ঢাকা রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২৪
চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানের পণ্যবাহী জাহাজ

কনটেইনারের পণ্য নিয়ে অপপ্রচার

শহিদুল ইসলাম রাজী

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৭, ২০২৪, ১২:০২ এএম

কনটেইনারের পণ্য নিয়ে অপপ্রচার

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

পাকিস্তানের করাচি থেকে পণ্যবাহী জাহাজে করে কী আনা হয়েছে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। কেউ কেউ অপপ্রচার-গুজব চালাচ্ছে কনটেইনারে আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। দেশে গৃহযুদ্ধ হতে পারে বলেও গুজব ছড়াচ্ছে একটি কুচক্রী মহল। কেউ বা প্রচার করছে চট্টগ্রাম বন্দরে ‘উয়ান জিয়াং ফা ঝান’ জাহাজটি পৌঁছানোর কারণে দুই কাস্টমস কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। ফলে করাচি থেকে আসা কনটেইনারে কী পণ্য আনা হয়েছে তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস জানিয়েছে, পাকিস্তান থেকে আমদানি হওয়া কনটেইনারে রয়েছে শিল্পের কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য। এ ছাড়া কাস্টমসের কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়নি। সামাজিক মাধ্যমে যে দুইজনের বদলির কথা বলা হয়েছে ওই নামে চট্টগ্রাম কাস্টমসে কোনো কর্মকর্তা নেই বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস।

পাকিস্তানের করাচি থেকে পণ্যবাহী জাহাজ ‘উয়ান জিয়াং ফা ঝান’ গত সোমবার চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে। জাহাজে থাকা ৩৭০ একক কনটেইনার খালাস করে পরদিন মঙ্গলবার বন্দর ছেড়ে ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশে রওনা হয় জাহাজটি।পাকিস্তানের করাচি সমুদ্রবন্দর থেকে পণ্যবাহী জাহাজগুলো এত দিন চট্টগ্রাম বন্দরে আসত সিঙ্গাপুর বা শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দর হয়ে। পানামার পতাকাবাহী এ জাহাজে ৩৭০ একক কনটেইনার পণ্য ছিল। আর এটি ছিল করাচি থেকে সরাসরি চট্টগ্রামে নোঙর করা প্রথম কোনো জাহাজ।

বন্দরসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পাকিস্তানের ‘ইউয়ান জিয়াং ফা ঝান’ কনটেইনার জাহাজ গত রবিবার চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছায়।

পরদিন বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)-৩ জেটিতে এটি ভিড়ে। কনটেইনার নামানো শেষে মঙ্গলবার জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে যায়। এমন সব আলোচনার মধ্যে গত রবিবার পাকিস্তান থেকে সরাসরি কোনো কনটেইনারবাহী জাহাজ প্রথম চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে নোঙর ফেলে। ভিন্ন পথে প্রথম করাচি থেকে আসা জাহাজের পণ্য নিয়ে শুরু হয়েছে রহস্য।

জানা গেছে, জাহাজটির দেশীয় শিপিং এজেন্ট রিজেন্সি লাইনস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি আওয়ামী লীগের সাবেক পরিবেশমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর মালিকানাধীন কর্ণফুলী গ্রুপের। গ্রুপটির নির্বাহী পরিচালক আনিস উদ দৌলার সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তার সাড়া মেলেনি।

বন্দরসূত্র জানায়, জাহাজটিতে ৩৭০ একক (প্রতিটি ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে) আমদানি পণ্যভর্তি কনটেইনার ছিল। তবে সব কনটেইনার করাচি থেকে এসেছে কি না, তা নিশ্চিত নয়।

সাধারণত ঘোষণা অনুযায়ী পণ্য ঠিক আছে কি না, তা যাচাই করে ছাড়পত্র দেয় কাস্টমস। এর পরই আমদানিকারকেরা খালাস করে নেন।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের জয়েন্ট কমিশনার মোহাম্মদ মারুফুর রহমান বলেন, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল, সোডিয়াম কার্বনেট বা সোডা অ্যাশ, কিছু রম্যাটেরিয়ালস, কিছু কেমিক্যাল ও ফেব্রিক্স আনা হয়েছে। এগুলো ডেলিভারি দেওয়ার কার্যক্রম চলছে। আমরা এগুলো এখনও চেক করছি। এতে কোনো প্রকার বিস্ফোরকদ্রব্য বা আগ্নেয়াস্ত্র আছে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ৫৭টা বিএল-এর বিপরীতে ৩২৮টি কনটেইনার আছে। প্রতিটি কনটেইনার চেক করা হয়েছে। এ ধরনের কোনো কিছু নেই। দুই কর্মকর্তা বদলির বিষয়ে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম কাস্টমসের কোনো কর্মকর্তা বদলি হয়নি। যাদের নাম বলা হয়েছে রাসেল হোসেন ও খালেদ হোসেন এই নামে কোনো কর্মকর্তাবআমাদের বন্দরেও নেই কাস্টমসেও নেই।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, করাচি থেকে কনটেইনারবাহী প্রথম জাহাজ চট্টগ্রামে আসার পরদিন ছেড়ে গেছে। জাহাজটি দুবাই থেকে করাচি হয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছে গত ১১ নভেম্বর। পণ্যবাহী কনটেইনার চট্টগ্রামের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে খালাস করা হয়। এরপর ১২ নভেম্বর ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যায় জাহাজটি।’ 

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে নৌপথে করাচির নতুন পথ চালু হয়েছে। ইতিমধ্যে এই পথে আসা প্রথম জাহাজ বন্দর ঘুরে গেছে। ১৯৭১ সালের পর এই প্রথম করাচি থেকে পণ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এলো। যেসব কনটেইনার খালাস হয়েছে, সব কটি পাকিস্তান থেকে আনা হয়নি। কিছু কনটেইনার দুবাই বন্দর থেকেও এসেছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জাহাজটি দুবাই থেকে করাচি হয়ে চট্টগ্রাম এসেছিল। চট্টগ্রাম থেকে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া হয়ে আবার দুবাই যাবে। আশা করি, এই পথে জাহাজটি নিয়মিত চলবে।

কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, পাকিস্তান থেকে আমদানি হওয়া কনটেইনারে শিল্পের কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য রয়েছে। যার ওজন ছয় হাজার ৩৩৭ টন। এসব পণ্য আমদানি করেছে আকিজ গ্লাস কারখানা, নাসির ফ্লোট গ্লাস, প্যাসিফিক জিনস, এক্স সিরামিকস, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, হাফিজ করপোরেশন, এম আর ট্রেডিংস ও চট্টগ্রামের আল্লাহর রহমত স্টোরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

জানা গেছে, পাকিস্তানের ১৮টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এসব পণ্য সরবরাহ করেছে। পাকিস্তান থেকে জাহাজটিতে করে সবচেয়ে বেশি আনা হয়েছে সোডিয়াম কার্বনেট বা সোডা অ্যাশ। গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় এটি। মোট ১১৫ কনটেইনারে রয়েছে সোডা অ্যাশ। এ ছাড়া রয়েছে খনিজ পদার্থ ডলোমাইট। ৪৬টি কনটেইনারে রয়েছে ডলোমাইট। ৩৫টি একক কনটেইনারে আনা হয়েছে চুনাপাথর। ম্যাগনেশিয়াম কার্বোনেট আনা হয়েছে ছয় কনটেইনারে। এ ছাড়া কাচশিল্পের কাঁচামাল ভাঙা কাচ আনা হয়েছে ১০ কনটেইনারে। শতভাগ রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পের কাঁচামাল কাপড়, রং ইত্যাদি রয়েছে ২৮ কনটেইনারে। একটি কনটেইনারে রয়েছে গাড়ির যন্ত্রাংশ। শিল্পের কাঁচামাল ছাড়াও পেঁয়াজ আনা হয়েছে ৪২ একক কনটেইনারে ৬১১ টন। এ ছাড়া ১৪ একক কনটেইনারে আলু আমদানি হয়েছে ২০৩ টন। এই দুটি পণ্য আনা হয়েছে হিমায়িত কনটেইনারে।

এদিকে করাচি-চট্টগ্রাম নৌপথ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে সমন্বিত ও বাণিজ্য নেটওয়ার্ক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ। একই সঙ্গে এটি দুই দেশের বাণিজ্য এবং ব্যাবসায়িক সম্পর্ক বৃদ্ধি করবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

সৈয়দ আহমেদ মারুফ বলেন, এই উদ্যোগ কেবল বিদ্যমান বাণিজ্য প্রবাহকে ত্বরান্বিত করবে না, বরং ছোট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় রপ্তানিকারকদের ব্যবসার নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে। প্রতি মাসে একবার করাচি থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে পণ্যবাহী জাহাজ ছেড়ে যাবে বলে জানিয়েছে রিজেন্সি লাইনস লিমিটেড।

তারা জানিয়েছে, করাচি থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছতে একটি জাহাজের আট দিনের বেশি সময় লাগছে। আগে করাচি থেকে ট্রানজিট বন্দর হয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছতে লাগত কমপক্ষে ১২ দিন। বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে সেগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে চীন, এরপর ভারত। যদিও পাকিস্তানের শীর্ষ ১০টি রপ্তানির দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নেই। বাণিজ্যবিষয়ক তথ্য নিয়ে কাজ করা ট্রেড ইকোনমিকসের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে ৬৯০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য পাকিস্তান থেকে দেশে আমদানি হয়েছে। এর আগের বছর ৮৩৯ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়। ২০২১ সালে এর পরিমাণ ছিল ৮১৩ মিলিয়ন ডলার। বিগত ১৭ বছরের মধ্যে পাকিস্তান থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি হয় ২০২২ সালে। গত বছর  পাকিস্তান থেকে আমদানি করা পণ্যের মধ্যেবশীর্ষে ছিল তুলা। ৪৮৪ মিলিয়ন ডলার মূল্যের তুলা সেবার দেশে আসে। এ ছাড়া আসে লবণ, সালফার,নপাথর, সিমেন্টের কাঁচামাল, তেলবীজ, ফল ও বিভিন্ন খাদ্যশস্য। পাকিস্তান থেকে আমদানি করা পণ্যের তালিকায় আরও আছে কাপড়, বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ, খনিজ ও ধাতব উপাদান, বৈদ্যুতিক সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে পাট ও পাটজাত পণ্য, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, সিনথেটিক ফাইবার, টেক্সটাইল সামগ্রী ও চিকিৎসা সামগ্রী পাকিস্তানে রপ্তানি হচ্ছে।

পাকিস্তান সরকারের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে রপ্তানি হয়েছে ছয় কোটি ৩৩ লাখ ডলারের বেশি পণ্য। আর পাকিস্তান থেকে আমদানি হয়েছে ৬৫ কোটি পাঁচ লাখ ডলারের বেশি পণ্য।

প্রিমিয়ার সিমেন্ট পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সমুদ্রপথে নিয়মিত রুট নিশ্চিত করা গেলে ব্যাবসায়িকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ভিন্ন চ্যানেলে না এনে চাল, পেঁয়াজ, ফলমূলসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য, এমনকি পোশাকের কাঁচামাল সরাসরি আনা গেলে আর্থিকভাবে লাভবান হবে বাংলাদেশ। আবার পাটসহ অনেক পণ্যের রপ্তানিও ত্বরান্বিত হবে। তিনি আরো বলেন, কোনো ধরনের  সংকীর্ণতা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সুবিধা পাওয়ার পথকেও সংকীর্ণ করে তোলে।

আরবি/জেডআর

Link copied!