জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীরা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন। ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে দলটি। দলের সম্ভাব্য নাম হিসেবে ‘জনশক্তি’ প্রস্তাব করা হয়েছে। নামটি চূড়ান্ত হওয়ার আগে আরও মতামত নেওয়া হবে। বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্যের হবে। ছাত্রনেতারা জানিয়েছেন, তাদের দলের মূল লক্ষ্য হবে জনগণের আস্থা অর্জন।
এদিকে গতকাল শনিবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে নতুন কোনো রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়নি বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন জাতীয় জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বরাতে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে অনাগত রাজনৈতিক দলের নাম ‘জনশক্তি’, যা জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে, এ ধরনের কোনো নাম কিংবা সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়নি। বিজ্ঞপ্তিতে এ নিয়ে সবাইকে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
এদিকে প্রশ্ন উঠেছে, এত দলের ভিড়ে নতুন এই দল আদতে কেমন হবে? ছাত্রনেতারা জানান, তারা প্রচলিত রাজনীতির ধারা থেকে আলাদা কিছু উপস্থাপন করবেন। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। সর্বোচ্চ জায়গায় আসীন হতে পারেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কারণ, তাদের ত্যাগ বেশি ছিল জুলাই অভ্যুত্থানে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার শেষটা হয় ফ্যাসিবাদের পতনের মধ্য দিয়ে। মূলত সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে জুলাই-আগস্টের যে আন্দোলন শুরু হয়, তার গতি বাড়তে থাকলে তা সরকারের পতনের কঠোর কর্মসূচিতে পরিণত হয়। শেষমেশ আন্দোলনকারীরা সফল হন, এরপর রাষ্ট্র সংস্কারের আলোচনা সামনে আসে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচন প্রক্রিয়ার দিকে এগোচ্ছে। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচিত হলে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব তাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। এই প্রেক্ষাপটে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এবার ভোটের মাঠে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক লড়াইয়ে নামার পরিকল্পনা করছেন।
যদিও নতুন দল গঠন করার কাজ পুরোদমে শুরু করেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি তবে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে পতিত ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে পরিচিতি লাভ করা পৌর ও সিটি কাউন্সিলরদের নিয়ে পৃথক অনুষ্ঠানের কারণে। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এসব জনপ্রতিনিধি নিয়ে বিশাল অনুষ্ঠান করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা মনে করছেন, তাদের দলে ভিড়িয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের শেল্টার দেওয়ার চেষ্টা করছে তারা। জুলাই বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবন ‘যমুনা’ অভিমুখে গণপদযাত্রা হবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে অভিযোগ তুলে তিনি বলেছেন, ‘পতিত স্বৈরাচারকে পুনর্বাসন করতে হলে আমাদের লাশের ওপর দিয়ে করতে হবে।’
জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘দল গোছানোর আগে আমাদের সারা দেশে জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠনের কাজ চলছে। আশা করছি, জানুয়ারি নাগাদ সারা দেশে কমিটি গঠনের কাজ শেষ করতে পারব। তারপর আমাদের কমিটি, সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তৃপক্ষীয় মতবিনিময় সভার আয়োজন করব। আমরা সবার মতামতের ভিত্তিতে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করব। পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইচ্ছা আমাদেরও আছে। তবে আমরা কারো সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াতে চাই না।
আমরা মানুষকে বোঝাব, কিন্তু মানুষ তাদের স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পারবে। একজন প্রধানমন্ত্রীর দিকে যাতে আর তাকিয়ে থাকতে না হয়, সেই প্রচেষ্টা আমাদের আছে। যাতে ৫০টা ছেলে প্রধানমন্ত্রী হতে পারে, আমরা সেই যোগ্যতা অর্জন করতে চাই। জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিয়ে আমরা একসঙ্গে মার্চ করব। একটি নতুন রাজনৈতিক দল হবে, যেটাতে মানুষের সমর্থন থাকবে। ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের ৪০ শতাংশ জেলা-উপজেলার কমিটি দেওয়া হয়ে গেছে। জানুয়ারিতে আমাদের আরও ৪০ শতাংশ জেলায় কমিটি দেওয়ার কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি। ফেব্রুয়ারির শুরুতে সারা দেশে কমিটি গঠনের কাজ শেষ করে নতুন দলের আত্মপ্রকাশ ঘটবে বলে আশা করছি। কমিটি গঠনের কাজ আমাদের এত দ্রুত এগিয়ে চলছে, আমরা আশা করছি, জানুয়ারিতে কমিটির কাজ শেষ করে ফেলতে পারব।
রাজনৈতিক দলগুলো আগে কেন্দ্র ঠিক করে, তারপর জেলা, তারপর মহানগর, তারপর থানা-উপজেলায় কমিটি করে। কিন্তু আমরা উল্টো করছি। আমরা তৃণমূল থেকে কমিটির কাজ শুরু করেছি। তৃণমূল থেকে থানা, উপজেলা, জেলা, মহানগর, তারপর আমরা কেন্দ্রে পৌঁছাব।
আগামী দুই মাসের মধ্যে নতুন দল আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে বলে যে গুঞ্জন রয়েছে, সেখানে জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দল বলেই জানা গেছে। প্রাথমিকভাবে দলের নাম ঠিক করা হয়েছে ‘জনশক্তি’। তবে মতামত নেওয়া শেষে এই দলের নাম বদলাতেও পারে।
জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘নতুন দলের প্রধান লক্ষ্য হতে হবে জনগণের আস্থা অর্জন। আমরা মনে করি, নতুন যে দল আসবে, তা শুধু প্রতিশ্রুতি কিংবা কথাবার্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। নতুন দলকে মানুষের নার্ভ বুঝতে হবে। মানুষের চাওয়াটা কী বুঝতে হবে। ক্ষমতা কুক্ষীগত করে রেখে আওয়ামী লীগ মানুষের চাওয়াটাই ভুলে গিয়েছিল। তারা যা চাপিয়ে দিত, মানুষকে তাই মেনে নিতে হতো। এটা আর যাতে না হয়, তার জন্যই আন্দোলন করছি আমরা।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘মানুষ যদি চায় আমাদের কোনো রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলা উচিত, তবে আমরা বিষয়টিকে প্রাধান্য দেব। নতুন দলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি যুক্ত হবেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কারণ জুলাই আন্দোলনে তাদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। আমরা মানুষের অধিকার আদায়ে কাজ করতে চাই।’
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা যে দল গঠন করছি, তা নতুন কাঠামোতে গড়ে উঠবে। এখানে ফ্যাসিবাদী সাংবিধানিক কাঠামোর কোনো জায়গা থাকবে না। পুরোনো রাজনৈতিক দলের সমস্যাগুলো, যেমন-টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি বা জনবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকে এসব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত একটি প্ল্যাটফর্ম হবে এটি। আগামী এক-দুই মাসের মধ্যে দলটি মাঠে আনতে সক্ষম হব বলে আমরা আশা করি। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির বিপরীতে দাঁড়িয়ে আমাদের রাজনীতি হবে মানুষের কণ্ঠস্বর। রাজনৈতিক দল গঠন করলে তা পরিচালনায় অর্থের উৎস আসবে কোথা থেকে এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের যেমন স্ট্রাকচার আছে, আমরা সেগুলো ফলো করছি। তারা যেভাবে ফান্ড কালেকশন করে, আমরা হয়তো সেভাবে করব না। আমরা ক্রাউড ফান্ড করব।
ইন্টারন্যাশনাল দেশে যে ফোরাম রয়েছে, আমরা তাদের সহযোগিতা নিতে পারি। রাজনৈতিক দল গঠনে যেসব প্রক্রিয়া রয়েছে, আমরা তার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই দল গঠন করব। আমরা পাওয়ার চাই না, আমরা রক্তের বদলা চাই। সেটা ব্যালট হোক কিংবা বুলেট। যেকোনো মাধ্যমে আমরা বিচার চাই। আমরা ক্ষমতাকে টার্গেট করছি না। আমরা বিরোধী দলে থাকতে চাই। আমরা দেখতে চাই, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কী করে। ব্যালট রেভল্যুশনের পথ তো খোলাই থাকছে।’
বাংলাদেশ লেবার পার্টি চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা লায়ন মো. ফারুক রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘যে কেউ দল গঠন করতে পারে, এটা তাদের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু দল গঠন করতে গিয়ে যদি পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর, মেম্বার কিংবা দলের কর্মীদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হয়, তাহলে তা মেনে নেবে না দেশের মানুষ। যে আওয়ামী লীগের পতনের জন্য হাজার হাজার ছাত্র-জনতা প্রাণ দিল, তাদের রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। পঙ্গু হয়ে হাসপাতালে এখনো কাতরাচ্ছে আপনার-আমার ভাই বোনেরা। সেই মুহূর্তে নতুন দল গঠন করতে গিয়ে ফ্যাসিবাদের চিহ্নিত দোসরদের নিয়ে দল গঠন করা হলে তা হবে দেশের মানুষ ও শহিদদের সঙ্গে বেইমানি। আমরা শুনেছি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে কম পরিচিত মুখদের নিয়ে তারা দল গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা মনে করি, এর পেছনে আওয়ামী লীগের নেতাদের পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা চলছে।’
এলডিপির একাংশের চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, দল যে কেউ করতেই পারে, তবে ক্ষমতা ব্যবহার করে, বিভিন্ন সংস্থাকে ব্যবহার করে কিংস পার্টি তৈরি করে দল করা অন্যায়। এটা গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর মতো। এরই মধ্যে দল গঠন করতে গিয়ে ফ্যাসিবাদের দোসরদের তাদের দলে ভেড়ানোর পাঁয়তারা করছে। একাধিক অনুষ্ঠানে তারা পতিত স্বৈরাচারের কাউন্সিলরদের নিয়ে অনুষ্ঠান করেছে। এটা তো জুলাই অভ্যুত্থানের শহিদদের সঙ্গে সরাসরি বেইমানি। আগামী জাতীয় নির্বাচনের ফল যাই হোক, নিজেদের বিপ্লবী চেতনা ধরে রাখার অঙ্গীকার বিপ্লবী ছাত্রদের। দল করার পর এককভাবে কিংবা অন্য কোনো রাজনৈতিক জোটে যোগ দিতে পারে বলেও গুঞ্জন রয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :