তিনি ছিলেন পাথর রাজ্যের অধিপতি। এই রাজ্যের সীমানা ছিল জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পর্যন্ত। তিনি ছিলেন জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ নিয়ে গঠিত সিলেট-৪ আসনের সংসদ সদস্য। অপ্রতিরোধ্য নেতা। এই আসনে টানা ৬ বারের এমপি। নাম তার ইমরান আহমদ। সাবেক প্রবাসী ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী। সরকারের ক্যাবিনেটে এবং জাতীয় সংসদে তার আলাদা একটি পরিচয় ছিল, তিনি ফ্যাসিস্ট সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার বান্ধবীর স্বামী। ধানমন্ডির ৩২-এ পাশের বাসা ছিল তার শ্বশুরবাড়ি। এই পরিচয়ে তিনি যেমন সবসময় ভাগিয়ে নিতেন দলীয় মনোনয়ন, তেমনি সরকারের ক্যাবিনেটের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়েও তার জায়গা হয়ে যায়।
অবশ্য ৬ বারের এমপি হলেও তিনি স্থানীয়দের কাছে ছিলেন ‘বসন্তের কোকিল’। অভিজাত শ্রেণির নেতা। পৈতৃক বাড়ি জৈন্তাপুরের শ্রীপুর পাথর কোয়ারির তীরে। থাকতেন ঢাকায়। সেখানেই বাড়ি-ঘর।
আসতেন মেহমানের মতন। কখনো কখনো উঠতেন নিজের বাংলোয়। বাকি সময় থাকতেন সাকির্ট হাউসে। সাধারণ জনগণ তার দেখা পেতেন না। কালেভদ্রে তারা মেহমানদারির সুযোগ পেলেও অপমানিত হওয়ার উদাহরণ ভূরি ভূরি। হাত মেলানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দিলে তিনি ফিরিয়ে নিতেন। চাষাচোষা, গরিবের হাতের ছোঁয়া নিতে পারতেন না, ছিল ভীষণ অ্যালার্জি।
আপন বলতে তার ছিল শুধু শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুরবাড়ির লোকজন ছাড়া স্থানীয় নেতাকর্মীদের তিনি বিশ্বাস করতেন না। স্থানীয় কাউকে তেমন একটা পাত্তাও দিতেন না। তাদের পাশ কাটিয়ে ভাই-শ্যালক এবং স্থানীয় মাত্র পাঁচজন খাস প্রতিনিধির মাধ্যমে গড়ে তুলেন আপন সাম্রাজ্য। এই সিন্ডিকেটে চলত পুরো সাম্রাজ্য। যার অঘোষিত রাজা তিনি। যে সাম্রাজ্যে আছে পাথরের সোনা। প্রাকৃতিক সম্পদ বালু-পাথর। যে রাজ্যের ‘রাজ কোষাগার’ থেকে অর্জিত অর্থেই ইমরান আহমদ নির্বাচনি ব্যয় মিটাতেন। কখনো তার পকেট থেকে অর্থ ঢালতেন না। তার সেই সোনার ডিম পাড়া পাথরের রাজ্যে স্থানীয় নেতাদের প্রবেশাধিকার ছিল শূন্যের কোটায়। নেতাকর্মিদের সঙ্গে তার ছিল যোজন-যোজন দূরত্ব। ফলে নিজে সাম্রাজ্য গড়ে তুললেও তার এবং নিজের ‘প্রজা’ ও ‘সৈন্য সামন্ত’দের মধ্যে তৈরি করেছিলেন বিস্তর ফারাক। স্থানীয় আওয়ামী লীগে সবসময় ঝিইয়ে রাখতেন অভ্যন্তীরণ দ্বন্দ্ব। এ নিয়ে তার ‘১৭ পরগনা’য় ক্ষোভের শেষ ছিল না। স্থানীয় আওয়ামী লীগে তার বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল শক্তিশালী বলয়। যারা সর্বশেষ নির্বাচনে তার বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু ‘বউ’-এর কাছে হার মানতে হয় নেতাদের। বরাবরের মতোই তিনি স্ত্রীর কল্যাণে থেকে যান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। তিনি তার অপছন্দের মানুষকে শায়েস্তা করতেন ‘বঞ্চিত’ করে।
১৭ পরগনার এলাকা নামে পরিচিত সিলেটের জৈন্তাপুর। ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশরা শাসনকালের প্রথম একশ বছর জৈন্তা রাজ্য স্বাধীন ছিল। এটিই ছিল সর্বশেষ স্বাধীন রাজ্য। এই রাজ্য ছিল ১৭ পরগনার। সেই থেকে এখনো এ অঞ্চলে ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে পরগনা প্রথা চালু রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী এই জৈন্তাপুর উপজেলাসহ গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ নিয়ে গঠিত সিলেট-৪ সংসদীয় আসন। এই আসনের ৬ বারের এমপি ইমরান আহমদ। পূর্বের জৈন্তা রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকার এমপি ছিলেন তিনি। ’৮৬ থেকে এ আসনে সংসদ সদস্য প্রার্থী হয়ে আসেন ইমরান আহমদ। দীর্ঘ সময়ের এমপি হওয়ায় এ আসনের ‘অঘোষিত রাজা’র আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন তিনি। বিএনপিতে প্রার্থীরা এসেছেন, চলেও গেছেন কিন্তু ইমরান আহমদ তার অবস্থান শেষ পর্যন্ত ধরে রেখেছিলেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীরা জানিয়েছেন, সিলেট-৪ আসনে তার বিকল্প আওয়ামী লীগের ভেতরে কাউকে তিনি গড়ে উঠতে দেননি। নানাভাবে দমিয়ে রেখেছেন। ফলে নৌকার টিকিট সব সময়ই তিনি পেতেন। পতিত শেখ হাসিনা তার স্ত্রীর বান্ধবী হওয়ায় পারিবারিক ঘনিষ্টতা ছিল তাদের মধ্যে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ভোটে প্রার্থী হলেও ইমরান আহমদ সবসময় এ আসনের মানুষদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে চলতেন। সভা-সমাবেশে তিনি বক্তৃতা করতেন কিন্তু কখনোই গাড়ি থেকে নেমে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতেন না। কদাচিৎ হাত মিলিয়ে নিলেও সঙ্গে সঙ্গে টিস্যু দিয়ে মুছে নিতেন। এ আসনে বিএনপির নেতা দিলদার হোসেন সেলিম যখন প্রার্থী হয়ে আসেন তখন তার এমন স্বভাবে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল। কিন্তু পরের ১৬ বছর তিনি আবার তার স্বভাবের ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন।
একাধিক সূত্র জানায়, মন্ত্রী থাকাবস্থায়ই ২৪ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। তবে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকায় তার টিকিটিও কেউ ছুঁতে পারেনি। না দুদক না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বরং তিনিই নাকে ছড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছেন তাদের। তবে ৫ আগস্টের পর ৩ সেপ্টেম্বর ইমরান আহমদসহ ১০৩ জনের বিরুদ্ধে ওই ২৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে রাজধানীর পল্টন থানায় মামলা দায়ের হয়। ট্রাভেল ব্যবসায়ী আলতাব খান বাদী হয়ে এ মামলা করেন। সেই মামলায় রোববার রাতে ঢাকায় আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় গ্রেপ্তার হন ইমরান আহমদ। ৫ আগস্টের পর এলাকার সংগঠিত হওয়া একাধিক ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায়ও তিনি ছিলেন ফেরারি আসামি। বর্তমানে তিনি কারাগারে। পূর্বে তিনি একাধিকবারের এমপি হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর তিনি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সর্বশেষ একতরফা সংসদে তিনি এমপি নির্বাচিত হন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ইমরান দুর্নীতির বরপুত্র হয়ে উঠেন মূলত পাথর কোয়ারি দিয়ে। নির্বাচিত হয়েই জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাটের পাথর কোয়ারি ও বালু মহালগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন নিজের কব্জায়। এগুলো চালাতেন তার ঘনিষ্টজনদের দিয়ে। গত তিন দশক ধরে তিনিই লুটপাট চালিয়ে কোয়ারি থেকে তার সিন্ডিকেট হয়েছে কোটি কোটি টাকার মালিক। যার মধ্যে কয়েক হাজার কোটি টাকা গিয়ে ঢুকেছে ইমরান আহমদেরই পকেটে। যদিও নির্বাচনি হলফনামা অনুযায়ী তিনি ছিলেন ‘গরিব’। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে দাখিল করা হলফনামায় তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩ কোটি ৭৬ লাখ ৩৫ হাজার ৭১৯ টাকা। অবশ্য এটাও ছিল ২০০৮ এর সংসদ নির্বাচনের আগে হলাফনামায় দেওয়া সম্পদের হিসাবের ৭০ গুণ বেশি।
স্থানীয়দের তথ্যমতে, ইমরান আহমদের রাজ্য দেখাশোনার জন্য হাতেগোনা কয়েকজন ছিলেন তার খাস সিপাহসালার। তিনি তিন উপজেলাকে তিনজনের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দিয়েছিলেন। জৈন্তাপুরে ইমরানের খাস মানুষ ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদ্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এম লিয়াকত আলী। গোয়াইনঘাটে ছিলেন অধ্যক্ষ ফজলুল হক এবং কোম্পানীগঞ্জ দেখাশোনায় ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আপ্তাব আলী কালা মিয়া। সর্বশেষ নতুন করে ইমরানের সিন্ডিকেটে যুক্ত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী ও সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য হেনা বেগম। তিনি মূলত তার সিপাহসালা এবং স্থানীয় নেতাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করতেন। তারাই ইমরান আহমদের হয়ে নিয়ন্ত্রণ করতেন লুটপাটের রাজত্ব। ইমরান ছিলেন এই সিন্ডিকেটের প্রধান।
ভোলাগঞ্জ, জাফলং, বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারি এবং স্থানীয় নদীগুলোতে বালু লুট হতো ইমরান আহমদ সিন্ডিকেটের কথায়। তিনি যখন বলতেন বন্ধ, তখন সব বন্ধ। আর যখন খোলার অনুমতি দিতেন তখন আবার শুরু হতো। তার কাছে চাদা যেত তিন ভাগে। এক ভাগে টাকা পাঠানো হতো স্থানীয় বিশ্বস্ত কিছু কর্মীর মাধ্যমে। বাকিটা যেত ভাই-শ্যালকের সিন্ডিকেট থেকে। আর একটি যেত প্রশাসনের তরফ থেকে। প্রশাসনের মধ্যে পুলিশের অংশ ছিল সবচেয়ে বেশি। জৈন্তাপুর বাজারে পুলিশের বসানো সিসি ক্যামেরা দিয়ে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি করা হতো যানবাহনগুলো। তবে এই সিসি ক্যামেরার প্রধান কাজ ছিল কয়টি পাথর ও ভালুভর্তি ট্রাক সড়ক দিয়ে যাতায়াত করেছে তার হিসাব রাখা। এটি নিয়ন্ত্রণ করা হতো জৈন্তাপুর মডেল থানার ভেতরে বসেই। এই ট্রাক থেকে নির্দিষ্ট হারে সড়কে চাঁদা তুলত পুলিশ। যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মাস শেষে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হতো ইমরান আহমদের কাছে। উপজেলা প্রশাসন থেকেও একটি অংশ পেতেন তিনি।
অভিযোগ আছে, চিনি চোরাচালানের প্রধান উৎস ছিলেন তিনিই। তার আস্কারায় ও সহায়তায় চোরাকারবারিরা সিলেট সীমান্তের জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাটকে চিনি চোরাচালানের প্রধান রুট বানিয়ে ফেলে। তার হাত ধরেই বালু, পাথর লুট ও চোরাচালানের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয় কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলা।
আপনার মতামত লিখুন :