পরিবহন খাতের মাফিয়া হিসেবে তার পরিচিতি দেশজুড়ে। গত দেড় দশকে চাঁদাবাজির মাধমে ১১ হাজার কোটি টাকা লুট করেছেন সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব, ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও বিতর্কিত এনা পরিবহনের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ঘনিষ্ট সহচর এই পরিবহন ডন দেশে-বিদেশে স্থাবর-অস্থাবর বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক। বিদেশে টাকার পাচারের মাধ্যমে বাড়ি-গাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের গড়ে তুলেছেন। গত ৫ আগষ্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগে স্বপরিবারে বিদেশে পালিয়ে যান খন্দকার এনায়েত। বর্তমানে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির টাকায় বিদেশেই বিলাসী জীবন যাপন করছেন। এনায়েত ও তার পাচারকৃত অবৈধ সম্পদ ফেরাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছেনা। অন্যদিকে, এনা পরিবহনের শতশত গাড়িগুলো ভিন্ন নামে চলাচল করছে বলে পরিবহন খাত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। এনায়েত বিদেশে পালিয়ে গেলেও এখনো সেখান থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে কলকাঠি নাড়ছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) দীর্ঘ দেড় দশক ধরে পরিবহন খাতে আওয়ামী লীগ সরকারের মদদে চাঁদাবাজি করে হাজার হাজার কোটি টাকার লোপাটের অভিযোগ এবং তার সিংহভাগ অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করেছে। ২০১৯ সালে এনায়েতের বিরুদ্বে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজিসহ হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ওঠে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়ে চার বছর আগে অনুসন্ধানে নামে দুদক। সেসময় তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে ম্যানেজ করে দুদকের তদন্ত ধামাচাপা দিয়ে দেয়। অন্তর্বতী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এনায়েতের বিরুদ্ধে আবারও অনুসন্ধান শুরু করেছে। তবে তা চলছে ঢিমেতালে। জুলাই-আগষ্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের মদদ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এনায়েতের অনুসারী আন্দোলনে অস্ত্রহাতে দমন-পীড়ন চালান। বিদেশে বসে তাদেরকে অর্থ সহায়তা দেন শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে। তবে এখন পর্যন্ত এনায়েত এবং অনুসারী অস্ত্রধারীদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গড়িমসি করছে। টার্মিনালগুলো এনায়েতের অস্ত্রধারী অনুসারী প্রকাশ্য চাঁদাবাজি করে যাচ্ছে ভোল পাল্টে।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে রাস্তায় পরিবহন সচল রাখার ঘোষণা দিয়ে আলোচনায় থাকতেন এনায়েত উল্লাহ। গত ১৫ বছর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো থেকে হরতাল-অবরোধ ডাকা হলে সেসব দিনে বাস চলবে বলে ঘোষণা দিতেন তিনি। তবে গাড়ি চলাচলের ঘোষণা দিয়েও হরতাল-অবরোধের ওইসব দিনগুলোতে নিজের পরিবহনের কোনো বাস রাস্তায় নামাতেন না। এমন অভিযোগ আছে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ইস্যুতে এনায়েত উল্লাহর অফিসে বসে সাবেক ডিএমপি কমিশনার ও ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা ঢাকায় বাস পোড়ানোর রফাদফা করতেন।
হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দেশ ছেড়ে বিদেশে বিলাসী জীবন যাপন করা পরিবহন মাফিয়া খন্দকার এনায়েত উল্লাকে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ও দেশের ভিতরে গড়ে তোলা অবৈধ সম্পদ আইনি প্রক্রিয়ায় বাজেয়াপ্ত করার দাবি পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্টদের। দুদক ও বিএফআইইউ সূত্র জানিয়ে এনায়েত ও পরিবারের সদস্য এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলমান। দ্রুত সময়ের তদন্ত শেষ করে অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। সর্বশেষ, গত ৫ আগষ্টের সরকার পতনের আগ মুহুর্তে এনায়েত দেশ ছেড়ে চলে যান সিঙ্গাপুরে, পরবর্তীতে অষ্ট্রেলিয়ায়। বর্তমানে সিঙ্গাপুর ও অষ্ট্রেলিয়া যাতায়াত করছেন। এনায়েত বিদেশী কোনো একটি পাসপোর্ট ব্যবহার করেন গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে।
পরিরবহন খাতের পুরো চাঁদাবাজিতে এনায়েত উল্লাহ ‘ক্যাশিয়ারের’ ভূমিকায় থাকলেও তাঁর হাত ধরেই ভাগ পেয়েছেন মন্ত্রী, আমলা, পুলিশ, মালিক-শ্রমিক নেতারাও। ১৬ বছর ধরে রাজধানীসহ সারা দেশেই পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির এ নৈরাজ্যের নেতৃত্ব দিয়েছেন এনায়েত উল্লাহ। পরিবহন মালিক সমিতি ও সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের নথিপত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। পদাধিকার বলে চাঁদার ভাগ পেত সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী, শ্রমিক ও মালিক নেতা, পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এবং সরকারি অন্যান্য দপ্তরের কর্মকর্তাদের চক্র। এ ছাড়া দেশের প্রতিটি জেলা মালিক সমিতির পক্ষ থেকে বাস, মিনিবাস, ট্রাক, ট্যাংকলড়ি, অটোটেম্পো হিউম্যান হলার (লেগুনা), সিএনজিচালিত অটোরিকশার চলাচলের জন্য প্রতি মাসে এনায়েত উল্লাহকে এক লাখ টাকা করে দেওয়া হতো।
বিপুল বিত্ত বৈভবের বদৌলতে তিনি বরাবরই থেকে গেছেন ধরাছোয়ার বাইরে। এমনকি ঢাকা মহানগর আওয়ামীলীগের (দক্ষিণ) সহ-সভাপতির পদ বাগিয়ে নেন অর্থের বিনিময়ে। আর সরকার পতন পর্যন্ত তিনি পরিবহন সেক্টরে একক রাজত্ব সৃষ্টি করেছেন। সিন্ডিকেট গড়ে তুলে নানা অজুহাতে বাস মালিকদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করে গড়েছেন টাকার পাহাড়। সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী দিয়ে তিনি পরিবহন সেক্টরকে জিম্মি করে রাখতেন। সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদ ছিল তার দখলে। এ সেক্টরে মাফিয়া বনে চাঁদাবাজি করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক এনায়েতের বিরুদ্বে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একাধিকবার লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু তিনি সেটা আমলে নেননি। বরং সব সেক্টরকে ম্যানেজ করে দিব্যি প্রকাশ্য চাঁদাবাজি করতেন। সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান খান, মসিউর রহমান রাঙ্গা ও খন্দকার এনায়েত সিন্ডিকেটের জন্য সড়কের শৃঙ্খলার কোন সিদ্বান্তই কার্যকর করা যেত না। সব তারা বাতিল করে দিতেন। সড়কে নানা অপ্রীতিকর ঘটনার পর ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছিল। নৈরাজ্য রুখতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ, কমিটি, সভা-মিটিং করা হয়েছিল। কিন্তু এনায়েত সিন্ডিকেটের কারণে সরকারের কোনো পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এতে করে সড়কে বাসচালকরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। যার ধারাবাহিকতা এখনো আছে। প্রতিদিনই সড়কে বেপরোয়া যানবাহন চালানোর জন্য একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। তার সঙ্গে ছিল বড় ধরনের একটি চক্র।
সে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রভাবশালী নেতাদের চাঁদাবাজির ভাগ দিয়ে বশ করে নিতেন। এছাড়া সরকারে সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রী, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মাসে মাসে টাকা দিতেন। এসব কারণে প্রকাশ্য চাঁদাবাজির মতো ঘটনার পরও কেউ প্রতিবাদ বা মুখ খোলার সাহস পায়নি।
ঢাকা সড়ক পরিবহণ সূত্র জানিয়েছে- গত ৫ আগষ্ট সরকার পতনের আগ মুুহুর্তে এনায়েত সপরিবারে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার পরও তার বাসের একক ব্যবসা এখনো রমরমা। প্রতিদিন মহাখালি টার্মিনাল থেকে তার এসব বিলাসবহুল বাস ময়মনসিংহ, সিলেট ও কক্সবাজারে চলছে। এসব গাড়ি আগে চলতো তার নিজস্ব কোম্পানী এনার নামে।
ফরিদপুরের গোল্ডেন লাইন ১৫৭ এসি বাস ও হানিফ পরিবহনের মালিক মার্সিডিজ ব্র্যান্ডের বিলাসবহুল ১৪টি বাস কিনে নেয়। বাকিগুলো বিএনপির অপর এক নেতার সহায়তায় মহাখালি টার্মিনাল থেকে চলছে। বেশকিছু বাস ইউনাইটেড নাম দিয়ে রাস্তায় বিভিন্ন রুটে চলাচল করছে। এনায়েতের দুই ক্যাশিয়ার আতিক ও আজিজ দৈনিক মহাখালি থেকে আয়ের ২২ থেকে ২৪ লাখ টাকা কালেকশন করছে। এবং সেই টাকা ডলারে কনভার্ট করে হুন্ডির মাধ্যমে এনায়েতের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে।
বর্তমানে এনায়েতের ব্যবসার হাল ধরেছে সাইদ, রফিক,কাজল, আতিক, সামদানি, খোকন, সোহরাব, তপন, মহারাজ, মাহাবুব, সেলিম ও আজিজ। এদের মধ্যে তার ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত আতিক, আজিজ, সামদানি ও খোকন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন টার্মিনালে তারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এনার ব্যবসা পরিচালনা করছে। রাজধানীতে রয়েছে ৪ হাজার বাস। প্রতিটি গাড়ি থেকে দৈনিক কমপক্ষে ৭০০ টাকার উপরে কোন কোন ক্ষেত্রে ১৮শ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হতো। গড়ে প্রতিটি গাড়ি থেকে ১ হাজার হিসেবে দৈনিক তোলা হত ৪ কোটি টাকা। মাসিক ১২০ কোটি টাকা। বছরে ১৪৭৮ কোটি টাকা। এ হিসেবে গত পনের বছরে উত্তোলিত চাদার পরিমাণ হয় ২২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। ঢাকার প্রতিটি বাস টার্মিনালই এনায়েত সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এ ছাড়া সারা দেশের বাস-মিনি বাস, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির কাছ থেকেও চাঁদাবাজি করতেন। বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাস মালিকদের কাছ থেকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করেছেন। দৈনিক চাঁদার পাশাপাশি মাসিক চাঁদাও নিতেন। এ ছাড়া নতুন বাস কোনো রুটে দিতে হলে তাকে ২ লাখ টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়। আবার কোনো কোম্পানি নতুন বাস কিনলে সেখান থেকে একটি ভাগ এনায়েতের ব্যাংক হিসাবে দেয় ওই কোম্পানি। না দিলে ওই কোম্পানির বাস সড়কে নামতে দেয়া হয় না। তাই ওই কোম্পানি বাস বিক্রির সময়ই মালিকের কাছ থেকে ২ লাখ টাকা বেশি নেয়। এভাবে প্রায় দেড় দশকে কামিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা।
টিআইবি জরিপ রিপোর্টে চাঁদাবাজি করে পরিবহন খাত থেকে ১১ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করার তথ্য উঠে আসে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। তৎপর হয়ে ওঠে দুদক। কিন্তু এনায়েতের ক্ষমতার দাপট ও রাজনৈতিক সংযোগে দুদক চুপসে যেতে বাধ্য হয়। গুঞ্জন রয়েছে, এক দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি ফোন কলেই থমকে যায় এনায়েতের বিরুদ্বে শুরু হওয়া দুদকের অনুসন্ধান। খুবই ধুর্ত ও লোভী প্রকৃতির খন্দকার যেই সাইফুল-বাতেনের আর্শীবাদে একটি মাত্র বাস চালানোর মাধ্যমে পরিবহনে আত্মপ্রকাশ করেন, তাদেরকেই তিনি ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হবার পরদিনই এনায়েত রাতের অন্ধকারে দখল করে নেন তৎকালীন নির্বাচিত কমিটি সাইফুল বাতেনের অফিস। সেই থেকে টানা পনের বছরে তিনি একটি বাসের মালিক থেকে হয়েছেন প্রায় ৭০০ বিলাসবহুল বাসের মালিক। চাদাবাজির টাকায় ২ কোটি টাকা থেকে শুরু করে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত দামের বাসের মালিক হন তিনি। বর্তমানে তিনি ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। এই সাইনবোর্ড ব্যবহার করেই তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। সরকার পতন পর্যন্ত তিনি পরিবহন সেক্টরে একক রাজত্ব সৃষ্টি করেছেন।
এনায়েতের যত সম্পদঃ
বাড়ি-গাড়ি, ফ্ল্যাটপ্লট, ফ্যাক্টরি, হোটেল-মোটেল, বিদেশে সেকেন্ড হোম, সবই রয়েছে তার। অর্জিত সম্পদের মধ্যে রয়েছে ধানমন্ডির ১১/এ ৬২নং কনকর্ড টাওয়ারে ১টি ফ্ল্যাট, একই রোডের ৭৯নং সুবাস্তু টাওয়ারে ১টি, ধানমন্ডির ১০ নম্বর সড়কের ১১নং কনকর্ড টাওয়ারের আরেকটি ফ্ল্যাট। গুলশানে আছে তার তিনটি ফ্ল্যাট। ইস্কাটন এবিসি টাওয়ারে রয়েছে একটি ফ্ল্যাট। ধানমন্ডিতে তার দুটি, পল্লবীতে ৫ কাঠা জমির উপর বহুতল ভবন। মিরপুরে তার রয়েছে ৫টি বহুতল ভবন। এরমধ্যে সাততলা থেকে শুরু করে ১৫ তলা পর্যন্ত। মিরপুর-১ নম্বরে বেড়িবাঁধ চটবাড়িতে প্রায় ১২০ কোটি টাকা মূল্যের ১৭২ শতাংশ জমি, সিলেটে প্রায় ৭৬ কোটি টাকা মূল্যের ১২০ কাঠা জমি। ঢাকা টু ময়মনসিংহ, গাবতলী টু নাগেশ্বর, ঢাকা টু কক্সবাজার, ঢাকা টু চট্টগ্রাম, ঢাকা টু সিলেট, ঢাকা টু ফেনীতে তার শতাধিক কাউন্টার রয়েছে। প্রত্যেকটি কাউন্টার জমি কিনে তৈরি করা হয়েছে। না হয় নগদ টাকায় কেনা হয়েছে। প্রতিটি কাউন্টারের জন্য ২০ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত টাকা দেয়া আছে।
ময়মনসিংহের ভালুকায় ৭৫ বিঘা জমির উপর এনা ফুডস কোম্পানি ও তার পাশে রয়েছে আরও ১৫০ বিঘা জমি। পূর্বাচল ৩০০ ফিট রাস্তার পাশে প্রায় শত বিঘা জমি। সিলেট কদমতলী বাস টার্মিনালে এনা পরিবহনের নিজস্ব টার্মিনাল। সেখানেই ২০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। মহাখালীতে নিজস্ব জমিতে এনা পরিবহনের অফিস। ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লা বিশ্ব রোডের কাল কচুয়া বাজারের কাছে খন্দকার ফুড গ্যালারি নামে একটি রেস্টুরেন্ট ও পেট্রোল পাম্প রয়েছে।
কক্সবাজার ও কুয়াকাটাতে দুটি আবাসিক হোটেল। মালয়েশিয়া, কানাডা ও আমেরিকায় রয়েছে সেকেন্ড হোম। অভিজাত এসব বাড়ি কিনতে তার প্রায় ২০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। আল আরাফাহ ইসলামি ব্যাংক, এইচএসবিসি ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকের হিসাবে রয়েছে তার কোটি কোটি টাকা। নিজের ও পরিবারের সদস্য ছাড়াও এনায়েত তার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও কাছের মানুষের নামে ফ্ল্যাট, প্লট, গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, বিদেশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মালিক সমিতির কার্যালয় ছিল মতিঝিলে বিআরটিসি ভবনে। ছয় বছর আগে ইউনিক হাইটসে আট হাজার বর্গফুটের অফিস নেন এনায়েত। ওই অফিসের পেছনে প্রায় ১৫ কোটি টাকা খরচ করেন তিনি।
এনায়েতের উত্থানঃ
খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ফেনীর ছাগলনাইয়ার নীচপনুয়া গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা ওবায়দুল হক খন্দকার ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে এনায়েত ছিলেন তৃতীয়। আশির দশকের শুরুতে ইরাকে ফিডার মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন। সেখান থেকে ফেনীতে ছিলেন কিছুদিন। এরপর ঢাকার মিরপুরে বসবাস শুরু করেন।
সেখানেই পরিচয় মিরপুর-গুলিস্তান রুটের পরিবহন নেতা সাইফুল ও বাতেনের সঙ্গে। তাদের সহযোগীতায় ১৯৮৪ সালে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়ে পার্টনারশিপে একটি মিনি বাস কিনেন। মিরপুর-গুলি¯তান রোডে চলাচল করতো। ৮৭ সালে তিনি মিরপুর-গুলিস্তান রুটের মিনিবাস মালিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক হন। ১৯৯১ সালে যোগ বিএনপিতে যোগ দেন। ৯৬ সালে হঠাৎ বিএনপি ছেড়ে অনুসারীদের নিয়ে ৯৬ সালে সচিবালয়ে পাশে গড়ে ওঠা আওয়ামীলীগের আন্দোলনের প্লাটফর্ম জনতার মঞ্চে উঠেন। খুলে যায় কপাল। ওখান থেকেই শেখ হাসিনার নেকনজরে পড়েন। সেবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশীর্বাদ পেয়ে যান। তখনই দখল করে নেন এনা পরিবহনের একক কর্তত্ব। যে কারণে ১৯৯৯ সালের মধ্যেই তিনি ২০টি বাসের মালিক হন।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে কিছুদিনের জন্য চলে যান আত্মগোপনে। বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকার শেষ মুহুর্তে এসে আবারও সক্রিয় হন পরিবহন সেক্টরে। ২০০৯ সালে আওয়মাী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠনের এনায়েতের নিয়ন্ত্রনে চলে যায় পরিবহণ জগতের একক কতৃত্বময় অফিস ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। এই পনের বছরে আবির্ভূত হন পরিবহন জগতের একক মাফিয়া হিসেবে।
দুদকের তদন্ত ধামাচাঁপা:
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য লীগ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ইসমাইল হোসেন বাচ্চু দাবি করেন, সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত প্রতিদিন ঢাকার পরিবহন খাত থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায় করেন। ওই সময় অভিযোগ সংক্রান্ত নানা তথ্য-উপাত্ত দুদকেও জমা দেয়া হয়। তার নেতৃত্বে ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী ১৫ হাজার বাস থেকে দৈনিক ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হতো। এভাবে বছরের পর বছর চাঁদা আদায় করে নামে-বেনামে হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন সড়ক পরিবহনের ওই নেতা। তখন অনুসন্ধানে নামে দুদক। প্রাথমিক প্রমাণ পেয়ে তাকে সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ দেয় সংস্থাটি। ওই নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সম্পদের হিসাব দাখিল করেন।
এনায়েত ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের তথ্য-প্রমাণ পান অনুসন্ধান কর্মকর্তারা। যাচাই-বাছাই শেষে তার বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করে দুদকে প্রতিবেদন জমা দেন আড়াই বছর আগে। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অফিসের টেলিফোনে তখনকার অনুসন্ধান থমকে যায়।
জানা গেছে-প্রথমে দুদকের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফয়সালকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিছুদিনের মধ্যে তিনি শিক্ষা ছুটিতে গেলে আরেক উপ-পরিচালক মো. নুরুল হুদাকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়।
অনুসন্ধানের শুরুতে দুদক কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফয়সাল খন্দকার, এনায়েত, তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের সম্পদের নথিপত্র চেয়ে সরকারি-বেসরকারি ৫৮টি ব্যাংকসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠান। এরপর কর্মকর্তা বদল হয়ে উপ-পরিচালক নুরুল হুদা দায়িত্বে এলে তিনি এ অনুসন্ধান এগিয়ে নেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিআরটিএ, নিবন্ধন অধিদপ্তর, ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ পাঁচ সিটি করপোরেশন, ময়মনসিংহ ও কক্সবাজার পৌরসভা এবং জাতীয় গৃহায়ন অধিদপ্তরসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা নুরুল হুদা। এরপর ২০২১ সালের জুনে খন্দকার এনায়েত ও তার স্ত্রী নার্গিস সামসাদ, ছেলে রিদওয়ানুল আশিক নিলয় ও মেয়ে চাশমে জাহান নিশির নামে থাকা সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ দেয়া হয়। ওই নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে তারা সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। এনায়েত উল্লাহ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের তথ্য-প্রমাণ পান অনুসন্ধান কর্মকর্তা। পরে তাদের সম্পদ বিবরণী যাচাই-বাছাই শেষে দেন আড়াই বছর আগে কমিশনে প্রতিবেদন দেন এবং মামলা করার সুপারিশ করেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা নুরুল হুদা। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এটি শেষ পর্যন্ত থমকে যায়।
দেশে থাকতে একাধিবার গণমাধ্যমকে তিনি ধম্ভ করে বলতেন আমার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিন্তু কখনো এগুলো প্রমাণ করা যাবে না। কারণ আমি কোনো চাঁদাবাজি করিনি। সংগঠন যে চাঁদা নিত সেটা নিয়ম অনুযায়ী নিত। কোনো জেলা সমিতি বলতে পারবে না, আমি চাঁদাবাজি করেছি। ৫ আগস্টের আগে থেকেই বিদেশে আত্মগোপনে থাকায় খন্দকার এনায়েত উল্লাহর বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
আপনার মতামত লিখুন :