তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা সম্ভব কি না সে বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করতে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আপাতত রাজপথে থাকছেন না শিক্ষার্থীরা। সচিবালয়ে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও শিক্ষা উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর সঙ্গে বৈঠক শেষে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদল এ কথা জানায়। এর আগে সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরে কমিশন গঠনের দাবি আজকের (বুধবারের) মধ্যে মেনে না নিলে আগামীকাল থেকে রাজধানীর মহাখালীতে ফের সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। যে অবরোধের নাম দিয়েছেন তারা ‘বারাসাত ব্যারিকেড টু মহাখালী’। গত সোমবার রেললাইন অবরোধ করে আন্দোলন চলাকালে দুটি আন্তঃনগর ট্রেন থামিয়ে হামলা চালান। এ সময় ইটের আঘাতে দুই ট্রেনের ভেতরে থাকা শিশুসহ বেশ কয়েকজন যাত্রী আহত হয়, যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা।
তিতুমীর কলেজ আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মতিউর রহমান জয় জানান, আজকে আমাদের দাবিগুলো নিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টাসহ সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা বসবেন বলে জেনেছি। সেখানে আমাদের প্রতিনিধিদলও থাকবে। এ বৈঠক থেকে দাবি মেনে নেওয়ার সুনির্দিষ্ট আশ্বাস না পেলে বুধবার বেলা ১১টা থেকে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করা হবে।
ব্রিফিং শেষে শিক্ষার্থীরা ফের অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় তারা জানান ‘তিতুমীরের বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘টিসি না টিইউ’, টিইউ টিইউ’, ‘ডিমান্ড টু গুলশান’, ‘তিতুমীর ভার্সিটি’, ‘ডিমান্ড টু বনানী, তিতুমীর ভার্সিটি, ‘অধ্যক্ষ না ভিসি, ভিসি ভিসি’, ‘আমাদের ক্যাম্পাসে, আমরাই থাকব’, ‘ক্যাম্পাসে পুলিশ কেন, প্রশাসন জবাব চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দেন তারা।
এর আগে গত সোমবার সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে শিক্ষার্থীরা মহাখালী রেললাইনের ওপর অবস্থান নেন। এতে রেল ও সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তাদের এ কর্মসূচিতে বন্ধ হয়ে যায় সারা দেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ। রাজধানীজুড়ে দেখা দেয় তীব্র যানজট। পরে আশ্বাস পেয়ে কর্মসূচি স্থগিত করেন তারা।
অনির্দিষ্টকালের জন্য তিতুমীর কলেজের সব ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ এদিকে তিতুমীরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরে কমিটি গঠন করে শেষ পর্যন্ত তা প্রকাশ না করায় আন্দোলন চলমান রাখার ঘোষণা দিয়ে গতকাল মঙ্গলবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রাখার ঘোষণাও দিয়েছেন তারা। এর আগে সোমবার রাতে সচিবালয়ে সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনার পর বেরিয়ে এসে আন্দোলনের সমন্বয়করা সাংবাদিকদের জানান, তাদের কর্মসূচি চলমান রাখা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিতুমীর কলেজ সমন্বয়ক আমিনুল ইসলাম বলেন, দাবি না মানলে আমাদের কর্মসূচি চলবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনার পর তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরে একটি কমিটি গঠন করতে প্রেস রিলিজ তৈরি করা হয়। কিন্তু একই সময়ে কোনো একজন ব্যক্তির ফোনে ওই প্রেস রিলিজ জারি করা হয়নি। আমরা তাদের জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা কোনো চক্রান্ত করছেন? ১২ হাজার শিক্ষার্থীর পক্ষ থেকে আমরা ১৪ জন সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। আপনারা কী চান আমরা আসামি হয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে যাই? আপনারা যে কাজটি করেছেন তাতে আমরা আসামির মতো হয়েছি। আমরা কেন আলোচনা করতে এলাম, এর জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
তিনি বলেন, কাজেই আমরা তাদের বলেছি আপনারা (সরকার) আমাদের সঙ্গে যে কাজটি করেছেন তা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। আমরা আপনাদের কাছ থেকে এটা আশা করিনি। সংশ্লিষ্টদের আচরণে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়েছে। কাজেই আমাদের আন্দোলন ছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছে যাওয়ার আর কোনো রাস্তা নেই। আমরা একটি যৌক্তিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব।
কর্মসূচি ঘোষণা করে তিনি বলেন, অনির্দিষ্টকালের জন্য তিতুমীর কলেজের সব পরীক্ষার ক্লাস বন্ধ থাকবে। আমাদের চলমান কর্মসূচি বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বারাসাত টু মহাখালী কর্মসূচি চলমান থাকবে।
তিতুমীর কলেজে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবি পূরণের আন্দোলনের সময় সরকারি তিতুমীর কলেজের সামনে বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য অবস্থান নিয়েছেন। একইসঙ্গে রাওয়া ক্লাবের সামনে থেকে মহাখালী রেলগেট পর্যন্ত সড়কে সেনাবাহিনীর শতাধিক সদস্য মাঠে ছিল।
পুলিশ জানায়, সার্বিক পরিস্থিতির নিরাপত্তায় পুলিশ সদস্যরা কলেজের মূল ফটকের ভেতরে ও বাইরে অবস্থান নেন। তবে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েনের ব্যাপারে উপস্থিত কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি। তবে এ বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা বলেন, এভাবে পুলিশ দিয়ে এই সরকার আন্দোলন বন্ধ করতে পারবে না।
জামান ও মোস্তফা রেমান নামের শিক্ষার্থী বলেন, আপনারা এই আন্দোলন বন্ধ করতে পারবেন না। আমাদের দাবি মানতে হবে মানতে হবে। তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় দিতে হবে দিতে হবে।
নুরুদ্দিন নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, এটা কি তিতুমীর কলেজ, নাকি যুদ্ধের ময়দান? শত শত পুলিশ মহড়া দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কি বার্তা দিতে চাচ্ছে? ট্রেনে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ অন্যদিকে রাজধানীর মহাখালীতে সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলাকালে ট্রেনে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় বিক্ষোভ কর্মসূচি করেছেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকেলে ঢাকা কলেজের মূল ফটকের সামনে মানববন্ধন করেন তারা। পরে তারা মিরপুর সড়কে বিক্ষোভ মিছিল করেন। বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে মহাখালীতে ট্রেনে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করা হয়।
তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে উল্লেখ করেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আবদুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘শিক্ষা উপদেষ্টার আশ্বাসে আমরা আমাদের আন্দোলন সাময়িক স্থগিত করেছি। সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের আন্দোলনে শান্তিপূর্ণভাবে সবাই মাঠে ছিলাম। আমাদের কোনো কর্মসূচিতে উগ্রতা ছিল না।’
২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। কলেজগুলো হচ্ছে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।
পুঞ্জীভূত সমস্যার কারণে সম্প্রতি সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের জন্য স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের আশ্বাসে সন্তুষ্ট হয়ে ৬ নভেম্বর চলমান আন্দোলন-কর্মসূচি সাময়িক স্থগিত রাখার ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। তবে এরপর তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা শুধু তাদের কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন।
এর আগে গত সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা কলেজ ক্যাম্পাস থেকে মিছিল নিয়ে এসে মহাখালী রেলক্রসিং এলাকায় সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন। বিকেল ৪টা পর্যন্ত এই অবরোধ চলে। কিছু সময়ের জন্য উঠে গিয়ে তারা ফের কলেজের সামনের সড়কে বসে পড়ে। সেখান থেকে কলেজ ক্লোজডাউন ঘোষণা করে মঙ্গলবারও অবরোধ কর্মসূচি দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, তিতুমীর কলেজ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে তিন দফা দাবি জানিয়েছেন। দাবিগুলো হলো
১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি বাতিল করে ৭ কলেজ থেকে তিতুমীর কলেজকে পৃথক (আলাদা) করতে হবে।
২. তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের লক্ষ্যে কমিশন গঠন করতে হবে।
৩. তিতুমীরকে একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়নের রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :