আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন কক্সবাজার শহরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা শীর্ষ সন্ত্রাসী আবুল মনছুর লুদুইয়া ওরফে লুদু। ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেই তার গুন্ডাপান্ডা দিয়ে শহরের বিভিন্ন জায়গায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করছেন তিনি।
সূত্র জানায়, লুদু পুলিশের তালিকায় ২০ মামলার আসামি ও শীর্ষ সন্ত্রাসী। সরকারপতনের আন্দোলনের সময় বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছেন। তার নামে একাধিক মামলা হলেও লুদু কেন এখনো গ্রেপ্তার হননি, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি কক্সবাজার শহরে লুদুর সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিষয়ে রূপালী বাংলাদেশ অনুসন্ধানে নামে। এই অনুসন্ধানে লুদুর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বেশ কিছু তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কক্সবাজার শহরে রাজত্ব করতে অন্ধকারে থেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন লুদু। কক্সবাজার সদরের উত্তর রুমালিয়ার ছড়া হাশেমিয়া মাদ্রাসা গেট এলাকার আব্দুস ছবুর সওদাগরের ছেলে আবুল মনছুর লুদু। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগ নামধারী এই সন্ত্রাসী শহরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে বিভিন্ন সময়ে মিছিলসহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। সূত্র জানায়, লুদু পুলিশের সহযোগিতায় মাঝে মাঝে কক্সবাজার শহরে ঘুরে বেড়ান। যদিও পুলিশ বলছে, এসব অভিযোগ মিথ্যা।
পাহাড়ের মাটি বিক্রি, খাসজমি দখল ও চাঁদাবাজি : এলাকাবাসীর অভিযোগ, স্থানীয় সন্ত্রাসী ইকবাল হোসেন ছোটন, মুবিনুল হক মুবিন, ফারুক, জিয়াবুল, জসিমসহ ১৫ থেকে ২০ জনের একটি সন্ত্রাসী ক্যাডার বাহিনী গড়ে তুলে পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি, নিরীহ মানুষের জমি দখল, সরকারি খাসজমি দখল ও চাঁদাবাজি করে আসছিলেন লুদু। ভুক্তভোগীরা জানান, কেউ বাড়ি নির্মাণ করতে গেলে চাঁদা দিতে হয় এই বাহিনীকে। চাঁদা না দিলে চালানো হয় হামলা ও নির্যাতন। এভাবেই প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের আসকারায় বাড়তে থাকে তার অপরাধ কর্মকাণ্ড।
জানা যায়, সর্বশেষ চলতি বছর গত ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পরও তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেমে নেই। গত ১১ আগস্ট সকালে প্রকাশ্য দিবালোকে সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে স্থানীয় নুর মোহাম্মদ নামে নিরীহ এক ব্যক্তির বসতভিটায় প্রবেশ করে হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর ও মাথায় কুপিয়ে গুরুতর আহত করেন। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। এ ঘটনায় আহত নুর মোহাম্মদ বাদী হয়ে লুদুকে আসামি করে গত ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার সদর মডেল থানায় মামলা দায়ে করেন। মামলা নম্বর ৭৭, জিআর ৬৩৩।
যাকে-তাকে গুলি করতেন লুদু: কক্সবাজার পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নতুন জেলগেট এলাকার মনির আহমদের ছেলে নুর মোহাম্মদের (২০) পরিবারের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা করা হয়। অন্য আসামিরা হলেনÑ মো. সোহেল (২২), মো. সাইফুল ইসলাম (২৬), মো. নূরুল আমিন (২৪), নুরুল ইসলামসহ (৫৫) আরও অজ্ঞাতানামা তিন-চারজন। মামলার বাদী নুর মোহাম্মদ রূপালী বাংলাদেশকে জানান, লুদুর বিরুদ্ধে থানায় মামলা করার পর আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে আসছে।
পুলিশি সূত্র ও তথ্যমতে, লুদু ২০০১ সালের মে মাসে কক্সবাজার সিটি কলেজের সামনে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে কলেজছাত্র আলমগীরকে গুলি করে গুরুতর আহত করেন। এ ঘটনায় তার চাচা বিডিআর সদস্য আমীরুল আলম ভাতিজাকে বাঁচাতে গেলে তাকেও গুলি করে আহত করা হয়। এ ঘটনায় কক্সবাজার সদর থানায় মামলা হয়েছে।
২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল শহরের আলীর জাহাল এলাকার রফিক উদ্দিনের স্ত্রী রেজিয়া বেগমের ওয়ারিশি ভোগদখলীয় জমি দখলের জন্য হামলা চালিয়ে মারধর ও লুটপাটের ঘটনায় লুদু ও তার সহযোগীদের নামে কক্সবাজার সদর থানায় মামলা হয়, যার নম্বর ১০, তারিখ ৯/৩/২০০১। গত ২০০১ সালের ৯ মার্চ চাঁদা দাবি ও লুটপাটের ঘটনায় সন্ত্রাসী লুদু ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর থানার একটি মামলা হয়।
লুদুর সঙ্গে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সখ্য: সূত্র জানায়, লুদুর সঙ্গে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের রয়েছে গভীর সখ্য। রোহিঙ্গা অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও তার সখ্য আছে বলে জনশ্রুতি আছে। রোহিঙ্গা ডাকাতদের শেল্টার দিয়ে কক্সবাজারে যানবাহনে ডাকাতি করে ডাকাতির ভাগ নিতেন তিনি। ২০১৫ সালে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে লুদুসহ তার বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্রসহ আটক হন। এ ঘটনায় ২০১৫ সালের ১২ অক্টোবর কক্সবাজার সদর থানায় অস্ত্র আইন ও ডাকাতির প্রস্তুতির ঘটনায় দুটি মামলা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান সরকারের আমলেও পর্দার অন্তরালে থেকে লুদু সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে চাঁদাবাজি, জমি দখলের ঘটনা করে যাচ্ছেন।
সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে কক্সবাজার সদরের শীর্ষ সন্ত্রাসী সাদ্দাম এখন লুদু বাহিনীর একনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। অস্ত্র, ডাকাতি, ছিনতাইসহ ১০টি মামলা আছে এই সাদ্দামের বিরুদ্ধে। আরেক সন্ত্রাসী আলাউদ্দিন আবুল মনছুর লুদুর বডিগার্ড। এখন চাঁদাবাজি, ভূমি দখল, ছিনতাই, ইয়াবা ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ করে যাচ্ছে গডফাদার লুদুর বাহিনী।
লুদুর বিরুদ্ধে যেসব মামলা: আবুল মনছুর লুদুর বিরুদ্ধে মামলাগুলো হলোÑ জিআর-৮০/২০০১, জিআর-১৭৮/২০০১, জিআর-৪/২০০১, জিআর-১০৯/৯৬, এসটি-১৮/৯৮, জিআর-২৪০/৯৬, জিআর-২৭৮/২০০১, জিআর-১৮৩/৯৮, জিআর-৩১/২০০২, জিআর-৯৪/২০১৫, জিআর-১৯/২০১৫, জিআর-২০/২০১৫, জিআর-১৯/২০১৫, জননিরাপত্তা বিঘ্নিত অপরাধ মামলা নং-১/ ২০০১, এসপি-৩৮৯/২০০৭, সদর মডেল থানার জিডি নং-৩০১, তাং-৭/১/২০০১, জিডি নং-১৬৯, তাং- ৪/১১/২০১১, জিডি নং-১০৫৫, তাং-২২/৯/২০১১, জিডি নং- ১৬২৪, তাং-২৯/৫/২০১১, জিডি নং-৭৫০, তাং-১৬/৬/২০০২, পটিয়া থানার জিডি নং-১২৬৬, তাং-২৫/৮/২০২০সহ আরও অসংখ্য মামলা ও জিডি।
দুদকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ: একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার সদরের হোটেল-মোটেল জোনে ৫ কোটি টাকারও অধিক সুদের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছেন। লুদুর রয়েছে অসংখ্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। এর মধ্যে কক্সবাজার সদরের ট্রাস্ট ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ডাচ্্-বাংলা ব্যাংকসহ আরও একাধিক ব্যাংকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা জমা রয়েছে তার। তার শ্বশুর ও স্ত্রীর ব্যাংক একাউন্টেও রয়েছে ৫০ কোটি টাকা এবং তার ভায়রা বিয়াদের নামে রেখেছেন প্রায় ৫০ কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিট। গত ১৫ থেকে ১৬ বছরে কোটি কোটি টাকার জমিও কিনেছেন তিনি। এর মধ্যেই মেরিন ড্রাইভ রোডে তার ১০ বিঘা জমি, সদরের ঈদগাঁও পোকখালী এলাকায় কয়েক কোটি টাকার লবণের মাঠ কিনেছেন। এই অবৈধ টাকার সূত্র ধরে কক্সবাজার দুদক অফিস লুদুকে আটক করে। পরে আওয়ামী লীগের এক নেতার হস্তক্ষেপে পার পেয়ে যান। তার কাছ থেকে সুদ নিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে অনেক মানুষ। এফাজুল্লাহ নামে এক ব্যক্তি এই লুদুর কাছ থেকে কড়া সুদে টাকা নিয়ে সবকিছু হারিয়ে পথে বসেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সদর থানার তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী লুদু: তার বিরুদ্ধে ২০টির অধিক মামলা রয়েছে এবং কক্সবাজার সদর মডেল থানার তালিকাভুক্ত একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণকারী লুদু বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলেও প্রকাশ্য অপরাধ ও সন্ত্রাসী বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়ার পরেও গ্রেপ্তার না করায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি জনগণের বিশ্বাস নষ্ট হচ্ছে দিনে দিনেÑ এমনটাই অভিযোগ স্থানীয়দের।
স্থানীয়রা জানান, সন্ত্রাসী লুদু কক্সবাজার পৌর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, যুবলীগের নেতা এবং ৫ আগস্টের আগে সরকারের পক্ষে ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে সব সময় মিছিল করেছেন। হামলায় সরাসরি অংশ নিয়েছেন। এসবের ভিডিও চিত্র বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। তারা বলছেন, গত প্রায় ২০ বছর যাবৎ চাঁদাবাজি, জমি দখল, ইয়াবা ব্যবসা, ডাকাতিসহ সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত থেকে ২০টিরও অধিক মামলার আসামি হয়েও বহাল তবিয়তে আছেন লুদুইয়া।
জানা যায়, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর সাবেক ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা লুদু কয়েক দিনের জন্য গা ঢাকা দিলেও এখন প্রকাশ্যে জমি দখল, হামলা করে মানুষকে মারধর করে গুরুতর আহত করছেন ও সদর মডেল থানায় মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইলিয়াছ খান বলেন, লুদুর ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে আবুল মনছুর লুদুইয়া ওরফে লুদু রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমার নামে সব চক্রান্ত করে মামলা দিয়েছিল। আর দুদক যে কারণে আমাকে ডেকেছিল, সেখানে গিয়ে মিটমাট করে ফেলেছিলাম। এখন যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে, তা বানোয়াট ও অসত্য।’
আপনার মতামত লিখুন :