ঢাকা শুক্রবার, ০১ নভেম্বর, ২০২৪

ওসমানী হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণে ৩ কুতুব

সালমান ফরিদ, সিলেট

প্রকাশিত: অক্টোবর ৩১, ২০২৪, ০১:২৩ এএম

ওসমানী হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণে ৩ কুতুব

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্টাফ নার্স ইসরাইল আলী সাদেক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে কারাগারে। অভিযোগের ভার মাথায় নিয়ে সাময়িক বরখাস্ত ওয়ার্ড মাস্টার রওশন হাবীব এবং হাসপাতালের কর্মচারী আব্দুল জব্বার। তবুও এই তিনজন থেমে নেই। হাসপাতালে তারা ‘৩ কুতুব’ নামে পরিচিত। বর্তমানে বাইরে থাকলেও তারা ঠিকই খবরদারি করছে ওসমানী হাসপাতালে।

আমিনুল ইসলাম, সুমন চন্দ্র দেবসহ তাদের সহযোগীদের দিয়ে এখনো নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে হাসপাতালের নানা জায়গায়। তাদের ঈশারায় চলে নার্সদের একটি বড় অংশ। এই সিন্ডিকেট হাসপাতালে ঘুষ বাণিজ্য, সরকারি ওষুধ চুরি, দালাল চক্র গড়ে তুলে অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে।

এছাড়াও সিন্ডিকেটের সদস্যরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে প্রতারণা, দুর্নীতি, টাকা আত্মসাৎ, চুরি-বাটপারি, টেন্ডার বাণিজ্য, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, বিনামূল্যে সরকারি ওষুধ প্রদান না করে এবং ওটি থেকে ওষুধ চুরি করে দালাল দিয়ে বাইরের ফার্মেসিতে বিক্রি করার মতো কাজের সঙ্গেও জড়িত।

সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। নানা সময় এই হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণে গড়ে ওঠে সিন্ডিকেট। সর্বশেষ গড়ে ওঠে ব্রাদার ইসরাইল আলী সাদেকের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এমন কোনো কাজ নেই যা তারা করেনি। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাছে তারা ছিল ‘মুশকিলে আসান’। সব রোগের ওষুধ। এই সিন্ডিকেট গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ফুলেফেঁপে হয়ে ওঠে মহিরুহ। সরকারি দলের ছত্রছায়ায় থাকা সাদেকের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কাজ ছিল ওপেন সিক্রেট। ফলে সব সময়ই তারা ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে।

গত একতরফা সংসদ নির্বাচনে নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাদেক সিলেট-১ আসনে ড. একে আব্দুল মোমিনের পক্ষে ভোটকেন্দ্রে নার্সদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে ফটোসেশনে রেখেছিল। এ ঘটনাটি দেশজুড়ে আলোচিত হয়। এরপর থেকে সাদেকের উপর নজর পড়ে গোয়েন্দাদের। হাতে-নাতে দুর্নীতির টাকাসহ দুই সহযোগী গ্রেপ্তার হওয়ার পর সাদেক আড়ালে চলে যায়। পরে অবশ্য আদালতে হাজির হতে গিয়ে আটক হয়। কয়েক মাস ধরে সে কারাগারে। কিন্তু কারাগারে থেকেও এখনো ওসমানীতে তার চক্র সক্রিয়। এপ্রিল মাসে চক্রের আট সদস্যের বিরুদ্ধে দুদক আইনে সিলেটের বিশেষ আদালতে মামলা করেছিলেন ইসলাম উদ্দিন নামের এক ভুক্তভোগী। এ মামলাটি আদালত থেকে তদন্তের জন্য পাঠানো হয় দুদকে। পরে ওই মামলার আলোকে সিলেটের স্পেশাল আদালতের বিচারক হাবিবুর রহমানের আদালতের দুদকের পক্ষ থেকেই আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়। ইসলাম উদ্দিনের দায়ের করা অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার পর দুদক প্রধান কার্যালয়ের অনুমতি ক্রমে এ মামলাটি দায়ের করেন দুদক সিলেটের উপ-সহকারী পরিচালক নিঝুম রায় প্রান্ত।

মামলার আইনজীবী কানন আলম গণমাধ্যমকে জানান, দুদক ইসলাম উদ্দিনের এজাহারের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার পর তারা নিজেদের মামলা হিসেবে সেটিকে এজাহার হিসেবে গণ্য করেন।

ওই মামলায় অভিযুক্তরা হলো, হাসপাতালের স্টাফ নার্স কারাবন্দি ইসরাইল আলী সাদেক, স্টাফ নার্স আমিনুল ইসলাম, স্টাফ নার্স সুমন চন্দ্র দেব, পুলিশ কনস্টেবল জনী চৌধুরী, ওসমানী মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হাসান, হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার রওশন হাবীব, হাসপাতালের কর্মচারী আব্দুল জব্বার ও আব্দুল হাকিম সুমন। এরাই মূলত হাসপাতালকে নিয়ন্ত্রণ করত। তাদের কয়েকজন এখনো সিন্ডিকেট নিয়ে সক্রিয়।

বাদী ইসলাম উদ্দিন হাসপাতালের কোম্পানি যমুনা, সানমুন ক্লিনিং অ্যান্ড সিকিউরিটি সার্ভিস এবং আউট সোর্সিং কোম্পানির মাধ্যমে পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

তিনি জানান, সেবামূলক এ হাসপাতালের সংঘবদ্ধ দুর্নীতি চক্রের সক্রিয় সদস্য এই সিন্ডিকেটের সবাই। এই চক্রের সদস্যেরা দুর্নীতি করে অবৈধভাবে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছে।

সূত্র জানায়, ইসরাইল আলী সাদেক, রওশন হাবিব ও আব্দুল জব্বারের কাছে হাসপাতালের শত শত কর্মচারী জিম্মি ছিলেন। তারা বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারীদের কাছ থেকে দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা বখরা আদায় করত। এই দলেরও সদস্যরা এখনও তা-ই করছে। এরা ওসমানী হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের ওয়ার্ড, কেবিন, বেড, বারান্দা বেড ও উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা করার কথা বলে রোগী ও স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে। এ ছাড়া ভর্তি রোগীদের অপারেশনের সিরিয়াল পাইয়ে দেওয়া ও দ্রুত অপারেশন করিয়ে দিবে বলে টাকা গ্রহণ করে। ইসলাম উদ্দিন তার মামলায় হাসপাতালে দুর্নীতিবাজ চক্রের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে শুরু করে হাসপাতালের কয়েকজনের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত ৯ জানুয়ারি ওসমানী হাসপাতালে গোয়েন্দারা অভিযান চালিয়ে ঘুষের টাকা লেনদেনের সময় স্টাফ নার্স আমিুনল ও সুমনকে আটক করে। এ ঘটনায় হাসপাতালের দুর্নীতির হোতা সাদেককে প্রধান আসামি এবং গ্রেপ্তার হওয়া আমিনুল ও সুমনকে আসামি করে মামলা করেছিলেন হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ হানিফ। বর্তমানে কারাগারে আটক থাকা সাদেক, জামিনে থাকা আমিনুল এবং সাময়িক অব্যাহতি পেয়ে জব্বার ও রওশন বাইরে থাকলেও হাসপাতালে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটকে তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে। এখনো ওই চক্রের কাছে হাসপাতাল জিম্মি।

এদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের একটি সূত্র জানায়, হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুল জব্বার ও ওয়ার্ড মাস্টার রওশন হাবিবের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগের তদন্ত করেছিল তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। কমিটির রিপোর্টে তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হলেও রহস্যজনক কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

আরবি/জেডআর

Link copied!