১০০ দিন পার হয়েছে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন সাবেক স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দীর্ঘ দেড় দশকের আওয়ামী লীগ শাসনের অবসানের পরও থেমে নেই তাদের ষড়যন্ত্র। ছোট পর্দার অভিনেত্রী ও ছাত্রলীগের সাবেক নেত্রী ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর ও চিত্রনায়িকা নিপুণ আক্তারের সঙ্গে ‘আয়না ঘর’ সৃষ্টি এবং গুম-খুনের মূলহোতা বরখাস্তকৃত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের কানেকশন নিয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। নির্বিচারে ছাত্র-জনতা হত্যাযজ্ঞে সরাসরি জড়িত জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান পুলিশি রিমান্ডে থাকাবস্থায় দেখা করার পর ঊর্মিলাকে নিয়ে নতুন তথ্য সামনে এসেছে। থানায় গিয়ে জিয়ার সঙ্গে দেখা করে নির্দেশনা নিয়ে এসেছেন।
জিয়ার সহচর শাকিল ও রাসেলকে নির্দেশনা পাঠাতে ঊর্মিলাকে থানায় ডেকে পাঠান। আত্মগোপনে থাকা সহচরদের নির্দেশনা দিতে ঊর্মিলাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করায় খোদ গোয়েন্দা মহলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। কেঁচো খুড়তে সাপ বেড়োনোর মতো তথ্য পেয়েছেন তারা। সেখানেই কথিত নায়িকা নিপুণ আক্তারের নাম নতুন করে বেরিয়ে এসেছে। জিয়া সিন্ডিকেটে অন্যতম সদস্য ছিলেন নিপুণ। শেখ সেলিম যেমন রাজনৈতিক হাতিয়ার ছিলেন, তেমনি প্রশাসনিক শক্তি সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়া। তবে গত তিন মাসেও গ্রেপ্তার হননি কথিত শিল্পী ঊর্মিলা ও নিপুণ।
জানা গেছে, অভিনিয় শিল্পী সংঘের একাধিকবারের নেত্রী উর্মিলা জিয়াউর আহসানের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। অন্যদিকে, শেখ ফজলুল করিম সেলিমের রক্ষিতা হিসেবে পরিচিত নিপুণ আক্তার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে ভোটে পরাজিত হয়েও জোর করে চেয়ার দখল করেছিলেন। বিনোদন জগতের দুই তারকা উর্মিলা-নিপুণ পতিত আওয়ামী আমলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তাদের ক্ষমতার কাছে ভয়ে তটস্থ ছিল পুরো সংস্কৃতি অঙ্গন। তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস করতেন কোনো তারকা। শেখ সেলিমের সূত্র ধরেই জিয়াউলের সঙ্গে নিপুণের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। শেখ পরিবারের প্রভাবশালী ব্যক্তির বান্ধবী হওয়ায় জিয়াও নিপুণের সঙ্গে মিলে নানা অপকর্ম করছেন। সংস্কৃতি অঙ্গন এবং সংশ্লিষ্ট যারাই আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতা করতেন তাদের নানাভাবে নাজেহাল করতেন ঊর্মিলা ও নিপুণ সিন্ডিকেট। দপন-পীড়ন ও মামলা-নির্যাতনে এনটিএমসি’কে সহযোগিতা করতেন।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, নিউমার্কেট থানা পুলিশের সহযোগিতায় অভিনেত্রী উর্মিলা আত্মগোপনে থাকাবস্থায় জিয়াউলের সঙ্গে দেখা করেন। সবকিছু গোপনে হলেও শেষ পর্যন্ত বিষয়টি আর গোপন থাকেনি। গণমাধ্যমে সংবাদ হওয়ার পর তোলপাড় সৃষ্টি হয় পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলে। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয় থানায়। ঊর্মিলাকে গ্রেপ্তারে অভিযানও চালানো হচ্ছে। নতুন করে তদন্তে উঠে এসেছে ঊর্মিলার পাশাপাশি নিপুণের সংশ্লিষ্টতার তথ্য। এ বিষয়ে গোয়েন্দারা আরও তথ্য সংগ্রহ করছেন। আয়না ঘর সৃষ্টির মূলহোতা জিয়াউল আহসান সহচরদের গ্রেপ্তারে কাজ করছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
বিগত আওয়ামী লীগ আমলে রাজনীতিতে ফুল টাইম সরব থাকা উর্মিলা ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে আত্মগোপনে। ছাত্র-জনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে সক্রিয় ছিলেন ‘আলো আসবেই’ আলোচিত গ্রুপে। যেখানে বন্ধুকেও ছেড়ে কথা বলেননি তিনি। বর্তমানে তার মুঠোফোনও বন্ধ রয়েছে। হঠাৎ করেই আলোচনায় ঊর্মিলা। তবে নতুন কোনো নাটক বা ওয়েব সিরিজে অভিনয়ের জন্য নয়, আওয়ামী লীগের দোসর কুখ্যাত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের সঙ্গে থানা হাজতে দেখা করতে গিয়েই লাইমলাইটে এই অভিনেত্রী। এরপর থেকেই আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার নানা অপকর্ম এখন একে একে সামনে আসছে। কুখ্যাত জিয়ার সঙ্গে কেন থানায় দেখা করতে গেলেন ঊর্মিলা- সেই প্রশ্ন এখন জনমনে।
বর্তমানে নিউমার্কেট থানা হাজতে বন্দি, হাজারো অপকর্মের জন্য দায়ী মেজর জিয়ার সঙ্গে ঊর্মিলার দেখা করতে যাওয়ার বিষয়টি। যেখানে তিনি সাবেক এনটিএমসির মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান কীভাবে সরকারি দপ্তরকে নিজের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন। ২০১৬ থেকে বহু শুম-খুনের সঙ্গে জড়িত কুখ্যাত সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানের ছত্রছায়ায়ই কাজ করত এনটিএমসির একটি বিশেষ দল। সেই দলে ছিলেন জিয়ার শ্যালক রিজভান ইসলাম অনতু, জামাল উদ্দিন, আহমেদ ডালিম, জামিউল ইসলাম, মুনাইম শাহরিয়ার। জিয়াউল গ্রেপ্তার হলেও, তার সহচরদের এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
শেখ সেলিমের ডেরা থেকে সিনেমার নায়িকা নিপুণ: এমপি বা মন্ত্রী নয়, নিপুণ আক্তার পেশায় চিত্রনায়িকা হলেও শেখ ফজলুল করিম সেলিমের রক্ষিতা বা বান্ধবী পরিচয় কাজে লাগিয়ে হয়ে উঠেন ব্যাপক ক্ষমতাবান। শেখ সেলিমের রক্ষিতার ঘটনা চলচ্চিত্র জগতের সবার কাছে ওপেন সিক্রেট ছিল। এ নিয়ে সহকর্মীদের মধ্যে চলত রসালো গল্প। শেখ সেলিম ও জিয়ার নাম ব্যবহার করে সহকর্মীদের হুমকি-ধমকি দেওয়ার ঘটনা রয়েছে। রাজনৈতিক-প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় নিপুণ হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছেন আলাদা জগৎ। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন, সরকারি দপ্তর থেকে শুরু করে আইন মন্ত্রণালয়- সর্বত্রই ছিল তার দৌড়। তবে মাথার ওপর শেখ পরিবারের সদস্য সেলিমের ছাতা থাকায় কেউ টুঁ শব্দ করতে পারেননি।
স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই শেখ ফজলুর করিম সেলিম ওরফে শেখ সেলিমের গুলশান এলাকার ‘স্পা’ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন নিপুণ। প্রধানমন্ত্রীর পরেই তার প্রভাব ছিল বলে মনে করা হয়। জনসম্মুখে নিপুণ শেখ সেলিমকে আঙ্কেল বলে সম্বোধন করলেও তাদের একান্ত ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে জানত অনেকেই। শেখ সেলিমের ভালোবাসায়-আশীর্বাদে অবৈধ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন নিপুণ। সরকারি বেশ কয়েক দপ্তরে ছিল নিপুণের রাজত্ব। এর মধ্যে অন্যতম রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। রাজউক থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন নিপুণ।
নিপুণ সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য রাজউকের উচ্চমান সহকারী মাহবুব হোসেন। সিবিএ নেতা। মাহবুবের বাড়ি গোপালগঞ্জে। শেখ সেলিমের লোক হিসেবে পরিচিত তিনি। এই মাহবুুবের সঙ্গে নিপুণকে পরিচয় করিয়ে দেন শেখ সেলিম। ২০১৪ সালের পর থেকেই রাজউকে আধিপত্য বিস্তার করেন নিপুণ। ড্রয়িং এপ্রুভাল, অকুপেন্সি সার্টিফিকেট, রাজউকের নামজারিসহ এই দপ্তরে অন্যান্য কাজ করাতেন নিপুণ। লোক মারফতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠাতেন তিনি। মাহবুবের কাছে অফিসাররা ছিলেন জিম্মি। মাহবুবের কাজে টাকা চাইতেন না তারা। ‘শেখ সেলিমের লোক’ এই পরিচয়ে মাহবুব অত্যন্ত প্রভাবশালী। যে কারণে মাহবুবের কাজ হতো দ্রুতগতিতে। অনেক সময় ‘ক্লায়েন্টকে’ মাহবুবের কাছে পাঠাতেন নিপুণ।
তখন রাজউক ভবনের পাশের বিল্ডিংয়ের একটি কক্ষে নিয়ে যেতেন ক্লায়েন্টকে। সেখানে গিয়ে নিপুণের কথামতো ক্যাশ টাকা নিতেন মাহবুব। ওই কক্ষেই টাকা রাখা হতো। অফিস শেষে সেই টাকা পাঠানো হতো নিপুণের বাসায়। ড্রয়িং এপ্রুভালের ক্ষেত্রে ৮ তলা ভবনের জন্য ২০-২৫ লাখ, ১০ তলার জন্য ৫০ লাখ টাকা নিতেন নিপুণ। তবে মাঝেমধ্যে ২-৩ লাখ টাকা ভাগে পেতেন মাহবুব। শেখ সেলিম যখন যেখানে ডাকতেন তার সেবায় উপস্থিত হতেন নিপুণ। নিপুণের ‘সেবা প্রদানকারী’ টিমে রয়েছে একঝাঁক সুন্দরী। তারা কেউ মডেল, কেউ নায়িকা, কেউ শিক্ষার্থী। নিজে যেমন শেখ সেলিমের জন্য নিয়োজিত ছিলেন, তেমনি এই সুন্দরী টিমের সদস্যদের নিয়োজিত রাখতেন নিপুণ।
২০১৬ সালের জানুয়ারিতে রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউতে নিপুণ গড়ে তোলেন প্রসাধনী ও লাইফ-স্টাইলকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান ‘টিউলিপ নেইলস অ্যান্ড স্পা’। শেখ সেলিম প্রভাবশালী নেতা হিসেবে আগে কখনো পার্লার উদ্বোধন না করলেও নিপুণের এই পার্লারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। মূলত পার্লারটি তাকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন শেখ সেলিম। আগে থেকেই একাধিক পার্লার ব্যবসায় বিনিয়োগ ছিল শেখ সেলিমের। এই পার্লারকে কেন্দ্র করে বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় নিপুণ গড়ে তোলেন অনৈতিক বাণিজ্যের বৈধ হাটবাজার, প্রশাসনের নাকের ডগায় হলেও তৎকালীন পুলিশ প্রশাসন ছিল নিশ্চুপ। পার্লারে কর্মরত কোনো মেয়ে অনৈতিক কাজ করতে আপত্তি জানালে তাকে মামলার ভয় দেখাতেন নিপুণ। ডেকে আনতেন পুলিশ। রেগে গিয়ে মারধরও করতেন তিনি।
আপনার মতামত লিখুন :