ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫

তিনি ছিলেন অলিখিত এক গভর্নর

রহিম শেখ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৬, ২০২৫, ০৮:১৫ এএম

তিনি ছিলেন অলিখিত এক গভর্নর

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর শুরু হয় ব্যাংক দখল ও লুটপাটের ধারা। রিজার্ভ কেলেঙ্কারিতে ড. আতিউর রহমান গভর্নর পদ ত্যাগ করলে সবকিছুরই খবরদারি শুরু করেন তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার (এস কে) সুর চৌধুরী।

 ডেপুটি গভর্নর পদে তার মেয়াদ বাড়ানো হয় তিন দফায়। এস আলম ও সালমান এফ রহমানের বিশ্বস্ত ডেপুটি গভর্নর হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত ছিলেন সুর চৌধুরী। ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের অলিখিত গভর্নর, যার কাছে অনিয়ম-দুর্নীতির কোনো সংজ্ঞাই ছিল না। 

তিনি যেকোনো অনিয়মকেই আইনি কাঠামোয় নিয়ে আসতে পারঙ্গম ছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী তথা অলিগার্কের চাপে অবসরে গিয়ে হয়েছিলেন ব্যাংক সংস্কার উপদেষ্টা। দেশের অন্তত চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান পি কে হালদারের দখলে নিতে সহায়তা করেছিলেন এস কে সুর চৌধুরী। গড়েছেন ‘অবৈধ’ সম্পদ। অভিযোগ রয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের।

আওয়ামী লীগ শাসনামলের শুরুতে ২০০৯ সালের ১ মে গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ড. আতিউর রহমান। দায়িত্বের প্রথম মেয়াদে তেমন কোনো অভিযোগ না থাকলেও দ্বিতীয় মেয়াদে সমালোচনার মুখে পড়েন এই অর্থনীতিবিদ। 

সর্বশেষ ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্ভারে ঢুকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি করে নেয় হ্যাকাররা। ভয়াবহ ওই ঘটনা সরকারের কাছ থেকে ২৪ দিন লুকিয়ে রাখেন গভর্নর। এর জেরে ওই বছরের ১৫ মার্চ গভর্নর আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন। 

আতিউর রহমান পদত্যাগ করায় ২০১৬ সালের ১৬ মার্চ দেশের ১১তম গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান ফজলে কবির। সালমান এফ রহমান ও সাইফুল আলমের (এস আলম) পরামর্শেই তাকে সে সময় গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। 

ওই সময় তার ডান হাত হিসেবে সমস্ত নির্দেশনা দিতেন তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী। এরপর এস আলমকে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকসহ অন্তত পাঁচ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে নিতে সহায়তা করেন। 

ব্যাংক দখল এবং সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা বের করার সুযোগ করে দিতে একের পর এক নীতি পরিবর্তন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের অফসাইট সুপার ভিশন, ব্যাংকিং রেগুলেশন, বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি এবং পরিদর্শন বিভাগগুলো অন্তত অর্ধশত সার্কুলার পরিবর্তন করেছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই বিষয়ে সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন নীতিমালা করতেও দেখা গেছে। দেশের বড় গ্রুপগুলোকে সুবিধা দিতে অন্তত ৩১টি সার্কুলারের নির্দেশনা দেওয়া হয়। 

এস আলম, বেক্সিমকোসহ বড় গ্রুপগুলোকে বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার কারণে ২০২০ সালে সর্বসম্মতিক্রমে দ্বিতীয় মেয়াদে ফের গভর্নর হন ফজলে কবির। এক্ষেত্রে তাকে নিয়োগ দিতে গভর্নরের সর্বোচ্চ বয়সসীমায়ও পরিবর্তন আনা হয়। 

ডেপুটি গভর্নর পদে এস কে সুর চৌধুরীর মেয়াদ বাড়ানো হয় তিন দফায়। এস আলম ও সালমান এফ রহমানের বিশ্বস্ত ডেপুটি গভর্নর হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত ছিলেন সুর চৌধুরী। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী তথা অলিগার্কের চাপে অবসরে গিয়ে হয়েছিলেন ব্যাংক সংস্কার উপদেষ্টা। 

চার দশক বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করা একসময়ের প্রবল প্রতাপশালী এস কে সুর চৌধুরীকে শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যেতে হয়েছে। সাধারণ কোনো অভিযোগে নয়, প্রশান্ত কুমার হালদারকে (পি কে হালদার) অর্থ লুণ্ঠনে সহায়তার পাশাপাশি অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। 

রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকা থেকে এস কে সুর চৌধুরীকে গত মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসে তিনিই প্রথম কর্মকর্তা, যিনি ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির শীর্ষপর্যায়ে দায়িত্ব পালনের পর গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দি হলেন। ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন গতকাল তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

এস কে সুর চৌধুরীর গ্রেপ্তারের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদেরই একজন বলেন, ‘সহকারী পরিচালক থেকে শুরু করে যুগ্ম পরিচালক পদ পর্যন্ত এস কে সুর চৌধুরীর কর্মকাণ্ড খুব কাছ থেকে দেখেছি। তার কাছে অনিয়ম-দুর্নীতির কোনো সংজ্ঞা ছিল না। তিনি যেকোনো অনিয়মকেই আইনি কাঠামোয় নিয়ে আসতে পারঙ্গম ছিলেন। তার অনৈতিক নির্দেশ না মানায় শাস্তির মুখেও পড়তে হয়েছে।’ 

এস কে সুর চৌধুরীকে ২০১২ সালের ২৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার। ডেপুটি গভর্নর হওয়ার আগে তিনি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির প্রভাবশালী নির্বাহী পরিচালক (ইডি) ছিলেন। 

ডেপুটি গভর্নর পদে তার মেয়াদ বাড়ানো হয় তিন দফায়। ৬২ বছরের বয়সসীমা শেষ হলে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে এস কে সুর চৌধুরী ওই পদ থেকে অবসরে যান। এর পরও তাকে আরও দুই বছরের জন্য ব্যাংক সংস্কার উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। 

মূলত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী তথা অলিগার্কের চাপেই এই নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। ২০১৫ সাল-পরবর্তী চার বছরে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিংসহ অন্তত চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) দখলে নিয়ে লুণ্ঠন করেছিলেন পি কে হালদার। 

দখলে নেওয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশের পুঁজিবাজার থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দখলে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাকে সহায়তা করেছিলেন তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী। লুণ্ঠনের শিকার সেই চার আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রাখা আমানত অনেক দিন ধরেই ফেরত পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা। 

ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল হক ২০২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছিলেন, ‘পি কে হালদারের ক্ষমতার উৎস ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী ও নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম। 

পি কে হালদার বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সুবিধা ও মূল্যবান উপঢৌকন দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষপর্যায়ের ওই দুই কর্মকর্তাকে বশে রেখে দুর্নীতির মাধ্যমে অবাধে অর্থ লোপাট করেছেন।’ 

পি কে হালদারের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে নাম আসায় ২০২২ সালে এস কে সুরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। ওই বছরের ২৯ মার্চ তাকে তলবও করা হয়। আর চলতি বছরের আগস্টে এস কে সুর চৌধুরী, তার স্ত্রী সুপর্ণা সুর চৌধুরী ও মেয়ে নন্দিতা সুর চৌধুরীর আয়কর নথি জব্দের আদেশ দেন আদালত। 

আইনগত অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষে গত ২৩ ডিসেম্বর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, সম্পদের তথ্য গোপন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে সুর চৌধুরীসহ তার স্ত্রী-কন্যার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। 
দেশের অর্থ পাচার ঠেকানোর দায়িত্বে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। 

সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তা মাসুদ বিশ্বাস এবং এস কে সুর চৌধুরী এস আলম, সালমান এফ রহমানসহ শীর্ষ ব্যবসায়ীদের দ্বারা সুবিধাভোগী। তাদের সুবিধা দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক শ কোটি টাকা। তাদের বিরুদ্ধে উঠেছে অর্থ পাচারে সহায়তা ও ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ। 

এমনকি পাচার ঠেকানোর দায়িত্বে থাকা সংস্থাটির কর্মকর্তারা উল্টো অর্থ পাচারে সহায়তা করেছেন বলেও অভিযোগ আছে। বেক্সিমকো, নাসাসহ রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন প্রভাবশালী গ্রুপের অর্থ পাচারের সময় সম্পূর্ণ চুপ ছিল বিএফআইইউ। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এক প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘ব্যাংকিংয়ের মূল কথা হলো সততা ও আস্থা। আস্থার কারণেই মানুষ তার কষ্টার্জিত অর্থ ব্যাংকে জমা রাখে। আমানতকারীদের আস্থা অটুট রাখার দায়িত্ব হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। 

কিন্তু আমরা দেখছি, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরের মতো সর্বোচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিও দুদকের মামলায় গ্রেপ্তার হচ্ছেন। এটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি দেশের জন্যও লজ্জাজনক ঘটনা।’
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!