- মারামারি, গ্রুপিং, কমিটি গঠন নিয়ে মতানৈক্য
- ক্ষুণ্ন হচ্ছে বহির্বিশ্বে প্রবাসীদের ভাবমূর্তি
- যেকোনো অভিবাসী জনগোষ্ঠীর চেয়ে সক্রিয় বাংলাদেশিরা
রাজনৈতিক উত্তাপ-উত্তেজনা দেশের সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে প্রবাসে। ক্রমেই সংঘাতময় হয়ে উঠছে প্রবাসে বাংলাদেশি রাজনীতি। দেশের নানা ইস্যুতে যেভাবে রাজনৈতিক দলগুলো মুখোমুখি অবস্থানে থাকে ঠিক তেমনি বহির্বিশ্বেও দলগুলোর শাখা এখন দেশীয় কায়দায় সহিংস হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের স্বার্থ নিয়ে অনুষ্ঠিত নানা কর্মসূচিও এখন বহির্বিশ্বের রাজনৈতিক দলগুলোর দখলে।
এমনকি রয়েছে নিজ দলে নেতৃত্ব নিয়ে মারামারি, গ্রুপিং, কমিটি গঠন নিয়ে মতানৈক্য। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে বিদেশে নিয়ে আশায় চরম শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সাধারণ প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তারা মনে করেন, এতে বহির্বিশ্বে প্রবাসীদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
একসময় বহির্বিশ্বে প্রবাসীরা রাজনীতি করলেও দেশের রাজনৈতিক আদর্শ থেকে সরে এসে ভিনদেশের রাজনৈতিক আদর্শে থেকেই রাজনীতি করতেন। সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির এক অপরূপ দৃষ্টান্ত ছিল তাদের রাজনীতির মধ্যে। কিন্তু বর্তমানে তা থেকে সরে এসে হিংস্র হয়ে উঠেছে প্রবাসে বাংলাদেশের রাজনীতি। নানা ইস্যু নিয়ে তারা জড়িয়ে পড়ছেন ঝামেলায়। এমনকি আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে সমস্যা। পূর্বের মতো সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি নেই প্রবাসীদের মধ্য। দেশের স্বার্থে আগের মতো তারা একই মঞ্চে আসতে পারছেন না। বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশীয় রাজনীতিকে লালন করতে নিজের পছন্দের রাজনৈতিক দলের শাখা গঠন করেছেন। ইউরোপের ব্রিটেন, ইতালি, স্পেন, জার্মানসহ কানাডা, আমেরিকা, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের কাতার, সৌদি, ওমান, মালেয়েশিয়া, কুয়েতÑ এসব দেশেও বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াত, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, জাসদসহ সব দলেরই শাখা রয়েছে।
রয়েছে শাখা-উপশাখাও। এসব কমিটি গঠন নিয়ে রীতিমতো খণ্ডযুদ্ধের খবরও পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। আর প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘাত তো নিয়মিত। বিশেষ করে লন্ডন, নিউইয়র্কে দেশের যেকোনো রাজনৈতিক ইস্যুতে পাল্টাপাল্টি মিছিল, মিটিং, হুমকি, পুলিশ ডাকাডাকি সাধারণ বিষয়। প্রবাস জীবনে দেশের রাজনীতি চর্চায় বাংলাদেশিরা অন্য যেকোনো অভিবাসী জনগোষ্ঠীর চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়।
গত জুলাইয়ে কোটা আন্দোলন নিয়ে দেশের পাশাপাশি প্রবাসেও নানা কর্মসূচি পালিত হয়। ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সের সামনে আওয়ামী লীগের ঠিক সামান্য দূরেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে সমাবেশ করে বিএনপি। এতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে। গত ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মরণে স্থানীয় সময় বিকেলে পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে শোকসভা করে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ। একই সময়ে ওই পার্কে সমাবেশের ডাক দেয় যুক্তরাজ্য বিএনপি। পার্কের শহীদ মিনারে চত্বরে শোকসভা ও সমাবেশ করে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ।
৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর লন্ডনে এটিই ছিল আওয়ামী লীগের প্রথম কোনো কর্মসূচি। একই সময়ে পার্কের ভেতরে সমাবেশ করেছে যুক্তরাজ্য বিএনপির একটি অংশ।
এই সময়ে একই জায়গায় দুই দলের সমাবেশ ঘিরে উত্তেজনা দেখা দেয়। পার্কে এ সময় বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সন্ধ্যা ৬টার দিকে কর্মসূচি শেষ করে পার্ক থেকে বের হয়ে যাওয়ার পথে তাঁদের ওপর পানির বোতল ছুড়ে মারা হয়।
এ ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যতবার লন্ডন সফর করেছেন ততবারই তার হোটেলের বাইরে বিক্ষোভ করেছে যুক্তরাজ্য বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ। শুধু যুক্তরাজ্যে নয়, ইউরোপ-আমেরিকা এমনকি মধ্যেপ্রাচ্যের দেশগুলোতে একইভাবে বাংলাদেশি রাজনীতিতে সহিংসতা লেগেই আছে। লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের জেনারেল সেক্রেটারি ও সাপ্তাহিক দেশ সম্পাদক তাইসির মাহমুদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, যখনই বাংলাদেশের মন্ত্রী-এমপিরা দেশের বাইরে কোনো রাষ্ট্রীয় সফরে আসেন, তখন বিরোধীদলের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ করেন।
বিগত দিনে আমরা দেখেছি, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগের প্রবাসী নেতাকর্মীরা বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ করেছেন। আবার যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় তখন বিএনপির নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ করেন। এটা অবশ্যই বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই কালচার থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বেরিয়ে আসতে হবে। সম্প্রতি আমরা দেখেছি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলকে বিদেশের একটি এয়ারপোর্টে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নাজেহাল করেছেন। তাঁর সঙ্গে খুবই খারাপ আচরণ করা হয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক। একটা কথা বুঝতে হবে, আসিফ নজরুল কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা নন। তিনি কোনো রাজনৈতিক সরকারের মন্ত্রীও নন। ছাত্র-জনতার আন্দোলেনর মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে।
ওই সরকারে আসিফ নজরুলকে উপদেষ্টা করা হয়েছে। তাঁরা কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সরকারে আসেননি। একটি কঠিন পরিস্থিতিতে দেশকে সঠিকভাবে পরিচালনা করে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দিতে তারা কাজ করছেন। তারা দেশ ও জাতির স্বার্থে দায়িত্ব নিয়েছেন। তাদের আমাদের সর্বতোভাবে সহযোগিতা করা উচিত।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে কমপক্ষে ৫ লাখ নেতাকর্মী মারা যাবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের পলায়নের পর কত লোক মারা গেছে? তাহলে বোঝা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার চরম ক্রান্তিকালে দেশকে সঠিক পথেই পরিচালনা করেছে। তারা ওবায়দুল কাদেরের আশংকা থেকে তাদের নেতাকর্মীদের বাঁচিয়েছে। তাই আসিফ নজরুলসহ অন্তর্বর্তী সরকারের সব উপদেষ্টার কাছে আওয়ামী লীগের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
আরও একটা লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে আমরা দেখছি। কিন্তু এখানে ডক্টর ইউনূসের দোষটা কী? তিনি তো শেখ হাসিনাকে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য করেননি।
তিনি তো ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান দুই দিন আগেও তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তিনি জানতেন, দেশে ফিরে তাঁকে জেলে যেতে হতে পারে। ছাত্রসমাজের অনুরোধে দেশের ক্রান্তিকালে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিলেন।
সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের পরামর্শেই তো শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগে বাধ্য হলেন। তাহলে প্রফেসর ইউনূসের বিরুদ্ধে এত বিষোদ্গারের কারণ কী?
আপনার মতামত লিখুন :