ঢাকা রবিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫

শক্তির আওয়াজ দিচ্ছে ছাত্রদল!

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৯, ২০২৫, ০৯:৪৯ এএম

শক্তির আওয়াজ দিচ্ছে ছাত্রদল!

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

নিষিদ্ধ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের যথাযথ বিচারসহ কয়েকটি দাবিতে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। গতকাল শনিবার বিকেল ৩টায় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করা হয়।

 এ সময় ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, আওয়ামী সিনেট-সিন্ডিকেট, ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’। ছাত্রদলের এমন কর্মসূচি রাজনৈতিক মাঠে শক্তির আওয়াজ দিচ্ছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তাদের দাবি-সম্প্রতি ছাত্রদলের সঙ্গে অন্যদের দ্বন্দ্বের বিষয়টি অনেকের চোখে পড়েছে। 

এরপর থেকেই ছাত্রদল রাজপথে সজাগ থাকতে চেষ্টা করছে। যার কারণে তারা ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে শক্তির আওয়াজ দিচ্ছে যেটা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে বিতর্ক সম্পর্কে ভাটা পড়েছে ছাত্রদল ও শিবিরের মধ্যে! যেটা অনেক ক্ষেত্রে পরিষ্কার।

এদিকে সরেজমিনে দেখা গেছে, ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া নেতাকর্মীরা ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। 

এ সময় নেতাকর্মীদের হাতে ‘জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড’, ‘সে নো টু মবোক্রেসি’, ‘স্টপ মব জাস্টিস’, ‘ক্রিমিনাল হ্যাভ নো প্লেস ইন ক্যাম্পাস’, ‘আওয়ামী সিনেট-সিন্ডিকেট, ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’ ইত্যাদি স্লোগান সংবলিত প্ল্যাকার্ড দেখা গেছে। 

এর আগে, গত শুক্রবার ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক (সহসভাপতি পদমর্যাদা) মো. জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রদলের এই ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির তথ্য জানানো হয়। ছাত্রদলের অনুষ্ঠিত ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিটি শাহবাগ, টিএসসি হয়ে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। 

পদযাত্রায় ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছিরসহ অন্যান্য নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। জানা যায়, ছাত্রদলের অন্য দাবির মধ্যে ছিল, ‘ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের’ সাজা নিশ্চিত করা, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে ভূমিকা পালনকারীদের তদন্তসাপেক্ষে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের যথাযথ বিচার ও সন্ত্রাসীদের সাজা নিশ্চিত করা, একইসঙ্গে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে ভূমিকা পালনকারীদের তদন্তসাপেক্ষে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করা হয়। আমরা ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে সজাগ আছি। 

এ বিষয়ে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির বলেন, আমাদের সংগঠনের নেতাকর্মীদের বলা হয়েছে দোসরদের বিরুদ্ধে সবাই যাতে সতর্ক থাকে। কেউ যাতে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করতে না পারে। 

এদিকে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের নির্দেশে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর নতুন করে আলোচনা-সমালোচনায় এসেছে ছাত্রদল। 

বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে- আসলেই তারা কি চাইছে ছাত্রদল? ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক দ্বিমত ও দ্বন্দ্ব দেখা গেছে।


জানা যায়, বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতি এখন সরগরম নির্বাচন নিয়ে। স্পষ্ট করে বললে নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে। নির্বাচন আগে নাকি সংস্কার আগে- সেই বিতর্কে সম্পর্কে ভাটা পড়েছে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গেও প্রকাশ্যে কথার লড়াইয়ে জড়িয়েছেন ছাত্রদলের নেতারা। দলটির নেতারা যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় নির্বাচন দাবি করে আসছেন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই।

 এমনকি তারা স্থানীয় নির্বাচনও নির্বাচনের পর করার কথা বলছেন। শুধু তাই নয়, স্থানীয় নির্বাচন আগে করতে দেওয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ছাত্রদল ও বিএনপি নেতারা, যদিও এসব বিষয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির ও জাতীয় নাগরিক কমিটি প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর জাতীয় নির্বাচন এবং তার আগেই স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে। 

ছাত্র রাজনীতিতে নতুন উত্তাপ শুরু হচ্ছে কি? বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের দাবি মূল দলের ঠিক উল্টো। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনার মধ্যেই নতুন উত্তাপ শুরু হয়েছে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে। শুরুটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচন নিয়ে। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ছাত্রশিবির এবং মোটাদাগে অন্য সংগঠনগুলো খুব দ্রুতই ডাকসু নির্বাচনে আগ্রহী। তবে এখানে আবার একটু সময় নিতে চায় বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল। তাদের যুক্তি আগে সংস্কার, তারপর নির্বাচন।

এই বিতর্কের মধ্যেই বিরোধ আরও বেড়েছে; কারণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা চায় জাতীয় নির্বাচনের আগেই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়ে যাক। সবমিলিয়ে ছাত্ররাজনীতিতে বেশ চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে। 

ছাত্রসংসদ নির্বাচনের দিকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে গেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। গত ৩০ ডিসেম্বর ছাত্রসংসদ নির্বাচন তথা জাকসুর রোডম্যাপ দিয়ে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। রোডম্যাপ অনুযায়ী, এর এক দিন পরই নির্বাচন কমিশনও গঠিত হয়।

 চলতি মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে নির্বাচন কমিশন চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করবে। আর নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হবে ১ ফেব্রুয়ারি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ছাত্রশিবির, ছাত্র অধিকার পরিষদ কিংবা বাম সংগঠনগুলো নির্বাচনের এই রোডম্যাপকে স্বাগত জানালেও নির্বাচনের সময় নিয়ে আপত্তি জানাচ্ছে ছাত্রদল। বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠনটির সদ্য গঠিত কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক নাইমুল হাসান কৌশিক বলেন, আগে সংস্কার এবং পরে বিচার চায়। 

ষড়যন্ত্র দেখছে ছাত্রদল: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে জাতীয় রাজনীতির একটা ধারা হিসেবেই বিবেচনা করছে। যদিও ছাত্রদল তাদের ভাষায় ‘সংস্কার এবং বিচারের আগে’ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিকে দেখছে ষড়যন্ত্র হিসেবে। 

সংগঠনটির ভেতরে আলোচনা আছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন পক্ষ একসঙ্গে হয়ে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে কাজ করছে। এ ছাড়া সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটা অংশ যে মিছিল করেছে তার পেছনেও ষড়যন্ত্র দেখছে সংগঠনটি। পরিস্থিতি সামাল দিতে পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাল্টা মিছিল করে ছাত্রদল।

রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সংগঠনগুলো নিজ নামে সরাসরি অংশ নিতে পারে না। কিন্তু এরপরও অতীতের নির্বাচনে বিভিন্ন প্যানেলের নামে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে মূলত রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যেই।

ফলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে এসব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করা হয়। কিন্তু এবারের নির্বাচন নিয়ে যে একধরনের বিরোধিতা দেখা যাচ্ছে সেখানে ঐকমত্য কতটা আসবে সেটাই বড় প্রশ্ন?

ছাত্রশিবির কী চায়? নানারকম দ্বন্দ্ব কেন?
সম্প্রতি নির্বাচন নিয়ে মতবিরোধ শুরু হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই অবস্থা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচন নিয়েও দেখা গেছে। একইসঙ্গে উঠে আসছে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচন নিয়ে সোচ্চার দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসা ছাত্রশিবিরকেও। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এমন সময়ে প্রকাশ্যে এসেই শিবির কেন জোর দিচ্ছে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। তবে ছাত্রশিবির বলছে, নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি আছে তাদের। সেক্ষেত্রে দ্রুত নির্বাচনের পক্ষপাতি সংগঠনটি। কিন্তু কেন?

তবে ছাত্রদের নির্বাচন হলেও এর একটা বৃহত্তর রাজনৈতিক তাৎপর্যও আছে। ফলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চায় জাতীয় নির্বাচনের আগেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র নেতৃত্বের নির্বাচন দেখতে। কিন্তু এতে কী লাভ? 

এক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মনে করছে, ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়ে গেলে প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ছাত্র নেতৃত্ব তৈরি হবে, যারা গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় ভূমিকা রাখবে। এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন জরুরি। 

জানতে চাইলে ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম বলেছেন, ক্যাম্পাসগুলোতে যত দিন যাচ্ছে, আমরা দেখছি একধরনের বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক সংগঠন আরেকজনের বিরুদ্ধে নানাভাবে অভিযোগ দিচ্ছে। আবার নানারকম ক্ল্যাশ দেখা গেছে। 

সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন কোনো প্ল্যাটফরম নেই, যারা এসবসহ অন্য যেকোনো সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসতে পারে। 

জানতে চাইলে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব জানান, ছাত্রদল কখনোই নির্বাচনের বিরোধী নন। কিন্তু আমাদের নির্বাচনের বিরোধী হিসেবে প্রচার চালিয়ে ‘ফায়দা লুটতে চায়’ একটি পক্ষ। 

তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমরা এখন সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে যাচ্ছি এবং আল্লাহর রহমতে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। আপনি দেখবেন, সাধারণ শিক্ষার্থীসহ সব ক্যাম্পাসে আমাদের নেতা-কর্মী বৃদ্ধি পাচ্ছে। তো এটা হয়তো একটা গোষ্ঠী রয়েছে, যারা চায় ছাত্রদলের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের এমন সম্পৃক্ততা যেন না হয়। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক, সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মনে করেন, ‘আমরা সম্প্রতি লক্ষ করছি ছাত্রদলের সঙ্গে অন্যান্য ছাত্র রাজনৈতিক দলের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন ও বেশকিছু বিষয় নিয়ে দ্বিমত সৃষ্টি হয়েছে। 

যার কারণে ছাত্রদল বড় সংগঠন হওয়ায়, তারা মাঠে রাজনৈতিক শক্তির আওয়াজ দিচ্ছে। তাদের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে অনেকটা এটা প্রমাণ করে। তবে, অন্যদিকে অন্য ছাত্র সংগঠনগুলোও ক্যাম্পাসে শক্তিশালী হয়ে উঠছে।’
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!