জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে আওয়ামী লীগের মতো পরিবারতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
তিনি বলেন, কোনো সরকারই যেন স্বৈরাচার হয়ে উঠতে না পারে সে কারণে একজন ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হয় তা সংবিধানে সংযোজন করা হবে। গণমাধ্যমে স্বাধীনতা নিশ্চিতে অঙ্গীকারও করেন তিনি। সংস্কার শুধু কাগজে নয়, মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন চায় বলেও জানান তারেক রহমান।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর হোটেল লেকশোরে ‘৩১ দফা রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন।
তারেক রহমান বলেন, আমরা এমন দেশ গড়তে চাই, যেখানে আর কখনো ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে না। আগামীতে আর কোনো ব্যক্তি এমনি প্রধানমন্ত্রীও স্বৈরাচার হয়ে উঠতে পারবে না। তিনি বলেন, ক্ষমতার পরিবর্তন মানে একদল থেকে অন্য দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর নয়। তাই প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনার জন্যও যেন কাউকে হেনস্তা না করা হয় সেই বিষয়ে নিশ্চয়তা দেওয়া হবে। গণমাধ্যমের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষার নিশ্চয়তা দেওয়া হবে।
তারেক রহমান বলেন, আমরা সবাই একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ চাই, যেখানে জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা কেউ কেড়ে নেবে না। সবাই একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত বাংলাদেশ চাই, যেখানে গণআকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। নির্বাচিত ও জবাবদিহিমূলক সরকার নিশ্চিত করবে জনগণের মালিকানা ও অংশীদারিত্ব।
তিনি আরও বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করলেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা-অনুতাপ নেই।
৩১ দফা সংস্কারে দলটি বলে, ফ্যামিলি কার্ড, বেতার ভাতা, দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণে ইউপি পর্যন্ত সেল সেন্টার নির্মাণ হবে, কৃষিকে ইন্ড্রাস্ট্রি করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে, উন্নয়নের নামে দুর্নীতি বন্ধ করা হবে। ঐতিহাসিক খাল খনন কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে, ব্লু ইকোনমি নিয়ে বিশদ কাজ করা হবে। সব নাগরিকের জন্য আবাসিক সুবিধা করা হবে। সেমিনারের শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, সেখানে বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফার অনেকটাই মিল রয়েছে।
৩১ দফার ওপর আলোচনা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, সংবিধানের মূল নীতি হওয়া উচিত; সাম্য, সামাজিক মর্যাদা ও ইনসাফ এগুলোই ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মূলনীতি। এ ছাড়াও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার জন্য আমাদের প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা যাওয়া হবে বিপৎগামী চিন্তা।
এবি পার্টি নেতা ফুয়াদ বলেন, ‘৩১ দফার মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের জন্য কোনো দফা নাই, সব দফা রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য। ’৭০-এর অনুচ্ছেদ শুধু সংসদেই চর্চা করলে চলবে না, এটা দলীয় অভ্যন্তরেও আলোচনা করার কালচার তৈরি করতে হবে।’ জামায়াতে ইসলামী সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান বলেন, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের লগি-বইঠার হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরে ফ্যাসিবাদে ধ্বংস করে দিয়েছে, তাই রাষ্ট্রকে মেরামত করতে হবে। আমরা জামায়াতে ইসলামি মনে করি, জাতির প্রয়োজনে যখন যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন ততটুকু সংস্কার করতে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে। সব সংস্কার হতে হবে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে।
জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, বিএনপির ৩১ দফায় কোনো নিরাপদ অধ্যায় নেই। ২০১৪ সালে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং যখন এ দেশে একতরফা নির্বাচন করে দিয়ে যায়Ñ সেটা বন্ধ করার ক্লোজ থাকতে হবে রাষ্ট্র সংস্কারে। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনে আমার দলের জন্য ভালো, বিএনপি জন্য লস, কারণ আমার দল ১/২ শতাংশ ভোট পেলে সংসদে ৩-৬টি আসন পাবে, বর্তমান পদ্ধতিতে ৩০০ আসনের একটিতেও জিতবে না। তবে আমার ভয় হয় সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনি ব্যবস্থায় আওয়ামী ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে আসে কি না সেটা নিয়ে। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সংসদের কীভাবে সংখ্যালঘু, পাহাড়ি, সমতল, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, উপজাতির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে বিএনপিকে। এ ছাড়াও যারা নির্বাচনে হেরে যাবে তাদের ভয়েসটা কীভাবে সংসদে তুলে ধরা যায় সেটাও ভাবতে হবে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনি যাওয়া উচিত কি না সেটা নিয়েও আলোচনা করা দরকার। জাতীয় পার্টি বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, বিএনপির ৩১ দফায় শেষ নয়, সময়ের সাথে সাথে আরও যেন যুক্ত করতে পারি সে বিষয়টি রাখতে হবে। লেবার পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, সংবিধানে কিছু মীমাংসিত বিষয় আছে ধর্ম ইসলাম, আল্লাহর উপর আস্থা, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, এ বিষয়গুলো নিয়ে কোনো মঞ্চে আলোচনার প্রয়োজন নেই।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য ফারজানা শারমিন পুতুল এবং সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ এর সঞ্চালনায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাউদ্দিন আহম্মেদ, আব্দুল মঈন খান, সেলিমা রহমান, হাফিজ উদ্দিন, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান আবু তাহের, জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ববি হাজ্জাজ, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মিস হুমা খান, পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ, ভারতের ডেপুটি হাই কমিশনার বিনয় গরগে, জাপানের রাষ্ট্রদূত লাউয়ামা কিমিনরি, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এখন আর্লাদ গাল ব্রান্ডেশন, সুইজারল্যান্ডের ডেপুটি রাষ্ট্রদূত করনি হেন্স পিনানি, ইরানের রাষ্ট্রদূত মান সলোরচাভোসী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেপুটি রাষ্ট্রদূত ব্র্যান্ড স্পিনার, নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের চার্চ দ্য অ্যাফেয়ার্স সোনজা কুইপ, নেপাল দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশন ললিতা সিলাওয়াল, ব্রুনাইয়ের হাইকমিশনের ডিফেন্স অ্যাডভাইজর হারিস বিন উথমান, অস্ট্রেলিয়া হাইকমিশনের ডিফেন্স অ্যাডভাইজর জন ডেমপেসি, কানাডিয়ান হাইকমিশনার হেড অব পলিটিকাল ব্র্যাডলিক কোটচ, চায়না দূতাবাসের কাউন্সিলর ও পলিটিক্যাল প্রধান জিং উইসহ ৩৮ দেশের কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন বলে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান।
আপনার মতামত লিখুন :