ঢাকা বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫

রাজনীতিতে অশান্তির আভাস

রুবেল রহমান

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৫, ২০২৫, ০৯:১৩ এএম

রাজনীতিতে অশান্তির আভাস

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সংস্কার ও নির্বাচনের আকাক্সক্ষা নিয়ে নতুন বছরে যাত্রা শুরু করলেও এখনো সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না থাকায় বিএনপিসহ বিভিন্ন দল দ্রুত নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ বাড়াবে বলেই দলগুলোর নেতারা বলছেন। চাপ বাড়তে পারে সংস্কার প্রশ্নেও। 

গত ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের পতনের পর রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য অংশীজন ও ছাত্র-জনতার মধ্যে যে ঐক্য দেখা গিয়েছিল, সংস্কার ও নির্বাচন নিয়েও সেই ঐক্য তৈরি হয়েছিল। এখন নানা কারণে সন্দেহ-অবিশ্বাস আর দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে একে অপরের সঙ্গে।

ইতিমধ্যে ঐক্যের পরিবর্তে তৈরি হয়েছে মতপার্থক্য। এ বছর রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হতে পারে। দেশে শান্তির রাজনীতিতে অশান্তির দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ।

আগে সংস্কার নাকি নির্বাচন- এ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব বেড়েই চলছে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং তাদের মিত্র দল ও জোটগুলোর বেশির ভাগই প্রয়োজনীয় সংস্কার সেরে দ্রুত নির্বাচন চাইছে। 

বিএনপির দাবি, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে চলতি বছরের মাঝামাঝিতেই সম্ভব নর্িাচন। যদিও সরকার বলছে ’২৫-এর শেষে হবে জাতীয় নির্বাচন। এরই মধ্যে সরকারের একাধিক উপদেষ্টা জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়ে ছড়িয়েছেন উত্তাপ।

অন্যদিকে দেশজুড়ে সাংগঠনিক কমিটি গঠন করে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। 

প্রশাসনিক এলাকায় কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের নিয়ে বড় আকারের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হচ্ছে। এসব আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ বাস্তবায়নে গণসংযোগ কর্মসূচি করছে তারা।

তবে সাংগঠনিক কলেবর বৃদ্ধির সঙ্গে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া প্ল্যাটফর্মটির সদস্যরা জড়িয়ে পড়েছেন অন্তঃকোন্দলে। কোন্দল থেকে কয়েকটি সাংগঠনিক কমিটির সদস্যরা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষেও লিপ্ত হয়েছেন। 

এসব সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ১০ জনের আহত হওয়ার খবর মিলেছে। এখন পর্যন্ত ৩৫টি জেলা কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাংগঠনিক কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ঢাকাসহ বিভিন্ন মহানগরের অন্তর্গত থানাগুলোতে।

রোডম্যাপ নিয়ে ধোঁয়াশা: নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন, সংবিধান- এই ছয় ক্ষেত্রে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে। 

অন্য পাঁচটি সংস্কার কমিশন পরে গঠিত হওয়ায় তাদের প্রতিবেদন দিতে হবে ফেব্রুয়ারির মধ্যে। ফলে বছরের শুরুতেই আলোচনার কেন্দ্রে আসছে সংস্কারের বিষয়। প্রথম দফায় সংস্কার কমিশনগুলো সময় নিলেও বেশকিছু প্রস্তাবনা নিয়ে আজ বুধবার প্রধান উপেদেষ্টার কাছে সংস্কার প্রস্তাব জমা দেওয়ার কথা রয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিটির। 

তবে কবে দেবে নির্বাচনি রোডম্যাপ- এমন প্রশ্ন যখন সামনে তখন গত সোমবার এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, খুব দ্রুত নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করবে সরকার। বিএনপি এবং তার রাজনৈতিক মিত্ররা নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য বিষয়গুলোয় সংস্কার চায়।

আর পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের হাতে ছেড়ে দিতে বলছে তারা। জামায়াতে ইসলামী আগের অবস্থান থেকে সরে এসে এখন প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা বলছে। তবে ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল নির্বাচনের আগে পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের কথা বলে আসছে। 

সংস্কার নাকি নির্বাচন- এ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও তাদের সবাই দ্রুত একটি রোডম্যাপ চাইছে। সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে ফেব্রুয়ারিতে যে আলোচনা করবেন, সেখানে প্রশ্নগুলো উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গত অক্টোবরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবি তুলেছিল। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের মাধ্যমে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি করে তারা আসলে কী করতে চায়, এ নিয়ে ওই সময়ই সন্দেহ তৈরি হয় বিএনপিতে। 

দলটি প্রকাশ্যে সেই দাবির বিরোধিতা করেছিল। বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের অবস্থানের কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে দাবি থেকে সরে আসতে হয়। 

এ ছাড়া বিভিন্ন সময় ছাত্রনেতাদের বক্তব্যে রাজনৈতিক দলের সমালোচনাকে বিএনপির নেতারা সহজভাবে নিতে পারেননি। সর্বশেষ ‘জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েও বিএনপি নেতৃত্ব অসন্তুষ্ট হয়েছেন।

সম্পর্কের টানাপোড়েন বিএনপি-জামায়াতে: নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চ ও ১২ দলীয় জোটের দুজন নেতা বলছেন, নতুন দল গঠনের ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী ভেতরে ভেতরে সহযোগিতা করছে। তারা নির্বাচনি জোট করে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার চিন্তা করছে। 

মিত্রদের পাশাপাশি বিএনপিও এ ধরনের ধারণা করছে বলে ওই দুই নেতা জানান। এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপি ও জামায়াত নেতারা বাগযুদ্ধে জড়িয়েছেন। দুই দিন আগে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দলের এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের সমালোচনা করে বলেছেন, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চালাচ্ছে জামায়াত। পাল্টা বিবৃতি দিয়ে এ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে জামায়াত। কয়েক বছর ধরে দল দুটির সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল। 

বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনে ছিল না জামায়াত। তবে আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে দল দুটির সম্পর্কের টানাপোড়েন কিছুটা কমে আসে। দুই দলই আন্দোলনে অভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর জামায়াত জুলাই অভ্যুত্থানের বড় শক্তি হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছে। সেটিও বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কে প্রভাব ফেলছে।

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সদস্যসচিব মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, নতুন বছরে বিরোধ কমিয়ে ঐক্য ধরে রাখার বিষয়ে জোর দেওয়া উচিত। এ দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দলসহ সব অংশীজনের। আমরা আর অনৈক্য চাই না।

রাস্তায় নামতে পারে বিএনপি: ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচনের রোডম্যাপের জন্য অপেক্ষা করবে বিএনপি। এরপর সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে কিছু কর্মসূচিও নিতে পারে দলটি। এ ছাড়া মার্চে রোজা হলে মাঠে নামতে সময় গড়াবে আরও ১ মাস। ঈদের পর আন্দোলনে নামতে পারে বলে জানিয়েছেন বিএনপির এক সিনিয়র নেতা। তবে তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে সরিয়ে দেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি করতে চায় না। 

দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণসহ সার্বিকভাবে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হয়েছে এবং এটি দুর্বল সরকার। 

তারা মানুষের মধ্যে কোনো আস্থা তৈরি করতে পারেনি। কিন্তু এ সরকারকে সরিয়ে দিলে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। সেটিও চায় না বিএনপি। তবে পরিস্থিতি বিবেচনা করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া প্রয়োজন তাদের। 

অন্যদিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচার কার্যক্রম এ সরকারের মাধ্যমেই শেষ করতে চায় বিএনপি। কারণ, এই বিচারের দায়িত্ব এড়ানোর একটা বিষয় রয়েছে। ফলে বিএনপি ধৈর্য ধরবে, আবার নির্বাচনের জন্য চাপ বাড়াবে।

১২ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান লায়ন মো. ফারুক রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি দূরত্ব তৈরি হচ্ছে, সেটা দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। সরকার সেটি বুঝতে পারছে না। আমরা নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করব। 

আমরা মনে করেছি, একটি মহল সরকারকে ভুল বুঝিয়ে নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে। নির্বাচনকে দীর্ঘায়িত করলে সংকট বাড়বে বৈ কমবে না। 
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!