ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দুশ্চিন্তার ভাঁজ এখন বিএনপি নেতাদের কপালে। কবে হবে কাক্সিক্ষত সেই জাতীয় নির্বাচন। ২০২৫ সালেই নির্বাচন নাকি আরও সময় নেবে অন্তর্বর্তী সরকার এমন নানামুখী প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তাদের মনে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, নির্বাচনি ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। আগামী বছরের মধ্যে অবশ্যই নির্বাচন ও নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর চায় তারা। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেছেন, দ্রুতই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে। কাজ শুরু করেছে নির্বাচন সংস্কার কমিশন। এরই মধ্যে কয়েক দফা বৈঠকও করেছে তারা। তবে গত সোমবার তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, এটি বিল্পবী সরকার, শুরুতেই নির্বাচন দেওয়া তাদের কাজ নয়। এতে দুশ্চিন্তা বাড়ছে বিএনপিসহ রাজনৈতিকদের। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অবিলম্বে রোডম্যাপ চায় বিএনপি।
বিএনপির একটি সূত্র জানায়, নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা না করায় দলের শীর্ষনেতারা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির কথা ভাবছেন। দলটির সব তৎপরতাই এখন নির্বাচন ঘিরে। তবে গত রোববার সরকারের ১০০ দিন উপলক্ষে এই ভাষণে নির্বাচনের রূপরেখা না দেওয়ায় আশাহত হয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি সোমবার মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকীর আলোচনায় এই আশাহত হওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, ‘আমি আশা করেছিলাম, প্রধান উপদেষ্টা তাঁর সব প্রজ্ঞা দিয়ে সমস্যাটা চিহ্নিত করে নির্বাচনের জন্য একটা রূপরেখা দেবেন। নির্বাচন দিলে দেশের অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে মনে করেন মির্জা ফখরুল।’
এদিকে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা না হলে নতুন বছরে বিভাগীয় সমাবেশ করে চাপ সৃষ্টির পরিকল্পনা করছে বিএনপি। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মোহাম্মদ রহমতুল্লাহ বলেন, রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচনি প্রক্রিয়া দুটোই একই সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া উচিত। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে অবিলম্বে নির্বাচনের রোডম্যাপ উপস্থাপন করতে হবে। যতদিন এই রোডম্যাপ দেওয়া না হবে, ততদিন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন পেছানোর আশঙ্কা থেকেই যাবে। তিন মাস একেবারে কম সময় না। এই সময়ের মধ্যে চাইলে নির্বাচনের পথে অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারত সরকার।
বিএনপির একটি সূত্র জানায়, সরকার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চাইলে সে ক্ষেত্রে বিএনপি বর্তমান সরকারের প্রতি তাদের নিঃশর্ত সমর্থন প্রত্যাহার করতে পারে। যদিও এরই মধ্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিএনপি এই সরকারের কোনো কাজে বাধা সৃষ্টি করছে না। সরকারকে সহযোগিতা করছে বিএনপি। তারা চায়, সরকারও সহযোগিতা করবে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সরকারের উচিত জাতীয় নির্বাচনের উদ্যোগ বা প্রক্রিয়া দৃশ্যমান করা। আমরা চাই, আর বিলম্ব না করে যত দ্রুত সম্ভব একটা নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করুন। সেটি খুব জরুরি এই মুহূর্তে।’
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, দেশের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তেমনি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কেন্দ্র থেকে। আগামী জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে বিভাগীয় সমাবেশ করে তৃণমূল চাঙ্গা করবে বিএনপি। জেলা পর্যায়ের সভা-সমাবেশ করতে চায় দলটি। এরই মধ্যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চ্যুয়ালি বিভিন্ন জেলায় সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন। তার দিকনির্দেশনায় উৎফুল্ল হচ্ছে তৃণমূল। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে বিভাগীর সমাবেশ শেষে আগামী মার্চ মাস থেকে তারা শক্ত অবস্থানে যেতে চান। তারা বলছেন, সব বিতর্কের অবসান ঘটাতে দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত। তা ছাড়া বর্তমান সরকারের অবস্থান ঘিরে বিএনপির মধ্যে নানা ধরনের আশঙ্কাও কাজ করছে। চিকিৎসার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার সব প্রস্তুতি থাকলেও আপাতত তিনি দেশের বাইরে যাচ্ছেন না। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন তা-ও নিশ্চিত নয়। কারণ তাঁর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দায়ের করা প্রায় সব মামলাই রয়ে গেছে।
বিভাগীয় সমাবেশের পরিকল্পনা বিএনপির: দেশকে অস্থিতিশীল করার যেকোনো ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে শক্তি প্রদর্শন এবং যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন আয়োজনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ উপস্থাপনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে বিভাগীয় সমাবেশ করার পরিকল্পনা করছে বিএনপি।
সিনিয়র নেতারা বলছেন, এই সমাবেশের মাধ্যমে রাষ্ট্র সংস্কারের এজেন্ডার আড়ালে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা না করতে এবং বিএনপির রাজনৈতিক শক্তিকে যাতে খাটো করে না দেখা হয়, সে বিষয়ে তারা একটি বার্তা দেবেন। এ ছাড়াও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে আরও একটি বড় জনসমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। পাশাপাশি সংস্কারের অজুহাতে অন্তর্বর্তী সরকারের বেশি সময় নষ্ট করা উচিত হবে না মর্মে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে ৩১ দফা প্রস্তাব নতুন করে সাজানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
বিএনপির মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জনগণের শাসন শিগগিরই জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। এটা সম্ভব হবে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা করতে হবে। সব মিলিয়ে দ্রুত নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা প্রায় সবাই মিলে আন্দোলন করছি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য।
জাতীয়তাবাদী ৪২টি দল একসাথে আন্দোলন করেছি স্বৈরাচারকে বিদায় করার জন্য। এখন এই সংখ্যা আরও বেড়েছে, ৫০টির বেশি দল হয়েছে। সবাই গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য জনগণের সামনে এগুলো (সংস্কার) আমাদের ম্যান্ডেট। এখন সংস্কার হোক আর না হোক আমরা তো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ জাতির কাছে, আমরা সংস্কার করব।
আমরা সবাই মিলে প্রতিজ্ঞা করছি জাতির কাছে, আমরা সেই সংস্কার করব। নির্বাচনের আগে জরুরি যেসব সংস্কার করা দরকার কিংবা যেসব সংস্কার করার ক্ষমতা আছে, সেগুলো করাতে এত বেশি সময় লাগার কোনো কারণ নেই। বাকিগুলো আমরা নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে করতে পারব। সুতরাং নির্বাচনের রোডম্যাপের সঙ্গে সংস্কারের সম্পর্ক খুব বেশি সাংঘর্ষিক না। সবারই লক্ষ্য এখন নির্বাচনি প্রক্রিয়া কী হবে। সবাই চায় একটা স্বচ্ছ গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ নির্বাচন। সেই লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। এখানে দ্বিমতের কিছু নেই। প্রত্যেক দলের অধিকার আছে তাদের নিজস্ব সংস্কার প্রস্তাব পেশ করা। এখন ম্যান্ডেট নিয়ে সংসদে সিদ্ধান্ত হবে এটাই তো গণতন্ত্র। আমরা তো এই গণতন্ত্রের কথাই বুঝি তাই না, এর বাইরে তো আর গণতন্ত্র হতে পারে না, আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত তার কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে।
সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ ও গতিপ্রকৃতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন দলটির শীর্ষ নেতারা। সেখানেই নির্বাচনের রোডম্যাপের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির কথা বলা হয়। তারা ডিসেম্বরের মধ্যেই রোডম্যাপ চান। তা না হলে তারা সরকারের ওপর চাপ আরও বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেন। তারা বলেন, ১০০ দিন বিবেচনায় সরকার কচ্ছপের গতিতেও এগোচ্ছে না। কমিশন হয়েছে ভালো কথা। কিন্তু রোডম্যাপ তো থাকতে হবে।
সরকারের মেয়াদ কোনো অনির্ধারিত সময় তো হতে পারে না। তাদের বুঝতে হবে, এটা একটি ট্রানজিশনাল সরকার। তাদের মূল কাজ হলো, একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এটাই তাদের মূল কাজ।
সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ ও গতিপ্রকৃতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন দলটির শীর্ষ নেতারা। সেখানেই নির্বাচনের রোডম্যাপের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির কথা বলা হয়। তারা ডিসেম্বরের মধ্যেই রোডম্যাপ চান। তা না হলে তারা সরকারের ওপর চাপ আরও বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেন। তাদের মূল কাজ হলো, একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এটাই তাদের মূল কাজ।
আপনার মতামত লিখুন :