ঢাকা বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫

জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে কড়া বার্তা

হাসান আরিফ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৫, ২০২৫, ১০:০৯ এএম

জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা  ফেরাতে কড়া বার্তা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের জনপ্রশাসনে বড় ধরনের অস্থিরতা ও কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে। এরই মধ্যে আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্ব তীব্র হওয়ায় এই বিশৃঙ্খলা অবসানের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। 

পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়, সে জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর হবে বলেও বলা হয়েছে। বর্তমানে থম থমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. কামরুজ্জামান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সরকারের সর্বস্তরে শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯ এর ৩০-এ নং বিধিসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন ও বিধি যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। 

জানা গেছে, পদোন্নতি, পোস্টিং এবং গত সরকারের অধীনে বঞ্চিত হওয়া জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং অন্যদের নিয়োগের বিষয়গুলো বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আলোচনায় ছিল এবং অনেক সিদ্ধান্ত বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। 

সর্বশেষ বিতর্কটি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরে উঠেছে। এটি উত্থাপনের পর সিভিল সার্ভিসের বিভিন্ন ক্যাডারদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে।

প্রাথমিকভাবে সরকারি সেবা সহজীকরণের জন্য কমিশন গঠন করা হলেও এটি এখন কর্মকর্তাদের নিজস্ব স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে রোববার প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মকর্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এমনকি প্রতিবাদে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বাইরে কয়েকশ’ কর্মকর্তা বিরল বিক্ষোভ করেন। 

অন্যান্য ২৫টি পদের ক্যাডারের প্রতিনিধিত্বকারী ইন্টার-ক্যাডার ডিসপারিটি রেজ্যুলিউশন কাউন্সিল, মানববন্ধন ও সমাবেশসহ বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। 

খসড়া প্রস্তাবে উপসচিব পদের ৫০ শতাংশ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা এবং বাকি ৫০ শতাংশ অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তার মধ্যে বণ্টনের সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানে এসব পদের ৭৫ শতাংশ প্রশাসন ক্যাডারের এবং ২৫ শতাংশ অন্যান্য পদের জন্য সংরক্ষিত।

অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার এখনো প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারেনি। ঘন ঘন বদলি আদেশ বাতিল এবং পোস্টিংয়ে অসঙ্গতির মতো বিশৃঙ্খলার ঘটনাগুলো সমন্বয়ের অভাবেরই বহিঃপ্রকাশ বলে কর্মকর্তারা বলছেন। এর মধ্যে দীর্ঘদিন আগে যারা অবসরে গেছেন তাদের পদায়ন করে বর্তমান কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে বলেও তারা দাবি করছেন। 

এদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত সরকারের আমলে করা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করেছে। পরে এই সরকার ১৪টি মন্ত্রণালয়ে চুক্তিভিত্তিক সচিব নিয়োগ দেয়। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করে আবার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে।

তদবির করে কেউ কেউ বদলির আদেশ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। আবার সমন্বয়হীনতার কারণে বদলির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হচ্ছে সরকারকে। এতে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে। এসব কারণে প্রশাসনিক কার্যক্রম উল্লেখযোগ্যভাবে ধীর হয়ে পড়েছে।

এসব বিষয়ে কথা হয় রূপালী বাংলাদেশের প্রতিনিধির সঙ্গে। আলাপে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও সময় লাগতে পারে। 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ৫৩৭ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে। এর মধ্যে ২৩ জন সচিব, ১৭ জন গ্রেড-১, ১৩৫ জন অতিরিক্ত সচিব, ২২৮ জন যুগ্মসচিব এবং ১৩৪ জন উপসচিব রয়েছেন। এখন এসব পদোন্নতির মানদণ্ড নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব ও দুর্নীতির অভিযোগে উঠেছে। 

বিপরীতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাবেক সচিবসহ ১২ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে। আরও বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ফলে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা আরও বেড়েছে। তবে সংস্কার কমিটি আগেই ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ কর্মকর্তাকে সচিব পদে ১১৯ জনসহ বিভিন্ন পদে পদোন্নতির সুপারিশ করেছে।

এসব বিষয়ে প্রশাসনে চড়ম অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। তাই প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বিজ্ঞপ্তি জারি করে সরকার। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জনসেবা প্রদান এবং রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সরকারি কর্মচারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। 

সরকারি কর্মচারীদের সুশৃঙ্খল, দায়িত্বশীল ও পেশাদার আচরণের ওপর জনপ্রশাসনের সফলতা নির্ভর করে। সম্প্রতি বিভিন্ন পদমর্যাদার কিছু সরকারি কর্মচারীর বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট, মানববন্ধন, কলম বিরতিসহ বিবিধ কর্মসূচি পালনের কারণে সরকারি কর্মচারীদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

এতে আরও বলা হয়, ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সরকারের কোনো কোনো সিদ্ধান্ত, আদেশ বা সংস্কার কার্যক্রমের বাস্তবায়ন সম্পন্ন হওয়ার আগেই বিবেচ্য বিষয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিরূপ মন্তব্যসহ বিবৃতি প্রকাশ করা হচ্ছে যা সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ এর পরিপন্থি। 

সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ এর ৩০ এ নং বিধিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী- সরকারের অথবা কর্তৃপক্ষের কোনো সিদ্ধান্ত বা আদেশ পালনে জনসম্মুখে আপত্তি উত্থাপন করিতে বা যে কোনো প্রকারে বাধা প্রদান করিতে পারিবেন না অথবা অন্য কোনো ব্যক্তিকে তাহা করার জন্য উত্তেজিত বা প্ররোচিত করিতে পারিবেন না।

সরকারের বা কর্তৃপক্ষের কোনো সিদ্ধান্ত বা আদেশ সম্পর্কে জনসম্মুখে কোনো অসন্তুষ্টি বা বিরক্তি প্রকাশ করিতে অথবা অন্যকে তাহা করার জন্য প্ররোচিত করিতে অথবা কোনো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করিতে বা অন্যকে অংশগ্রহণ করার জন্য প্ররোচিত করিতে পারিবেন না। 

সরকার বা কর্তৃপক্ষের কোনো সিদ্ধান্ত বা আদেশ পরিবর্তন, বদলানো, সংশোধন বা বাতিলের জন্য অনুচিত প্রভাব বা চাপ প্রয়োগ করিতে পারিবেন না। সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে বা কোনো শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে যে কোনোভাবে অসন্তুষ্টি, ভুল বোঝাবুঝি বা বিদ্বেষের সৃষ্টি করিতে অথবা অন্যকে প্ররোচিত করিতে বা সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করিতে পারিবেন না।’

সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ এর যেকোনো বিধান লঙ্ঘন সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর আওতায় অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে। কোনো সরকারি কর্মচারী এ বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি অসদাচরণের দায়ে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আওতায় আসবেন। সরকারি কর্মচারীদের শৃঙ্খলাবহির্ভূত আচরণের বিষয়ে সরকারের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!