পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিতে বাড়তি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল বলে শুরুতে অভিযোগ উঠেছিল। এ নিয়ে ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে অনুসন্ধানী খবরও প্রকাশ হয়েছিল। ওই সময় অভিযোগ উঠেছিল, শেখ হাসিনাকে খুশি করার পাশাপাশি এ প্রকল্পের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা তছরুপই ছিল অন্যতম। সে কারণে পছন্দের ঠিকাদারকে দিয়ে কাজটি করানো হয়। এরই মধ্যে গত ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের সময় এই ভবনটির বাইরের দরজা-জানালার কাচসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ভাঙচুরও করা হয়।

আরডিএ সূত্র মতে, বঙ্গবন্ধু চত্বর প্রকল্পের আওতায় ২০১৭ সালে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ)। ২০১৮ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন হয় একনেকে। অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু মাঝপথে এসে প্রকল্পটির নকশায় ব্যাপক পরিবর্তন আনে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান।

মহানগরীর তালাইমারী মোড়ে এ প্রকল্পের জন্য খরচ ধরা হয়েছিল প্রথমে ৫৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা। পরে সেটির ব্যয় বাড়িয়ে শুধু অবকাঠামো নির্মাণ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। প্রথমে প্রকল্প মেয়াদ ছিল ২০১৯ সাল পর্যন্ত। পরে সেটি ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। আয়তনে ১.৪২ একর প্রায় শতকোটি মূল্যের এ জমিটি জনগণের কল্যাণে ব্যবহার না করে বঙ্গবন্ধু চত্বর নির্মাণের মাধ্যমে সরকারি অর্থ তছরুপের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে।

আরডিএ সূত্র আরও জানায়, প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী, নির্মাণকৃত এ চত্বরটির বেজমেন্টে গাড়ি পার্কিং, আর্ট গ্যালারি ও জলধারাবেষ্টিত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তৈরি করার কথা ছিল। এ ছাড়া সাউন্ড সিস্টেম, লাইটিং এবং ডিজিটাল স্ক্রিনযুক্ত স্থায়ী আর্ট গ্যালারি ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি নিয়ে জাদুঘর করার কথা ছিল। ফার্স্ট ফ্লোরে রেস্তোরাঁ, ল্যান্ডস্কেপ, উন্মুক্ত স্থানে বসা এবং সুস্থধারার বিনোদনের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা রাখারও পরিকল্পনা করা হয়। এর জন্য পরামর্শক ফি দিতে হয় প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় কর্মকর্তাদের জন্য ছিল ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে বিদেশ ভ্রমণেরও সুযোগ। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান আরডিএর ৪-৫ জন, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং প্ল্যানিং কমিশনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল বিদেশ সফর করার কথা ছিল।

আরডিএ সূত্র মতে, অবকাঠামো নির্মাণের পর এ ভবনে লাইব্রেরির বইয়ের জন্য পাঁচ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা, প্রচার ও বিজ্ঞাপনে পাঁচ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়েছিল। এ ছাড়াও কম্পিউটার এবং কম্পিউটার যন্ত্রাংশ কেনার জন্য প্রথমে ১৫ লাখ টাকা, বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের ছবি ও তথ্য সংগ্রহ এবং রাজশাহী বিভাগের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সংগ্রহ এবং বঙ্গবন্ধু ছবি অঙ্কনের জন্য ৫০ লাখ টাকা, পাঁচটি লিফট কেনার জন্য তিন কোটি ২৬ লাখ টাকা, ১৪টি এয়ারকুলার ভিআরএফ, ৭টি এএইইউ (৪২ টন) কেনার জন্য তিন কোটি ৯০ লাখ টাকা, আসবাবপত্র কেনার জন্য দুই কোটি টাকা, ইলেকট্রিক সাবস্টেশনের ৬৬ লাখ ২২ হাজার টাকা খরচের প্রস্তাব ছিল। সব মিলিয়ে ৫৯ কোটি ২৮ লাখ টাকার প্রকল্পের ব্যয়ে গিয়ে দাঁড়াত ১২৪ কোটি ৭০ লাখ টাকায়। তবে শেষ পর্যন্ত শুধু অবকাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন করে ভবনটি ফেলে রেখেছে আরডিএ কর্তৃপক্ষ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরডিএ’র একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী অভিযোগ করে বলেন, ‘এত টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প হাতে নেওয়ার কোনো যুক্তিই ছিল না। শুধু সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খুশি করতে আর প্রকল্পের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের পকেট ভারি করতেই এ ধরনের ভুয়া কাজ হাতে নেওয়া হয়েছিল। আদৌ ওই ভবন নির্মাণের পরে সেখানে কি হবে বা কিভাবে ব্যবহার হবে সেটির সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনাও ছিল না। শুধু বঙ্গবন্ধুর কিছু ছবি যুক্ত হতো আর বাকি কাজ হতো দায়সারা। 

তাতেই শেষ হতো ১২৫ কোটি টাকা। এরই মধ্যে প্রায় ৬৩ কোটি টাকা জলে ঢালা হয়েছে। সরকারি এত বড় জায়গায় জনগণের বৃহৎ কোনো কাজে আসে এমন কোনো প্রকল্প নেওয়া যেত। অথবা আবাসন করে দিলেও এক দেড় হাজার পরিবারের বাসস্থানের ব্যবস্থা হতো। সেটি না করে আরডিএ নিজেদের কাজ ফেলে চলে যায় বঙ্গবন্ধুর জাদুঘর নির্মাণে। এটি পুরোটাই অবৈধ। এ কাজ আরডিএ’র ছিল না। আরডিএ করবে আবাসনের ব্যবস্থা বা নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা। সেটি না করে তারা শেখ হাসিনাকে খুশি করতে গেছিল। এর মাধ্যমে যে অপচয় ও অনিয়ম হয়েছে, তার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনের আওতায় আনা দরকার।’

তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল তারিক বলেন, এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি। তবে প্রথম ধাপে এ ভবনটির অবকাঠামো নির্মাণ হয়েছে। এখন আর বাকি কাজগুলো করা হবে না। বঙ্গবন্ধু চত্বর নাম থাকবে না। ভবনটি কি কাজে ব্যবহার হবে তাও ঠিক করা হয়নি। নতুন নামও ঠিক করা হয়নি। এসব নিয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত হবে বলে জানান তিনি।

আরবি/জেডআর

Link copied!