ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

মূল্যস্ফীতির হুঙ্কারে কাঁপছে শহর-গ্রাম

শাহীনুর ইসলাম শানু

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৩, ২০২৪, ০১:০৮ এএম

মূল্যস্ফীতির হুঙ্কারে কাঁপছে শহর-গ্রাম

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

#মূল্যস্ফীতি হলেও দেশে দুর্ভিক্ষ হবে না: গভর্নর

#দাম কমাতে আরও ৮ মাস সময় দিতে হবে
#শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষকে ভোগাচ্ছে বেশি

#সার্বিক মূল্যস্ফীতি ফের ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে

#দিনাজপুরের হিলি দিয়ে চাল আমদানি শুরু


নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে মূল্যস্ফীতির হুঙ্কার। শহর-গ্রাম সর্বত্র সেই হুঙ্কারে ভীত মানুষ। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যÑচাল, ডাল, মাছ ও মাংসের দাম বেড়েছে। ডলারে দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আরো উসকে দিয়েছে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি বা মূল্যস্ফীতি। 

ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আমদানি শুল্ক ও রেগুলেটরি শুল্ক কমিয়েছে সরকার। অন্যদিকে তিন ধাপে অর্থাৎ সর্বশেষ ২২ অক্টোবর নীতি সুদহার ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবুও ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতির হার বাঁধতে পারছে না। উচ্চমূল্যের বাজারে সীমিত আয়ে সংসারের ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। শহর-গ্রাম কোথাও স্বস্তি মিলছে না। শহরের চেয়ে গ্রামেই খাদ্যপণ্যের দাম বেশি। তবে মূল্যবৃদ্ধিকে সরকারের অনিয়ন্ত্রিত সিন্ডিকেটকে দুষছেন খাবি খাওয়া অনেক মানুষ।

তবে দাম কমাতে দীর্ঘ ১৯ মাস ১০ দিন পর দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে আবারও ভারত থেকে চাল আমদানি শুরু হয়েছে। তিনটি ট্রাকে প্রায় ১২০ টন চাল আমদানি করা হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে গতকাল সোমবার দুপুরে আমদানি করা চাল প্রতি কেজি চাল ৪৮ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হবে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

মূল্যস্ফীতিতে ইতিমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। যদিও ডলারের মূল্যবৃদ্ধিকে দুষছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ও সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর গতকাল সোমবার বলেছেন, মূল্যস্ফীতি হলেও দেশে দুর্ভিক্ষ হবে না। কারণ আমাদের গ্রোথ কমেনি। চার মাস পার করছি, মূল্যস্ফীতি কমাতে আমাকে আরও আট মাস সময় দিতে হবে। বিগত সময়ে ব্যাংক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে দ্রুত সব সমাধান হবে না। কারণ এক ব্যাংকের ২৭ হাজার কোটি টাকার এসেট এক পরিবার ২৩ হাজার নিয়েছে, সেখানে আমার হাতে ম্যাজিক নেই। তবে কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না, এটা বলতে পারি।

মূল্যস্ফীতি নিয়ে সচিবালয়ে সম্প্রতি তিনি বলেন, অক্টোবরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি আবারও ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। তবে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। মূলত গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরের বন্যার প্রভাবে অক্টোবরে দেশের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ডলার রেট বর্তমানে স্থিতিশীল আছে।

সুতরাং মূল্যস্ফীতি কমতে বাধ্য। গত সরকারের আমলে মূল্যস্ফীতি জোর করে কমিয়ে রাখা হতো। কিন্তু জুলাইয়ের পর থেকে এটা ফ্রি হয়েছে। তবে পণ্যের দাম কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও সময় লাগবে। সাত বছর ধরে বেড়ে চলা মূল্যস্ফীতি হঠাৎ করেই কমানো যাবে না। মানুষকে ধৈর্য ধরতে হবে।

সরকার পতনের পর অক্টোবরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ, খাদ্যপণ্যে তা আরও বেড়ে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশে ঠেকেছে। চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ, মাংস, সবজি, মসলা ও তামাকজাত পণ্যের দাম বাড়ায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে।

সরকার পতনে গত বছর শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হলে মূল্যস্ফীতি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে। সময়ের ব্যবধানে দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা এখন সর্বনিম্নে রয়েছে। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো খাদ্যপণ্যের দাম সেখানে সহনীয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, অক্টোবর মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। যা সেপ্টেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। এ মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশে, যা আগের মাসে ছিল ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ মাসের ব্যবধানে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে প্রায় এক শতাংশ আর খাদ্যমূল্যস্ফীতি বেড়েছে সোয়া দুই শতাংশ।

আগস্টে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে কমার পর অক্টোবরে আবারও বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। আর গত জুলাইয়ে দেশে জাতীয় পর্যায়ে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ওই মাসে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ হারে।

বাংলাদেশ প্রায় দুই বছর ধরে ক্রমবর্ধমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করছে। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে আছে। যার প্রভাব পড়েছে দেশের নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর।

ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো খাদ্যপণ্যের দামে লাগাম টানতে পারছে না সরকার। বেশ কয়েক ধাপে ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়িয়েও কোনোভাবেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ আগস্টের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার পর উত্তরাঞ্চলেও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় মানুষের কৃষিজমি ডুবে ফসল নষ্ট হয়, খামারগুলো নষ্ট হয়ে হাঁস-মুরগির সরবরাহ ব্যবস্থায় ঘাটতি দেখা দেয়। তা ছাড়া দেশের সিন্ডিকেট ব্যবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকায় পণ্যের দাম কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না।

খাদ্য মূল্যস্ফীতি লাগাম ছাড়িয়ে গেলেও বিবিএসের তথ্য বলছে, অক্টোবরে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশে নেমেছে, যেটি আগের মাস সেপ্টেম্বরেও ছিল ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির ধকল শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষের বেশি।

তথ্য বলছে, অক্টোবরে শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হয়েছে। এ মাসে গ্রামাঞ্চলে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ, খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। বিপরীতে একই সময়ে দেশের শহর এলাকাগুলোতে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ, খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে ২০২০ সালের এপ্রিলে ব্যাংকঋণের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশ বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে মেয়াদি আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ বেঁধে দেওয়া হয়। এরপর দীর্ঘ তিন বছরের বেশি সময় ধরে ঋণ ও আমানতের সুদহার এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

সর্বশেষ গত ২২ অক্টোবর নীতি সুদহার ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা ২৭ অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়েছে। এতে সব ধরনের ঋণের সুদের হার চলতি মাসে আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।

আরবি/জেডআর

Link copied!