ঢাকা বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫

গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা

শাহীনুর ইসলাম শানু

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৫, ২০২৫, ১২:৫১ পিএম

গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তে নতুন করে গ্যাসের দাম দ্বিগুণের বেশি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। একই সঙ্গে ৯ জানুয়ারি শতাধিক পণ্য ও সেবায় শুল্কহার বাড়িয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। 

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যয়ের চাপ সামাল দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের নতুন সিদ্ধান্তে ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ বাড়ছে। যা দেশের অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। 

তবে ‘ভ্যাট বাড়ানোয় ভোক্তাদের তেমন অসুবিধা হবে না’ বলে জানিয়েছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার। তিনি মাদারীপুর সার্কিট হাউসে বলেন, ‘সরকারের রাজস্ব প্রয়োজন, প্রচুর ভর্তুকিও লাগে। এই অর্থ কোথাও না কোথাও থেকে সংগ্রহ করতে হয়। তাই কিছু পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। এতে কোনো অসুবিধা হবে না।’ 

তবে সরকারের এমন সিদ্ধান্তে গতকাল মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের বৈষম্যবিরোধী সংস্কার পরিষদ। জাতীয় প্রেসক্লাবে তারা বলেন, কঠিন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তার মধ্যে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝপথে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে সরকার। 

অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় ছাড়াই মূসক ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী হবে। তাই সবার সঙ্গে পরামর্শক্রমে এবং বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিআরসি) মাধ্যমে গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের আহ্বান জানান তারা।

ব্যবসায়ীরা বলেন, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির জন্যও সরকার উদ্যোগ নিয়েছে, যা কোনোভাবেই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। হঠাৎ করারোপ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব দেশের সার্বিক জাতীয় অর্থনীতির ওপর প্রচণ্ডভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। একই সঙ্গে সরকারের এমন সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও সাধারণ ভোক্তারা। 

অন্তর্বর্তী সরকারের এনবিআর যে অধ্যাদেশ জারি করেছে, তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি, ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই), ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি), বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি ও টেলিকনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টিক্যাব)। এমন সময়ে সরকারের এ সিদ্ধান্তকে বিপজ্জনক বলেছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। 

উদ্বেগ প্রকাশ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফিকি জানিয়েছে, দেশের মোট এফডিআই’র ৯০ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে ফিকি। এর মধ্যে রয়েছে তামাক, টেলিযোগাযোগ, জ্বালানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ উচ্চ-রাজস্ব প্রদানকারী খাতগুলো। 

এসব খাত দেশের মোট অভ্যন্তরীণ রাজস্বের প্রায় ৩০ শতাংশ অবদান রাখে। ভ্যাট, শুল্ক এবং অন্যান্য কর বৃদ্ধির সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত ভোক্তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলার পাশাপাশি দেশে ব্যবসা পরিচালনার খরচ বাড়বে। এই পদক্ষেপ কর রাজস্ব প্রদানকারী এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকারী ব্যবসাগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতা ও কার্যক্রম পরিচালনার সক্ষমতাকে হুমকির মুখে ফেলবে।

ফিকি জানায়, পর্যাপ্ত গবেষণা বা অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই নীতি প্রণয়ন বিনিয়োগকারীদের আস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং ভবিষ্যতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ধারাকে বাধাগ্রস্ত করবে।

প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। জ্বালানি বিভাগের এমন প্রস্তাবকে দেশের শিল্প খাতের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা। 

সরকারকে সুপারিশ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলেন, দেশে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো অনেক সিস্টেম লস করছে। বিশেষ করে তিতাস গ্যাসের সিস্টেম লস বন্ধ হলে ১২৫ থেকে ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস অপচয় বন্ধ করা সম্ভব। তিতাসের সিস্টেম লস ঠেকানোর দিকে সরকার দৃষ্টি দিলেই ৮০ শতাংশ উত্তরণ সম্ভব বলেন তারা।

তিতাসের সিস্টেম লস ঠেকানোর দিকে না তাকিয়ে ‘গ্যাসের মূল্য অযৌক্তিভাবে বৃদ্ধি করা হচ্ছে, এ জন্য সরকারপ্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ’ করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান ও ইয়ুথ গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম হায়দার।

তিনি রূপালী বাংলাদেশ বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩ সালে গ্যাসের দাম ১৫ থেকে ৩০ টাকা করেন। এতেই প্রডাক্ট কস্ট বেড়েছে। তাতেই আমাদের কষ্ট বাড়ে। এই ৩০ টাকা দিতে গিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। 

এমনিতেই গ্যাসের তীব্র সংকট। তারপরে এই মূল্য ৭০ টাকা হলে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হবে। নতুন করে এই মূল্য অযৌক্তিভাবে বৃদ্ধি করা হচ্ছে। আইএমএফকে সামাল দিতে গিয়ে ঋণ পাবে কিন্তু ব্যবসা টিকবে না।’

সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সঙ্গে রিভিউ আলোচনায় বসতে পারে সরকার। কম্পোমাইজ করে কিছু করা যেতে পারে। নতুবা দাম ডাবল হলে প্রডাক্ট কস্ট আরও বাড়বে। অনেক কোম্পানি বন্ধ হবে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে এবং কর্মসংস্থান হারাবে অজস্র মানুষ। তা মূলত ভালো লক্ষণ নয়। এমন কিছু হলে মনে করতে হবে এই সরকার দেশের স্বার্থে কাজ করছে না।’

এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচন সম্পর্কে আবুল কাশেম হায়দার বলেন, ‘এখানে দ্রুত নির্বাচন দরকার। উপদেষ্টার কাছে আমরা দাবি করেছি। তিনি ৩৯ জনের একটি তালিকা তৈরি করে আমাদের বৈঠকের ডাক দিলেন, সেই তালিকায় আওয়ামী লীগের ৩০ জন দেখে বয়কট করেছি। 

ব্যবসায়ীদের কোনো সংগঠনে নির্বাচিত কমিটি নেই। যার কারণে সরকারে এমন সিদ্ধান্তের কেউ প্রতিবাদ করতে পারছে না।’  

এদিকে, গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে জ্বালানি বিভাগের অনুমোদন নিয়ে গত সোমবার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে প্রস্তাব দিয়েছে পেট্রোবাংলা। 

৩১ ডিসেম্বর দেওয়া প্রস্তাবটি রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানিকে চিঠি হিসেবে পাঠিয়েছে পেট্রোবাংলা। সর্বশেষ ২০২২ সালে গণশুনানির মাধ্যমে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছিল বিইআরসি। 

গ্যাস সংকটে উৎপাদন কমের বিষয়ে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরীর (পারভেজ) বলেন, ‘আমাদের উৎপাদন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমেছে। 

অন্যদিক দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলমান। সবকিছু মিলিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান ভালোভাবে চলছে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকাই চ্যালেঞ্জ।’ ইভেন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি আরও বলেন, ‘আইএমএফ’র পরামর্শে নতুন করে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা হচ্ছে। নুতন করে মূসক ও কর বৃদ্ধি করা অশুভ দিক বহন করছে’ বলেন তিনি।

জ্বালানি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, প্রতিদিন দেশে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তবে সরবরাহ করা হয় গড়ে প্রায় ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে দেশীয় কূপ থেকে ১ হাজার ৯০০ মিলিয়ন এবং আমদানি করা এলএনজি থেকে ৮০০ থেকে ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যায়।

পেট্রোবাংলা দেশের বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র থেকে ভিন্ন ভিন্ন দামে যে গ্যাস কেনে, তাতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের গড় দাম দাঁড়ায় ৬ টাকা ৭ পয়সা। অন্যদিকে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজির দাম পড়ে ৬৫ থেকে ৭১ টাকা পর্যন্ত। দেশীয় এবং আমদানি করা এলএনজি মিলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্য ছিল ২৪.৩৮ টাকা, যা পাইকারি দামে বিক্রি করা হয় ২২.৮৭ টাকায়। 
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!