প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বাংলাদেশের ফুসফুস খ্যাত সুন্দরবনের গুরুত্ব, বন সংরক্ষণের ব্যবস্থা, বনায়নের সম্ভাবনা-চ্যালেঞ্জ, দখলকৃত বনভূমি উদ্ধার, অর্থনৈতিক গুরুত্বসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক এফ এ শাহেদ।
রূপালী বাংলাদেশ: কেমন আছেন?
মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী: জ্বি, ভালো আছি।
রূপালী বাংলাদেশ: দেশে বন সংরক্ষণে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও চ্যলেঞ্জের সম্মুখিন হতে হয়?
মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী: বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। যেখানে গড়ে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১২০০ জনের বেশি লোক বাস করে। তারা আবাসস্থল, কৃষিকাজ, শিল্পসহ অন্যান্য কাজের জন্য বনভূমি জবরদখল করছে। বনের চারপাশে যারা বাস করছেন তাদের জীবন-জীবিকাও বনের ওপর নির্ভরশীল। প্রায় ২০ মিলিয়ন সাধারণ মানুষ যারা বনের আশপাশে বাস করে তাদের লাকড়ি (জ্বালানি কাঠ) থেকে শুরু করে নানা প্রয়োজনে কম-বেশি বনের ওপর নির্ভরশীল। এমন পরিস্থিতিতে দেশে বন রক্ষা করা চ্যলেঞ্জের। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা অংশগ্রহণমূলক বন ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি।
রূপালী বাংলাদেশ: দেশে বনায়নের সম্ভাবনা কেমন এবং সাধরণ মানুষকে কীভাবে বনায়নে উদ্বুদ্ধ করা যায়?
মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী: বাংলাদেশ একটি বড় ব-দ্বীপ। এখানে প্রতি বছর লাখ লাখ টন পলিমাটি নদ-নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়। মেঘনা অববাহিকাসহ বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য চর জাগে সেখানে নতুন করে বনায়নের সম্ভাবনা রয়েছে। দেশে নতুন করে বনভূমি ঘোষণার সুযোগ কম, যেহেতু আমাদের জনসংখ্যা বিশাল এবং তাদের বাসস্থানসহ নানা চাহিদা রয়েছে। তবে, আমাদের ভাওয়াল-মধুপুর অঞ্চল, বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বনাঞ্চল রয়েছে। এই বনভূমির অনেক জায়গায় ঘনত্ব কমে গেছে। সেখানে বনায়নের সুযোগ রয়েছে।
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার সিলেট প্রায় ১ লাখ হেক্টর (২.৫ লাখ একর) বনায়ন আমরা করেছি। সুতরাং নতুন বনায়নের সম্ভাবনা যেখানে চর জাগছে সেসব এলাকা এবং যেসব বনভূমির ঘনত্ব কমেছে সেসব স্থানে বনায়ন করা যায়। সাধারণ মানুষকে বনায়নে উদ্বুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে দেশের উপকূলীয় এলাকাÑ নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা এসব এলাকার বসত-বাড়িতসহ ফাঁকা জায়গা এখন গাছে ছেয়ে গেছে।
রূপালী বাংলাদেশ: পরিবেশ দূষণ ও দুর্যোগ রোধে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-উত্তর অঞ্চলে সামাজিক বনায়নে মানুষকে সচেতন কীভাবে করা যায়?
মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী: দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে উত্তর অঞ্চল এবং বৃহত্তর যশোর-কুষ্টিয়ায় সরকারি বনভূমির পরিমাণ একেবারে কম। সুতরাং বনের পরিমাণও এই জেলাগুলোতে কম। ফলে এসব এলাকায় বনায়নের একমাত্র পন্থা হলো অংশীদারিত্ব বনায়নের। রাস্তা, বাঁধ, রেললাইন, প্রতিষ্ঠানসহ বসতবাড়ির ফাঁকা জায়গাতে বনায়ন করা যায়। যার মধ্যমে পরিবেশ দূষণ ও দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজ করা যায়।
রূপালী বাংলাদেশ: বনভূমি উজাড় এবং রক্ষায় কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন?
মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী: নব্বই দশক থেকে যখন শিল্পায়ন বেশি হয়েছে, আবাসের চাহিদা বেড়েছে, তখন থেকে বন উজাড় এবং জবরদখল বেশি হয়েছে। আমরা ২০২০ সালে সর্ব প্রথম একটি তথ্য প্রস্তুত করি। যেখানে ২ লাখ ৫৭ হাজার একর বনভূমি জবরদখল হয়েছে এ তথ্য পেয়েছিলাম। তার ডেটাবেজ করা হয়েছে। জেলাভিত্তিক কে কতটুকু দখল করেছে তার তথ্য প্রকাশও করা হয়েছে। এ পর্যন্ত আমি ৩১ হাজার একর জবরদখল বনভূমি উদ্ধার করে বনায়ন করেছি, যাতে পুনরায় দখল না হতে পারে। একইভাবে জবরদখলকৃত সব বনভূমি উদ্ধারের কাজ চলছে।
রূপালী বাংলাদেশ: বাংলাদেশের ফুসফুস খ্যাত সুন্দরবনে বাড়ছে লবণাক্ততা। সুন্দরবন রক্ষার্থে কি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?
মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী: দেশের নানা স্থানের বনভূমি জবরদখল হলেও আশ্বস্তের জায়গা হচ্ছে সুন্দরবনের এক বিঘা জমিও জবরদখল হয়নি। পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয় বিশ্বের বৃহত্তম অরণ্য আমাজন। তেমনই বাংলাদেশের ফুসফুস যেমন সুন্দরবন, একইভাবে আমি বলব ঢাকার ফুসফুস বোটানিক্যাল গার্ডেনÑ এগুলো আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। সুন্দরবন এখনো যে জবরদখল হয়নি তার জন্য প্রাকৃতিক অবস্থান অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যেহেতু এটি একটি জলাভূমির বন, এখানে জোয়ারের পানি উঠে। ফলে বসবাসের জন্য উপযুক্ত না। এই প্রাকৃতিক বাধার কারণে সুন্দরবন জবরদখল হয় না। সুন্দরবন খ্যাতি মূলত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্য। সুন্দরবনের অবস্থা বুঝতে আমাদের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অবস্থা বুঝতে হবে। সরকার সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যার তালিকা প্রকাশ করেছে সেখানে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৮ সালে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১১৪। সেটি ২০২৪ এর সেপ্টেম্বর বেড়ে হয়েছে ১২৫টি। বাঘ বেড়েছে যার অর্থ সুন্দরবনের খাদ্যশৃঙ্খল ঠিক আছে।
সুন্দরবনের যে খাদ্যশৃঙ্খল রয়েছে তার সবার ওপরে বাঘের অবস্থান। বাঘ বাড়ছে মানে বনে হরিণ এবং বুনো শুকর বেড়েছে, আর বাঘের খাদ্য বেড়েছে যার অর্থ বনের গাছ বা উদ্ভিদের অবস্থা ভালো আছে।
সুন্দরবনে লবণাক্ততা যদি বাড়তে থাকে তবে প্রথমে হুমকিতে পড়বে সুন্দরী গাছ। জলবায়ু পরিবর্তন, মিঠা পানির উৎস কমে যাওয়া, বনের বেশকিছু খালে পলিমাটি জমে যাওয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় চর জেগে উঠছে। এতে করে নদীর পানির ফ্লো কমে যাওয়ার ফলে মূলত লবণ পানির আধিক্য বাড়ছে। এটি চলতে থাকলে বনের ধরনের পরিবর্তন ঘটবে। লোনা পানিতে যেসব উদ্ভিদ জন্মায় সেগুলোর আধিক্য বাড়তে থাকবে। সুন্দরবনের লবণাক্ততা কমাতে উজানের নদীগুলোর নাব্য এবং মিঠা পানির ফ্লো ঠিক রাখতে হবে। সুন্দরী গাছ টিকিয়ে রাখতে হলে লবণাক্ততার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
রূপালী বাংলাদেশ: ধন্যবাদ আপনাকে।
মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী: রূপালী বাংলাদেশ এবং আপনাকেও ধন্যবাদ।
আপনার মতামত লিখুন :