নারায়ণগঞ্জের গডফাদার শামীম ওসমান। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এই সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের গত দেড় দশকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ঘনিষ্ট সহচর ও দোসর ছিলেন। নারায়ণগঞ্জ ও আশপাশের এলাকার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার ছিল তার।
শামীম ওসমান বাহিনীর অস্ত্রবাজি থেকে দখল-হামলা ছিল প্রকাশ্য। তার হুমকি-ধমকি ছিল সর্বত্র। সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে প্রশাসন সবক্ষেত্রেই একক নিয়ন্ত্রণ ছিল শামীম পরিবারের। দেশজুড়ে গডফাদার পরিচয় পাওয়া এই নেতার অপরাধ ও অপকর্মের ফিরিস্তি শেষ করা মুশকিল।
জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে সশরীরে নিজের বাহিনী নিয়ে অস্ত্রহাতে গুলি চালান। নারায়ণগঞ্জে যত ডিসি-এসপি যেতেন তাদের সরাসরি হুমকি দিতেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিতর্কিত গডফাদার শামীম ওসমান পরিবারসহ আত্মগোপনে রয়েছেন।
সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই বিকেলে শহরের চাষাঢ়া বঙ্গবন্ধু সড়কে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা মিছিল বের করেন।
আর ওই মিছিলে শামীম ওসমান ও তার কয়েক শতাধিক অনুসারী আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে শহরের চাষাঢ়া এলাকা থেকে বঙ্গবন্ধু সড়কে শহরের ২ নম্বর রেলগেট এলাকার দিকে ধাওয়া দিয়েছিলেন।
সেখানে শামীম ওসমানের শ্যালক তানভীর আহমেদ (টিটু) গুলি ছোড়েন। শামীম ওসমানের আত্মীয় (অয়ন ওসমানের শ্বশুর) ফয়েজ উদ্দিন (লাভলু), তার ছেলে মিনহাজুল ইসলাম ও শীতল পরিবহনের বাসের পরিচালক অনুপ কুমার সাহা, ১২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নিয়াজুল ইসলামকে দেখা গিয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতাদের মুখে শোনা গিয়েছিল এই অস্ত্রের মহড়ার কথা কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে শামীম ওসমান গর্ব করে বলেছেন।
নারায়ণগঞ্জের পরিবহন খাতে একছত্র আধিপত্য ছিল শামীম ওসমানের। নারায়ণগঞ্জ থেকে যাতায়াতকারী সব পরিবহননেই চাঁদা দিতে হতো শামীম ওসমানকে। পরিবহন সুবিধা দেওয়ার জন্য ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ট্রেন চলাচলকেও অনেক সময় বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে।
দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির পাশাপাশি গডফাদার পরিচয়ে নিজস্ব অস্ত্রধারী বাহিনী দিয়ে পুরো জেলায় সন্ত্রাসের সাম্ম্রাজ্য গড়ে তোলেন। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবৈধ সম্পদ পাচার করেছেন।
এদিকে, প্রায় ২০০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, তার স্ত্রী সালমা ওসমান ও তানভীর আহমেদকে আসামি করে মামলা দায়েরের অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
গতকাল বুধবার এক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান দুদকের মহাপরিচালক প্রতিরোধ মো. আক্তার হোসেন। তিনি বলেন, কে টেলিকমিউনিকেশন্স লিমিটেডের মাধ্যমে তারা এ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন। আগামীকালের মধ্যেই মামলাটি দায়ের করা হবে বলে জানান তিনি।
দুদক মহাপরিচালক আক্তার হোসেন বলেন, দুদকের অনুসন্ধানের সময় বিটিআরসি থেকে পাওয়া রেকর্ডপত্র ও তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, কে টেলিকমিউনিকেশন্স লিমিটেডের আন্তর্জাতিক কিংবা বৈদেশিক ইনকামিং কল আনা তথা সেবা রপ্তানির জন্য বিটিআরসি থেকে ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) লাইসেন্সপ্রাপ্ত একটি প্রতিষ্ঠান।
যার চেয়ারম্যান সালমা ওসমান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ। আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল বা সেবা রপ্তানি বাবদ রাষ্ট্রের স্বার্থে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং তার সংশ্লেষে রেভিনিউ সংগ্রহসংক্রান্ত সরকারি কর্তব্য সম্পাদনে কমিশন আকারে পারিশ্রমিক প্রাপ্তি কিংবা রেভেনিউ শেয়ারিং প্রাপ্তি সাপেক্ষে বিটিআরসি থেকে আইজিডব্লিউ লাইসেন্স পাওয়ার মাধ্যমে কে টেলিকমিউনিকেশন্স লিমিটেড আইজিডব্লিউ অপারেটর হিসেবে দায়িত্ব পায়।
সে অনুযায়ী আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল বা সেবা রপ্তানি সংশ্লেষে তার মূল্য বাবদ অর্জিত মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ওই আইজিডব্লিউ অপারেটরের ব্যাংকিং চ্যানেলে ফরেন কারেন্সি (এফসি) অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশে নিয়ে আসার বাধ্য বাধকতা রয়েছে। কিন্তু তারা সেই অর্থে দেশে না এনে মানিলন্ডারিং আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
আক্তার হোসেন জানান, দুদকের অনুসন্ধানের সময় ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে বা আইজিডব্লিউ অপারেটরকে টেলিকমিউনিকেশন্স লিমিটেডের আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল আনয়ন কিংবা সেবা রপ্তানি এবং তার সংশ্লেষে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশে আনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, আইজিডব্লিউ অপারেট ’১২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ’২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত (১৪ মাস) সময়ে ৯১ কোটি ৫০ লাখ ৯২ হাজার ৮৬৫ কল মিনিট সেবা রপ্তানি করে।
রপ্তানি করা এ সেবার মূল্য ২ কোটি ৭৪ লাখ ৫২ হাজার ৭৮৬ মার্কিন ডলার। ওই বৈদেশিক মুদ্রা আইন অনুযায়ী ফরেন রেমিট্যান্স হিসেবে বাংলাদেশে নিয়ে আসার বাধ্য বাধকতা রয়েছে।
দুদক কর্মকর্তা আরও জানান, নারায়নগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি শামীম ওসমানের সহযোগিতায় চেয়ারম্যান হিসেবে সালমা ওসমান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তানভীর আহমেদ দায়িত্বে থাকা অবস্থায় উল্লিখিত আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বার্থ থাকা সত্ত্বেও বিদ্যমান মানিলন্ডারিং আইন অমান্য করে ১৯৩ কোটি ৯১ লাখ ১৮ হাজার ৬০৩ টাকা মূল্যের ২ কোটি ৫১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৫৮ মার্কিন ডলার পাচার কিংবা মানিলন্ডারিং করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় পাচারের অপরাধ হয়েছে।
গডফাদার যাত্রা শুরু যেভাবে: শামীম ওসমান প্রায় সময়ই বিভিন্ন সভা-সমাবেশে প্রকাশ্যেই অহংকার করে নিজের অস্ত্রবাজিসহ নানা অপকর্মের তুলে ধরতেন। সেইসঙ্গে বিভিন্ন মহলকে তার এসব অপকর্মকে হাসিমুখে স্বীকার করে নিতে হতো।
বিভিন্নভাবে তিনি নিজেকে একজন গডফাদার হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করে তুলেন। এই গডফাদারের তকমাকে বেশ উপভোগ করতেন তিনি। ২০০০ সালের ১৬ এপ্রিল সরকারি তোলারাম কলেজে জাহানারা ইমাম নামের একটি ভবন নির্মাণের উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে কলেজ প্রাঙ্গণে মুক্তমঞ্চের সমাবেশ থেকে রাজাকার, স্বাধীনতা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করা হয়।
সেদিন সমাবেশ শেষে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে নারায়ণগঞ্জে গোলাম আযম, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়। এরপরেই মূলত ওই এলাকার নামকরণ হয় সাইনবোর্ড। ওই সমাবেশের তিন দিন পর মুন্সীগঞ্জে একটি কর্মসূচি ছিল নারায়ণগঞ্জ বদলে গিয়েছিল। নতুন এক অধ্যায়ের সূচনার কারণেই পরবর্তীতে ‘গডফাদার’ উপাধি দেওয়া হয় তাকে।
বিতর্কিত যত মন্তব্য: ’২০ সালের ১ মার্চ পুলিশ লাইন্সে জেলা পুলিশের আয়োজনে ‘পুলিশ মেমোরিয়াল ডে-২০’ আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে শামীম ওসমান বলেছিলেন, ‘২০০১ সালের আগে পুরো জেলা পুলিশের ফোর্সের কাছে যত অস্ত্র ছিল, আমার কাছে এর চেয়ে বেশি অস্ত্র ছিল। মিথ্যা কথা বলে লাভ নেই।
কিন্তু আজকে আমার গাড়িতেও অস্ত্র আছে কি না, আমি জানি না।’ পরবর্তীতে তার এই বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন মহলের বেশ টনক নড়েছিল। একই বছর ২৬ ডিসেম্বর সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের হুঁশিয়ারি দেওয়া এক শ্রেণির মাওলানাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমাদেরকে আপনারা ইসলাম বুঝান আমরা কোরআন পড়ি না? ২২ বছর ধরে তাহাজ্জুদ ছাড়ি নাই। প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ রাকাত নফল নামাজ বেশি পড়ি আল্লাহর রহমতে। দুবেলা কোরআন শরিফ পড়ি’।
স্ত্রী-পুত্রের চাঁদাবাজি: নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় শামীম ওসমানের অন্যতম একজন খলিফা ছিলেন সাবেক কাউন্সিলর মতিউর রহমান মতি। এই মতির মাধ্যমে তিনি সিদ্ধিরগঞ্জের বিভিন্ন শিল্প কারখানা ও তেল সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করতেন।
বিশেষ করে আদমজী ইপিজেডের নিয়ন্ত্রক ছিলেন মতি। এই এলাকা থেকে যত টাকা আসত তার থেকে ভাগ নিতেন তার স্ত্রী সালমা ওসমান লিপি। এদিকে শহরের মাসদাইর এলাকার নিয়ন্ত্রক ছিলেন তার ছেলে অয়ন ওসমান।
ছাত্রলীগের মহানগর সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদ ও জেলা সাবেক সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম রাফেল অয়ন ওসমানের খলিফারূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তারা অয়ন ওসমানের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করতেন। সেই সাথে এসব জায়গা থেকে টাকার ভাগ নিতেন অয়ন ওসমান।
খুনি ওসমান পরিবার: আলোচিত ত্বকী হত্যাসহ একাধিক খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত ছিলেন ওসমান পরিবার। ত্বকী হত্যায় সরাসরি ছিল ভাতিজা আজমেরী ওসমান। ’১৩ সালের ৬ মার্চ চাষাঢ়ায় সুধীজন পাঠাগারে যাওয়ার পথে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে অপহরণ করা হয়।
৮ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদিনী পোতাশ্রয় থেকে তার লাশ পাওয়া যায়। এ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া আজমেরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী সুলতান শওকত ভ্রমর ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
এতে সে জানায়, শহরের কলেজ রোডের টর্চার সেলে আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বেই ত্বকীকে খুন করা হয়। ২০১৩ সালের নভেম্বরে ১ নম্বর বাবুরাইল থেকে নিখোঁজ হন নাট্যকার মামুনুর রশীদের আত্মীয় আসিফ। আজমেরী বাহিনী তাকে গুম করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :