ঢাকা শনিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৪

একাত্তরে মুসুলম নামে আত্মগোপনে ছিলেন শম্ভু

তাপস মাহমুদ, বরগুনা

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৬, ২০২৪, ০১:৩২ এএম

একাত্তরে মুসুলম নামে আত্মগোপনে ছিলেন শম্ভু

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বরগুনা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বীর মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে সরকারি সব সুবিধা ভোগ করলেও এবার উঠে এসেছে তার বিরুদ্ধে চমকপ্রদ তথ্য। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন মুসলিম সেজে এলাকায় ছিলেন আত্মগোপনে। এ সময় তিনি নাম পরিবর্তন করে ইকবাল মাসুদ খান নামে চলাফেরা করতেন। যুদ্ধেও পর তিনি পুনরায় ধীরেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ নাম ব্যবহার শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও মুক্তিযোদ্ধা খেতাব নিয়ে সরকার থেকে সব সুবিধা ভোগ করতেন তিনি।

অভিযোগ উঠেছে, তার অনুসারী বরগুনা জেলা মুক্তিযুদ্ধের সাবেক কমান্ডার এবং বিতর্কিত আ. রশীদ তাকে মুক্তিযোদ্ধা খেতাবে অন্তর্ভুক্ত করেন।

ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু সংসদ নদস্য হয়ে রাতারাতি সম্পদের মালিক বনে যান। বরগুনাবাসীর কাছে মনে হয় যেন তিনি আলাদিনের চেরাগ পেয়েছেন। সম্পদ ও ক্ষমতা বাড়াতে পথের সামনে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী যে হয়েছে, তার কূটচালে তাদের রাজনৈতিক জীবন, ব্যক্তিজীবনে দিতে হয়েছে খেসারত। যারাই বরগুনায় জনপ্রিয় হয়ে উঠতেন, তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে রাজনৈতিক পদ-পদবি থেকে রাখতেন বঞ্চিত। এমনকি তাদের বিভিন্ন স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিয়ে বিপরীত প্রার্থীর কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকার লেনদেনে তাদের হারিয়ে দিতেন। তার এই ক্যারিশমায় বহু রাজনৈতিক নেতা হয়েছেন নিঃস্ব। এর মধ্যে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন।

জনপ্রিয় এই নেতার সঙ্গে সপ্তম সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে হেরে গিয়ে বলেছেন ভোট কেটে নির্বাচিত হয়েছেন দেলোয়ার। এ ছাড়া যুবলীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান মহারাজ মেয়র পদে নৌকা প্রতীক পেয়ে নির্বাচন করলে তাকে সহযোগিতা না করে তারই অনুসারী এক ব্যবসায়ীকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে বিজয়ে তার হাত ছিল। এমনভাবে তার কূটচালে হারতে হয়েছে আরেক জনপ্রিয় ছাত্রনেতা বরগুনা সরকারি কলেজে ছাত্র সংসদের ভিপি ও বরগুনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ মোহাম্মদ ওয়ালী উল্লাহকে। জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও সামনে কোণঠাসা ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম সরোয়ার টুকু, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খলিলুর রহমান, আমতলী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ গোলাম সরোয়ার ফোরকানসহ বহু নেতাকর্মী। সবচেয়ে প্রতিহিংসার শিকার ছিল বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও জনপ্রিয় সংসদ সদস্য মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিকুর রহমানের পরিবার ও সাবেক সংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম দেলোয়ার হোসেন।

বরগুনা জেলার আওয়ামী লীগকে সব দুঃসময়ে আগলে রাখতেন দলের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির। দল যখনই সুবিধায়  আসত, তাকেও তখন কোণঠাসা করে রাখতে পিছপা হতেন না ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু।

অভিযোগ, তিনি যখন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করেছেন, তাকে হারাতেও পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছেন শম্ভু। গত একাদশ নির্বাচনের আগে বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা তার স্বেচ্ছাচারিতা, নানা অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিলেন সংবাদ সম্মেলন করে। একাদশ সংসদের সদস্য হয়ে জাহাঙ্গীর কবিরকে দাবিয়ে রাখতে তার বোনের ছেলে জেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বেতাগী উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ইমাম হোসেন শিপন জমাদ্দারের প্রতিদ্বন্দ্বী ডাকাত সর্দার ইউসুফ শরীফকে মদদ দিতেন। ২০২২ সালে একটি অনুষ্ঠান শেষে ফেরার পথে তাকে কুপিয়ে আহত করা হয়। এরপর ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ডাকাতদের শম্ভু ও তার ছেলে সুনাম দেবনাথ আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। এ নিয়ে তার সামনে দলের অনেকে প্রতিবাদ করলে তিনি এরিয়ে যেতেন।

শম্ভুর অপকর্মের শিকার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মচারীরাও। এমপিওভুক্ত হতে দিতে হতো তাকে মোটা অঙ্কের টাকা। দলের সিনিয়র নেতাদের এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে টাকা না পাওয়ায় বছরের পর বছর ধরে এমপিওভুক্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে হয়েছে চরম ভোগান্তির শিকার। আমতলীর দুটি কলেজের এমপিওভুক্ত করতে ঘুষ নিয়েছেন ৪৭ লাখ টাকা। বছরের পর বছর ঘুরে কলেজ দুটি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় টাকা ফেরত চাওয়ায় হতে হয়েছে তাদের নানা হয়রানির শিকার।

বরগুনার আমতলী উপজেলার বকুলনেছা মহিলা ডিগ্রি কলেজ ও টিয়াখালী কলেজ এমপিওভুক্তির কথা বলে যে টাকা নিয়েছে শম্ভুর পরিবার, তা ফেরত দেওয়ার কথা বলছেন। তাদের দাবি দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও ওই কলেজ দুটি এমপিওভুক্ত করেননি শম্ভু। 

ভুক্তভোগী শিক্ষকেরা সংসদ সদস্য শম্ভুর কাছে ওই টাকা ফেরত চাইতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন তারা। ভুক্তভোগী শিক্ষকেরা তার পরিবারের কাছে দ্রুত এই টাকা ফেরত দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। আমতলী উপজেলার বকুলনেছা মহিলা কলেজটিতে ২০১০ সালে ডিগ্রি শাখা খোলা হয়। ২০১৮ সালে ওই কলেজের ডিগ্রি শাখা এমপিওভুক্ত করে দেওয়ার কথা বলে বরগুনা-১ আসনের সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে ২২ লাখ টাকা ঘুষ নেন। ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও কলেজটির ডিগ্রি শাখা এমপিওভুক্ত হয়নি। এ ছাড়া একই উপজেলার টিয়াখালী কলেজটি এমপিওভুক্ত করে দেওয়ার কথা বলে ২০১৬ সালে ২৫ লক্ষ টাকা ঘুষ নেন শম্ভু। এই কলেজ এমপিওভুক্ত হয়নি। এমপিওভুক্ত না হওয়ায় কলেজ দুটির শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী চরম কষ্টে আছেন। ভুক্তভোগী শিক্ষকদের কাছ থেকে নেওয়া ৪৭ লাখ টাকা শম্ভু আট বছরেও ফেরত দেননি। ওই টাকা ফেরত চাইতে গিয়ে শিক্ষকেরা নানাভাবে এমপির হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেন তারা। 

বকুলনেছা মহিলা ডিগ্রি কলেজের কর্মচারী রশিদ মৃধা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘শেষ সম্বল ছিল একটি গরু। ওই গরু বিক্রি করে ১ লাখ টাকা এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে দিয়েছি। কিন্তু আমাদের বিল করে দেয়নি। ওই টাকা চাইতে গিয়ে আমি হেনেস্তার শিকার হয়েছি। আল্লাহ এর বিচার করছেন। আমার মতো গরিব মানুষের টাকা মেরে খেয়েছে, আল্লাহ সইবে না।’

বকুলনেছা মহিলা কলেজের প্রভাষক শাহিনুর তালুকদার বলেন, কলেজটির ডিগ্রি শাখা এমপিওভুক্ত করার কথা বলে সাবেক সংসদ সদস্য শম্ভু আমদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। কলেজটির ডিগ্রি শাখা এমপিওভুক্ত হয়নি। ওই টাকা  শম্ভুর কাছে চাইতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছি।

টিয়াখালী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘জীবনে যা আয় করেছি, তার অধিকাংশ টাকা খরচ করে কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছি। ২০১৬ সালে কলেজটি এমপিওভুক্ত করতে ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ২৫ লাখ টাকা নিয়েছেন। কিন্তু কলেজটি এমপিওভুক্ত হয়নি। টাকা চাইতে গেলে দেব বলে কালক্ষেপণ করছেন। গত আট বছর পেরিয়ে গেলেও একটি টাকা ফেরত দেননি শম্ভু, উল্টো নানাভাবে হয়রানি করছেন। আমরা এই টাকা তার পরিবারকে ফেরত দেওয়ার দাবি জানাই।’ এ ব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।

আরবি/জেডআর

Link copied!