ঢাকা শনিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫

সাবেক এমপি জিল্লুরের প্রতারণার ফাঁদ

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৮, ২০২৫, ১০:০৮ এএম

সাবেক এমপি জিল্লুরের প্রতারণার ফাঁদ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

মৌলভীবাজার-৩ (রাজনগর-মৌলভীবাজার সদর) আসনের সাবেক এমপি ওলিলা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের জেলা কমিটির উপদেষ্টা মো. জিল্লুর রহমানের বিরুদ্ধে দেড়শ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়া ও মৌলভীবাজারের একটি কোম্পানি জোরজবরদস্তি করে দখল নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। 

এ ছাড়া সাবেক আওয়ামী সরকারের এমপি হওয়ার সুবাদে অসংখ্য ব্যবসায়ীকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে তাদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা লোপাট ও আত্মসাৎ করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। সাবেক এমপি জিল্লুরের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে অনেক মানুষ আজ নিঃস্ব বলে জানা গেছে। 

অভিযোগ রয়েছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পর সাবেক এমপি জিল্লুর আত্মগোপনে থেকে ওলিলা গ্রুপের নিজস্ব অফিস নিকেতনে যোগাযোগ রেখেছেন। জিল্লুরের এসব অপকর্মে সহযোগিতা করছেন গ্রুপে নামেমাত্র নিয়োগ দেওয়া একজন মেজর ও উত্তর বিএনপির এক নেতা। মূলত তাদের ছত্রছায়ায় দেশদ্রোহী ষড়যন্ত্র ও নানা ধরনের অপকর্ম চলমান রেখেছেন আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট আমলের সাবেক এই এমপি।

সূত্র জানায়, মৌলভীবাজার-৩ আসনসহ অত্র এলাকায় একক আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন সাবেক এমপি জিল্লুর। এমনকি আওয়ামী লীগের অনেক যোগ্য লোক থাকার পরেও সবাইকে পেছনে ফেলে কৌশলে বাগিয়ে নিয়েছিলেন এমপি পদও। 

পুলিশি সূত্র জানায়, প্রতারণা ও ফ্যাসিবাদে যুক্ত থাকায় জিল্লুরের নামে দেশবিরোধী কয়েকটি মামলা হয়। এরপর থেকে সে আত্মগোপনে চলে যায়। তবে ইতিমধ্যে জিল্লুর দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট ও পাচার করে ফেলে। 

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর ও গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, জিল্লুর রহমানের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও খুনের অভিযোগ রয়েছে। এখন তাকে খোঁজা হচ্ছে। তার অপকর্মের সঙ্গে কেউ জড়িত থাকলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।

কর্মকর্তারা জানান, সাবেক এমপি জিল্লুরের প্রতারণার ফাঁদ ছিল অন্যরকম। সে দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা লোপাট ও পাচারে যুক্ত। সবকিছু তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

এদিকে গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, এমপি জিল্লুর ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতা ও সেনাবাহিনীর সাবেক এক মেজরের নাম বিক্রি করে এখনো অপরাধ করে যাচ্ছেন। এই তথ্য রূপালী বাংলাদেশের কাছে এসেছে। 

জানা যায়, সাবেক এমপি জিল্লুর রহমান একজন বেকার ভবঘুরে থেকে প্রতারণা করে এমপি হন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি জায়গা ও কয়েকটা কোম্পানি দখল করে নেন। 

সম্প্রতি এক অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা লোপাট ও বিভিন্ন কোম্পানি দখল করার অভিযোগের ডকুমেন্ট রূপালী বাংলাদেশের হাতে এসেছে। 

অভিযোগ রয়েছে, তার প্রতারণা সম্পর্কে জানা যায়, পছন্দ হলে তিনি প্রথমে কোম্পানি কেনার কথা বলে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে চুক্তি করেন, পরে সেটা দখলে নিয়ে উল্টো ওই কোম্পানির মালিকের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে জেলে পাঠান। 

এভাবে একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে প্রতারণা করেছেন ফ্যাসিস্ট সিন্ডিকেটের দোসর জিল্লুর। এ ছাড়া বিগত শেখ হাসিনা সরকারের সময় দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন। ৫ আগস্টের পর তিনি তার অফিসে একজন মেজরকে বসিয়ে ভয়ভীতি দেখান। 

গত ১৪ জানুয়ারি মঙ্গলবার ওলিলা গ্রুপের নিকেতনের অফিসে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল গেলে উল্টো রাজনৈতিক ভয় দেখিয়ে একটি মিডিয়াকে ব্যবহার করেন ওই অফিসের কর্মকর্তা পরিচয় দেওয়া মেজর একেএম রফিক হক। সাবেক এমপির প্রতারণার বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মেজর একেএম রফিক হক জানান, আমি ৫ আগস্টের পরে এখানে এসেছি অনেক কিছু জানি, আবার অনেক কিছু জানি না। 

জানা যায়, নিজের ব্যবসায়িক প্রভাব বাড়াতে ২০২২ সালে ওলিলা গ্রুপের এমডি জিল্লুর রহমান নিজের ছোট ভাই আলাউর রহমানকে বিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার-২ আবু জাফর রাজুর ছোট বোন ফাহিমা আক্তার সঙ্গে। 

রাজু পার্শ্ববর্তী কুলাউড়া উপজেলার সাবেক এমপি ও কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি মরহুম আব্দুল জব্বারের ছেলে। রাজুর আরেক ভাই কুলাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আ স ম কামরুল ইসলাম। এরপর আর কে ঠেকায় প্রতারক জিল্লুর রহমানকে।

জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রভাবে শ্রীমঙ্গলে বিশাল এলাকাজুড়ে প্রতিষ্ঠা করেন ওলিলা গ্রুপের গ্লাস ফ্যাক্টরি। স্থানীয়রা যাতে কোনোভাবে ডিস্টার্ব না করে সেজন্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নিয়ে গিয়েছিলেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক ফ্যাসিস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে।

আসাদুজ্জামান খান কামালের ঘনিষ্ঠজন পরিচয় দিয়ে মৌলভীবাজার ও রাজনগর এলাকায় একচ্ছত্র অধিপত্য বিস্তার করেছিলেন জিল্লুর। সে সময় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদেরও নানাভাবে হয়রানি করেছেন তিনি। 

জিল্লুর তার এক ভাই জিয়াউর রহমানকে বিনা ভোটে বানিয়েছেন জেলা পরিষদের সদস্য আর আরেক ভাই আতাউর রহমানকে বানিয়েছেন স্থানীয় কামারচাক ইউপির চেয়ারম্যান। আতাউর রহমানের বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগের আরেক প্রভাবশালী প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু ভোটের দিন তিনি মাঠে দাঁড়াতেই পারেননি। নিজস্ব বাহিনী আর পুলিশকে নিয়ে জোরপূর্বক কেন্দ্র দখল করে জাল ভোটে ভাইকে চেয়ারম্যান বানান জিল্লুর। 

আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য পদও বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে জিল্লুরের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় অনেক প্রভাবশালী নেতা থাকা সত্ত্বেও টাকার জোরে ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে পান আওয়ামী লীগের টিকিট। তার বিরুদ্ধে কয়েকজন বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচন করতে চাইলে টাকার জোরে তাদের বসিয়ে দেন। 

কথিত রয়েছে, ওই নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর মন্ত্রী কিংবা প্রতিমন্ত্রী পদ পাওয়ার জন্য শতকোটি টাকার কন্ট্রাক্টও করেছিলেন তিনি। ওই সময় এমপি হওয়া পর্যন্ত জিল্লুর প্রায় ৭৫ কোটি টাকা খরচ করেছেন বলে তার ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন। কিন্তু শেষমেশ মন্ত্রী হওয়ার সাধ পূরণ হয়নি তার।

অন্যদিকে গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, গুলশান থানা এলাকার মধ্যে আত্মগোপনে ঘোরাফেরা করছেন সাবেক এমপি জিল্লুর রহমান। তবে তাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে গুলশান থানার ওসি (অপারেশন) আরাফাতুল হক খান রূপালী বাংলাদেশকে জানান, যদি তার নামে মামলা থাকে তাহলে পুলিশ খোঁজখবর নিয়ে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেবে। 
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!