দেশের সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর (জিএসটি) গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে এবার দেখা দিয়েছে টালমাটাল অবস্থা। গুচ্ছভুক্ত ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্বতন্ত্রভাবে ভর্তি পক্রিয়া শুরু করেছে।
এই পথে রয়েছে আরও চারটি বিশ্ববিদ্যালয়। তারাও এবার গুচ্ছে থাকবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়কে গুচ্ছে ধরে রাখতে সরকারের শীর্ষমহল থেকে নানাভাবে উদ্যোগ নিয়েও ব্যার্থ হয়েছে। ফলে সব বিশ্ববিদ্যালয় এবার গুচ্ছে থাকছে না এটা প্রায় নিশ্চিত।
অন্যদিকে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছে রয়েছে, তাদের ভর্তি প্রক্রিয়া কবে শুরু হবে, সেই রোডম্যাপ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সব মিলিয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে এবারের এই টালমাটাল অবস্থার কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকেরা।
তারা বলছেন, মূলত গুচ্ছে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে বিগত সময়ের অব্যবস্থাপনার কারণেই আজকের এই অবস্থা। সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করলে গুচ্ছ নিয়ে জটিল এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না। এতে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিধা হলেও দুর্ভোগ বাড়বে শিক্ষার্থীদের।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা ও ভর্তি নিয়ে ধীরগতি, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত ভালো শিক্ষার্থী না পাওয়া, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার খরচের হিসাব নিয়ে নয়ছয়, মেধাবীদের ভর্তিতে অনাগ্রহ, গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েও শিক্ষার্থী না পাওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব স্বকীয়তা নষ্ট হওয়াসহ অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণেই মূলত বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছ থেকে বের হয়ে যেতে চায়।
গত দুই বছর ধরেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রক্রিয়া থেকে বের হতে জোর চেষ্টা চালিয়েছিল। এ কারণে গত শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষা নিয়ে দেখা দেয় জটিল অবস্থা।
কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় গত বছর জোরালো আপত্তি তুলে বের হতে চাইলে অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে যায় উচ্চশিক্ষার ভর্তি পরীক্ষা। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলরের অভিপ্রায় অনুযায়ী গতবার গুচ্ছ পদ্ধতিতেই পরীক্ষা হয়।
এবারের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের গুচ্ছে ভর্তি পরীক্ষা শুরুর পর থেকেই দেখা দেয় পুরোনো সংকট। আপত্তি তুলে বের হয়ে যাওয়ার পথ খুঁজতে শুরু করে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। সর্বপ্রথম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ থেকে বের হয়ে নিজস্ব প্রদ্ধতিতে ভর্তি নেওয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।
এরপর একে একে খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় একই পথে হাঁটে। তারা এরইমধ্যে গুচ্ছ থেকে বের হয়ে আলাদাভাবে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।
এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে গুচ্ছে রাখতে একাধিকবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদও দেশের রাজনৈতিক সংকট ও সার্বিক দিক বিবেচনা করে এবার গুচ্ছভুক্তভাবে ভর্তি নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে তিনবার চিঠি দিয়েছেন, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। গুচ্ছ থেকে বের হতে ইচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনড় অবস্থানে।
এদিকে এই তিন বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন।
সর্বশেষ গত সোমবার বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায়ও সব বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছে না থাকায় আপত্তি তোলেন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।
এর মধ্যে দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্বদ্যিালয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গোপালগঞ্জের ভিসি এবার গুচ্ছে থাকবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন বলে জানিয়েছে সভায় উপস্থিত একটি সূত্র।
এর আগে আগামী শিক্ষাবর্ষের গুচ্ছ ভর্তির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) আহ্বানে গত বৃহস্পতিবার একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি নেওয়া ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিগণ অংশগ্রহণ করলেও গুচ্ছের তারিখ কিংবা পদ্ধতিগত বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গুচ্ছ থেকে বের হওয়া একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বলেন, ‘গুচ্ছের কারণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বকীয়তা ও সুনাম নষ্ট হচ্ছে। আমরা ভালো শিক্ষার্থী পাচ্ছি না। সেশনজট লাগছে। তাই আমরা গত দুই-তিন বছর ধরে গুচ্ছ থেকে বের হতে চেয়েছি, কিন্তু সরকার দেয়নি।
অথচ ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, বুয়েট এককভাবে ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছে। তারা তাদের মান ঠিক রাখছে। এখন প্রশ্ন হলো, ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছ বা একক ভর্তি পরীক্ষায় না থাকলে আমরা থাকব কেন?’
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী বলেন, ‘আমরা গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে বের হতেই চাইছি। আমি এর আগেও এর পক্ষে ছিলাম না। তবে সরকার থেকে যেহেতু আমাকে থাকতে বলা হচ্ছে, তাই আমি চেষ্টা করছি তাদের বুঝিয়ে এই পদ্ধতি থেকে বের হতে।’
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. এনামউল্যা বলেন, ‘গুচ্ছে না থাকার বিষয়ে আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে সরকার যদি সব বিশ্ববিদ্যালয়কে গুচ্ছে রাখতে পারে, সেক্ষেত্রে আমরাও সিদ্ধান্ত করতে পারি।
অন্যদিকে গুচ্ছ থেকে বের হলে বড় বিশ্ববিদ্যালগুলোর সুবিধা হলেও বিপাকে পড়বে ছোট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তারা এক দিনে যেমন পাবে না ভালো শিক্ষার্থী, ঠিক তেমনি ভোগান্তিতে পড়তে হবে শিক্ষার্থীদেরও।
কারণ এত বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে যেমন আর্থিক খরচ বাড়বে, তেমনি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা সম্ভবও হবে না।’
সার্বিক বিষয়ে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক এবং মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল আজীম আখন্দ বলেন, ‘গুচ্ছ পরীক্ষার সম্ভাব্য তারিখ কিংবা কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছে থাকছে- এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। আমরা এখনো ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে পারিনি।’
ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, ‘গুচ্ছে না থাকলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে বাধ্য করার এক্তিয়ার আমাদের নেই। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় একটি নিজস্ব আইনে চলে। তারা তাদের আইন মেনে কাজ করবে।’
শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘আমি সব বিশ্ববিদ্যালয়কে গুচ্ছে থাকার অনুরোধ জানিয়ে তিনবার চিঠি দিয়েছি। মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিও একাধিকবার তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। কিন্তু এর পরও যদি কেউ গুচ্ছে থাকতে না চায়, তাহলে কী করার আছে?’
প্রসঙ্গত, করোনা মহামারির সময় যাতায়াত সমস্যার কথা বিবেচনা করে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ প্রদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয়।
ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েট ছাড়া বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়।
এর মধ্যে কৃষি ও কৃষি শিক্ষাপ্রধান সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কৃষি গুচ্ছ, তিনটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রকৌশল গুচ্ছ এবং ২৪টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে (জিএসটি) গত সেশন পর্যন্ত গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :