ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

ডলার বিক্রেতা থেকে এমপি সিরাজ মোল্লা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৩, ২০২৪, ০১:১২ এএম

ডলার বিক্রেতা থেকে এমপি সিরাজ মোল্লা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

#শিবপুরে গড়েন ‘পরিবার লীগ’
#নারায়ণগঞ্জে এক দিনের রিমান্ডে
#সোনা চোরাচালান মামলার আসামি
#হাজার কোটি টাকার মালিক


নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় আহাম্মদ আলী নামে এক যুবককে হত্যাচেষ্টার মামলায় নরসিংদী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) সিরাজুল ইসলাম মোল্লা ওরফে ডলার সিরাজের এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ বদিউজ্জামানের আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। আদালত শুনানি শেষে এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গত সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আসাদগেট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সিরাজুল ইসলাম মোল্লা ওরফে ডলার সিরাজকে। তিনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নরসিংদী থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন। তিনি আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি পদেও আছেন। এ ছাড়া সিরাজুল ইসলাম ওরফে ডলার সিরাজ পিপলস ইউনিভার্সিটি নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান।

জানা যায়, একসময় তিনি কালোবাজারে ডলার বিক্রি করেছেন। তারপর জড়িয়ে যান সোনা চোরাচালানে। দুই হাতে অবৈধ টাকা আয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারেও লেগে পড়েন। সেই চেষ্টায়ও বেশ সফল। নিজ এলাকায় দুবারের সংসদ সদস্য তিনি। এরপর অবৈধ জমি দখলসহ বিতর্কিত আরও নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন।

সূত্র জানায়, নরসিংদী-৩ (শিবপুর) আসনের সাবেক এমপি সিরাজ তার রাজনৈতিক বা দলীয় তকমা থেকেও বেশি পরিচিতি ‘ডলার সিরাজ’ নামে। আশি-নব্বইয়ের দশকে রাজধানীর মতিঝিলে ব্যাংক পাড়ায় কালোবাজারে ডলার বিক্রি করতেন তিনি। ডলার বেচাকেনার পাশাপাশি জড়িয়ে যান সোনা চোরাচালানে। এসব ঘটনায় মামলার আসামিও হয়েছেন কয়েকবার।

একপর্যায়ে কালোবাজারির বদনাম ঘোচাতে তিনি রাজনীতিতে পা রাখেন। আওয়ামী লীগের শাসনামলে হয়েছেন দুবার সংসদ সদস্য। তার বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। সেখানে তাঁর বাড়ি রয়েছে বলে পরিবারের একাধিক সদস্য জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, সিঙ্গাপুরে সিরাজের ‘সেকেন্ড হোম’ রয়েছে।

জানা যায়, সিরাজুল ইসলাম মোল্লা ওয়ান-ইলেভেনের পর আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন। পরে বিপুল পরিমাণ অনুদান দিয়ে রাজনীতিতে পা রাখেন শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের উপদেষ্টা হিসেবে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সর্বশেষ নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে দশম সংসদে প্রথম তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একাদশ সংসদে পরাজিত হলেও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সিরাজ মোল্লা। 

এদিকে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে জেলার রাজনীতিতে নিজেকে তেমন প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলেও অবৈধ টাকার জোরে শিবপুরে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘পরিবার লীগ’। নিজের স্ত্রী ফেরদৌসী ইসলামকে বানিয়েছেন শিবপুর উপজেলা মহিলা লীগের সভাপতি। গত ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে হয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যানও। নিজের আপন ছোট ভাই সামসুল ইসলাম মোল্লাকে বানিয়েছেন জেলা যুবলীগের সহসভাপতি। আরেক ছোট ভাই মাহবুবুল আলম মোল্লা তাজুলকে বানিয়েছেন শিবপুর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে তাজুল ইসলাম মোল্লাকে শিবপুর পৌরসভার মেয়র বানানোর পরিকল্পনা ছিল সিরাজ মোল্লার।

সিরাজ মোল্লার যত সম্পদ : সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাখিল করা হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তিনি কয়েক শ কোটি টাকার সম্পদের মালিক। তার বার্ষিক আয় ১০ কোটি ৪৩ লাখ ৪৯ হাজার ৬২৭ টাকা। এ ছাড়া তার নিজ নামে অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে ১৩৯ কোটি ৮৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৬৯ টাকার এবং স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে ১১ কোটি ৭৭ লাখ ৯২ হাজার ৯১৬ টাকার। তবে তার প্রতিটি সম্পদের মূল্যমানে অসামঞ্জস্য রয়েছে। এর মধ্যে তার স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে ৯২.৭৫ শতাংশ একটি কৃষিজমির অর্জনকালীন দাম দেখিয়েছেন মাত্র ৯ হাজার ৮০০ টাকা। এ ছাড়া সিরাজুল ইসলাম মোল্লা প্রাইম ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান। তিনি চায়না-বাংলা সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বেঙ্গল টাইগার সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বাজনাবো টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, ইউনাইটেড শিপিং লাইন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এ ছাড়া তিনি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের সদস্য এবং বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০১ সালে উচ্চ আদালতে এবং ২০০৩ সালে মহানগর দায়রা জজ আদালতে সিরাজুল ইসলাম মোল্লার বিরুদ্ধে চোরাচালানের অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইনে দুটি মামলা হয়। এর একটি মামলায় হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ রয়েছে। এ ছাড়া ২০১৭ সালে তার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক জমি দখলের অভিযোগে দুটি এবং ২০১৯ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি ভোটকেন্দ্রে এক প্রার্থীর এজেন্টকে গলা কেটে হত্যার অভিযোগে মামলা করা হয়। পরে অবশ্য তিনি মামলাগুলো থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন।

এদিকে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের দোসর সিরাজুল ইসলাম মোল্লার গ্রেপ্তারের খবরে এলাকার আপামর জনসাধারণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। তারা এই নরপিশাচ ডলার সিরাজের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, সিরাজুল ইসলাম মোল্লা ও তার পালিত সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারত না।

আরবি/জেডআর

Link copied!